দেশের ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণ বড় ব্যবসায়ী গ্রুপের কাছে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছে। মোট ঋণের মধ্যে তিন লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকাই শীর্ষ ৫০ গ্রুপের কাছে আটকে আছে, যা মোট ঋণের প্রায় ২২ শতাংশ। ইতোমধ্যে এসব ঋণের ৩৩ দশমিক ১১ শতাংশ খেলাপি হয়ে গেছে। উদ্বেগের বিষয় হলো, এ ঋণ বিতরণের সময় পর্যাপ্ত জামানতও নেওয়া হয়নি। শীর্ষ এ ৫০ গ্রুপের ঋণের বিপরীতে জামানত রয়েছে মাত্র ৯০ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
তথ্য অনুযায়ী, বৃহৎ ঋণগ্রহণকারী শীর্ষ ৫০টি গ্রুপ ও এ প্রতিষ্ঠানগুলোর ইকুইটি প্রায় ২ দশমিক ৬৪ লাখ কোটি টাকা। যার ফলে তাদের দায়-ইকুইটি অনুপাত দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৩৮ অনুপাত ১। অর্থাৎ নিজেদের মূলধনের তুলনায় ঋণের অংশ অনেক বেশি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিগত সরকারের আমলে রাজনৈতিক প্রভাবশালী শিল্পগোষ্ঠীর কাছে বছরের পর বছর বিপুল অঙ্কের ঋণ কেন্দ্রীভূত হওয়ার ফলে পুরো ব্যাংকিং খাত আজ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। দুর্বল তদারকি ও শিথিল ঋণনীতির কারণে আমানতকারীদের অর্থ কার্যত অনিরাপদ হয়ে পড়েছে। দ্রুত স্বচ্ছতা, বড় ঋণ পুনর্মূল্যায়ন এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন তারা।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকিং খাতে বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ ১৬ দশমিক ৮০ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে বড় ঋণগ্রহীতা গ্রুপ বা প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে বিতরণ করা হয়েছে ১০ দশমিক ৫২ লাখ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট ঋণের ৬২ দশমিক ৫৯ শতাংশই গেছে বৃহৎ গ্রুপ ও প্রতিষ্ঠানের কাছে।
প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এসব ঋণের বিপরীতে জামানত রয়েছে মাত্র ২৭ দশমিক ১১ শতাংশ। অর্থাৎ ঋণের বেশিরভাগই কার্যকর জামানত ছাড়া বিতরণ করা হয়েছে। ফলে এসব ঋণ অনাদায়ী হলে ব্যাংকগুলোর অর্থ উদ্ধার প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
এ বৃহৎ ঋণগুলোর একটি বড় অংশ ইতোমধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। ব্যাংক খাতের মোট খেলাপি ঋণের হার দাঁড়িয়েছে ২৪ দশমিক ৮২ শতাংশ। এর মধ্যে শুধু বৃহৎ ঋণে খেলাপি ১৯ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। অর্থাৎ পুরো ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের ৭৬ দশমি ৭১ শতাংশই বৃহৎ ঋণের অংশ।
এদিকে বড় ঋণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন সুবিধা দেওয়া হয়েছে। তথ্য অনুযায়ী, বৃহৎ ঋণের ক্ষেত্রে পুনঃতফসিলকৃত ও পুনর্গঠিত ঋণের পরিমাণ প্রায় ১ দশমিক ১৪ লাখ কোটি টাকা, যা মোট বৃহৎ ঋণের প্রায় ১১ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টদের মতে, খেলাপি ঋণ লুকাতেই এ কৌশল বছরের পর বছর ব্যবহার করা হচ্ছে। এভাবে শুধু কাগজ-কলমে খেলাপি ঋণ কমলেও প্রকৃতপক্ষে খেলাপি কমেনি।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ব্যাংকিং খাতে ঋণ ও অগ্রিমের একটি বড় অংশ বর্তমানে হাতেগোনা কয়েকটি বৃহৎ গ্রুপ ও প্রতিষ্ঠানের কাছে কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে, যা দেশের আর্থিক ব্যবস্থার জন্য একটি বড় ধরনের ঝুঁকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। এ ধরনের অতিরিক্ত কেন্দ্রীভূত (Concentration Risk) শুধু ব্যাংকগুলোর ঝুঁকি বাড়াচ্ছে না, বরং কোনো বড় ঋণগ্রহীতা গ্রুপ বা প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতা পুরো আর্থিক ব্যবস্থায় প্রভাব তৈরি করার বাস্তব সম্ভাবনাও সৃষ্টি করছে। একই সঙ্গে বড় ঋণগুলো অনাদায়ী হয়ে পড়লে একাধিক ব্যাংক একযোগে সংকটে পড়তে পারে, যার ফলে পুরো ফাইন্যান্সিয়াল সিস্টেমে অস্থিরতা তৈরি হবে।

