বড় লোকসানে ন্যাশনাল ব্যাংক

অর্থনৈতিক রিপোর্টার
প্রকাশ : ২৪ জুলাই ২০২৫, ১১: ১৫

বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে বড় লোকসানে পড়েছে। এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে ব্যাংকটির ৭৬৩ কোটি টাকার সমন্বিত লোকসান হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় চারগুণ বেশি। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ওয়েবসাইটে গতকাল বুধবার প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।

বিজ্ঞাপন

ব্যাংকটি ডিএসইর ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের জানিয়েছে, ঋণের বিপরীতে কোনো সুদ আয় হিসাবে নিতে পারেনি ব্যাংকটি। কারণ, ব্যাংকটির বিপুল পরিমাণ ঋণখেলাপি হয়ে গেছে। এসব ঋণের বড় অংশই এখন অনাদায়ী। এ ছাড়া ব্যাংকটি চরম তারল্য সংকটেও ভুগছে। এ কারণে বাড়তি সুদে আমানত সংগ্রহ করতে হচ্ছে। যার ফলে আমানতের সুদ বাবদও বেশি অর্থ খরচ হয়েছে। সব মিলিয়ে বড় ধরনের লোকসানে।

ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, দ্বিতীয় প্রান্তিকে তাদের শেয়ারপ্রতি লোকসান ২ দশমিক ৩৭ টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা ২০২৪ সালের এপ্রিল-জুন মাসে শেয়ারপ্রতি লোকসান ০.৫১ টাকা পুনঃনির্ধারিত ছিল। এই বছরের জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে ব্যাংকটি ২২২.১৬ কোটি টাকার লোকসানের পর এটি এসেছে।

সর্বশেষ প্রান্তিকে ব্যাংকটির শেয়ারপ্রতি নগদ অর্থের প্রবাহ ছিল নেতিবাচক ৯ টাকা ২৬ পয়সা, যা গত বছর একই সময়ে নেতিবাচক ছিল ৭ টাকা ৯৫ পয়সা। গত ৩০ জুন সমন্বিতভাবে ব্যাংকটির শেয়ারপ্রতি নিট দায় ছিল ১ টাকা ১৯ পয়সা।

ডিএসইর তথ্য অনুসারে, ৩০ জুন পর্যন্ত স্পন্সর এবং পরিচালকদের হাতে ব্যাংকের ১৫.৫৪ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা ৩৮.২৩ শতাংশ, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ০.৩৬ শতাংশ এবং সাধারণ জনগণের ৪৫.৮৭ শতাংশ শেয়ার ছিল।

দেশের আর্থিক খাতের অতি সমালোচিত সিকদার পরিবার ও এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে নানা আর্থিক অনিয়মের পর গত ৫ আগস্ট দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ব্যাংকটির পর্ষদ ভেঙে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে গঠন করা হয় নতুন পর্ষদ। নতুন পর্ষদ গঠনের পর ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালক ও চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন ব্যাংকটির উদ্যোক্তা আবদুল আউয়াল মিন্টু, তিনি বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রতি প্রান্তিকেই ব্যাংকটি লোকসানের সম্মুখীন হয়েছে।

তিন বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে লোকসান করছে ব্যাংকটি। এর মধ্যে সর্বোচ্চ লোকসান করেছিল ২০২২ সালে। ওই বছর ব্যাংকটি ৩ হাজার ২৬১ কোটি টাকা লোকসান করেছিল, যা ছিল দেশের ইতিহাসে কোনো ব্যাংকের একক সর্বোচ্চ লোকসান। ২০২৩ সালে ন্যাশনাল ব্যাংকের লোকসানের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৪৯৭ কোটি টাকা। গত বছর শেষে বেসরকারি খাতের প্রথম প্রজন্মের ব্যাংকটি ১ হাজার ৭০৬ কোটি টাকা লোকসান করেছে। বিপুল পরিমাণ লোকসানের কারণে গত বছরও ব্যাংকটি শেয়ারধারীদের কোনো লভ্যাংশ দিতে পারেনি। ২০০২ সালের রেকর্ড লোকসানের পর থেকে আর লাভের মুখ দেখেনি ঋণ কেলেঙ্কারিতে জর্জরিত ব্যাংকটি।

বেসরকারি খাতের প্রথম প্রজন্মের ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে বড় পরিবর্তন হয় ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই। ওই বছরে ব্যাংকটির কর্তৃত্ব চলে যায় সিকদার গ্রুপের চেয়ারম্যান জয়নুল হক সিকদারের কাছে। নিজের স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে, আত্মীয়স্বজন ও দলীয় নেতাদের পর্ষদে যুক্ত করে ব্যাংকটির একক নিয়ন্ত্রণ নেয় সিকদার পরিবার। শুরু হয় অনিয়ম, ব্যাংক ছাড়েন ভালো উদ্যোক্তারা। এর আগ পর্যন্ত এটির পরিচিতি ছিল একটি শীর্ষস্থানীয় ব্যাংক হিসেবে।

সিকদার পরিবারের হাতে ন্যাশনাল ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ যাওয়ার পর পরিচালনা পর্ষদের অযাচিত হস্তক্ষেপ ও বেনামি ঋণের নানা ঘটনা বেরিয়ে আসে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে। পর্ষদে পটপরিবর্তনের প্রায় ৬ বছর পর ২০১৪ সালে ন্যাশনাল ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে আর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। কারণ, সিকদার পরিবার ও তাদের পক্ষে যেসব সংস্থা প্রভাব বিস্তার করে আসছিল, একাধিক নিয়ন্ত্রক সংস্থাও তাতে সুর মেলায়। ফলে আরো খারাপ হয় ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিস্থিতি।

২০০৯ সালে যে ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪০০ কোটি টাকার কম, এখন তা বেড়ে ২৭ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। সর্বশেষ হিসাবে, ন্যাশনাল ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের ৬৪ শতাংশই খেলাপি।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত