আমার দেশ ডেস্ক
ক্ষমতা গ্রহণের দশ মাস পর প্রথমবারের মতো বাজেট ঘোষণা করেছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। গতকাল সোমবার অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছেন, যা আগের বছরের তুলনায় ৭ হাজার কোটি টাকা কম। এবারের বাজেট এমন একটি সময়ে ঘোষণা করা হয়েছে, যখন উচ্চ মূল্যস্ফীতি, রাজস্ব ঘাটতি, বিদেশি ঋণের কঠোর শর্ত এবং বিনিয়োগে স্থবিরতাসহ বিভিন্ন কারণে দেশের অর্থনীতি চাপের মধ্যে রয়েছে। খবর বিবিসির।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর প্রথম ঘোষিত বাজেটে এসব সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়নে নতুন উদ্যোগ নেয়া হবে কিনা, তা নিয়ে আগ্রহ ছিল। তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রস্তাবিত বাজেটে আগের রাজনৈতিক সরকারগুলোর সঙ্গে খুব একটা পার্থক্য নেই।
অর্থনীতি বিষয়ক বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং’ (সানেম)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘এবারের বাজেটে কিছু ভালো উদ্যোগের কথা বলা হলেও কাঠামো পুরনো। ফলে গতানুগতিক বাজেটের সমস্যাগুলো এখানেও রয়ে গেছে। এই সরকারের সামনে ভিন্নধর্মী বাজেট উপস্থাপনের সুযোগ ছিল, যা তারা কাজে লাগাতে পারেনি।’
বাজেটে করদাতার সংখ্যা বাড়ানোর পদক্ষেপ না নিয়ে আগের মতো করদাতাদের করের হার বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে, যা অর্থনীতিবিদদের সমালোচনার মুখে পড়েছে।
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমাদের এবারের বাজেট কিছুটা ব্যতিক্রমধর্মী। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আমরা বিগত বাজেটের চেয়ে ছোট আকারের বাজেট আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাব করছি। প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রিক ধারণা থেকে সরে এসে আমরা সামগ্রিক উন্নয়নের ধারণায় জোর দিতে চেষ্টা করেছি।’
‘উচ্চাকাঙ্ক্ষী’ বাজেট: অন্য বছর জাতীয় সংসদে পেশ করা হলেও এবার বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে বেতার ও টেলিভিশনের মাধ্যমে। প্রস্তাবিত বাজেটে আগামী অর্থবছরের জন্য মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘মূল্যস্ফীতির সঙ্গে লড়াইয়ের ফলে আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার অন্যান্য বছরের তুলনায় কিছুটা কম হতে পারে। চলতি অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধি সাময়িক হিসাবে তিন দশমিক ৯৭ শতাংশ হয়েছে, যা চূড়ান্ত হিসাবে কিছুটা বাড়তে পারে। তবে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এটি বৃদ্ধি পাবে এবং মধ্যমেয়াদে ছয় দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত হবে বলে আমরা আশা করছি।’
এছাড়া চলতি বছরের উচ্চ মূল্যস্ফীতির হার আগামী বছর কমিয়ে সাড়ে ছয় শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সরকার।
তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই লক্ষ্য পূরণ করতে হলে নতুন বিনিয়োগসহ অর্থনীতিতে যে ধরনের পরিবর্তন দরকার, সেটি আনার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য যে বাঁধাগুলো রয়েছে, সেগুলো কতটুকু দূর করা গেছে? বর্তমানে দেশে ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগের অবস্থা স্থবির। সরকারের নির্ধারিত জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা বেশ উচ্চাকাঙ্ক্ষী মনে হচ্ছে।’
বাড়েনি করমুক্ত আয়ের সীমা: এবার বাজেটে ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়সীমা বাড়েনি। গত বছরের মতোই ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বার্ষিক করমুক্ত আয়সীমা সাড়ে ৩ লাখ টাকা রাখা হয়েছে। তবে ২০২৬-২৭ এবং ২০২৭-২৮ অর্থবছরের জন্য করমুক্ত আয়ের সীমা ২৫ হাজার টাকা বাড়িয়ে তিন লাখ ৭৫ হাজার টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে।
এছাড়া নারী করদাতা ও ৬৫ বছরের বেশি বয়সীদের জন্য করমুক্ত আয়সীমা চার লাখ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। তৃতীয় লিঙ্গের করদাতা ও স্বাভাবিক ব্যক্তি করদাতাদের ক্ষেত্রে এই আয়সীমা হবে পৌনে ৫ লাখ টাকা। গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা করদাতাদের করমুক্ত আয়ের সীমা পাঁচ লাখ টাকা হবে। গেজেটভুক্ত জুলাই গণঅভ্যুত্থান ২০২৪ এ আহত ‘জুলাই যোদ্ধা’ করদাতাদের জন্য ২০২৬-এ করমুক্ত আয়ের সীমা পাঁচ লাখ ২৫ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
নতুন করদাতাদের ক্ষেত্রে ন্যূনতম করের পরিমাণ এক হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে পরের দুই বছর করমুক্ত আয়ের সীমা অতিক্রম করলে ন্যূনতম কর দিতে হবে ৫ হাজার টাকা। বেসরকারি চাকরিজীবীদের করযোগ্য আয় হিসাব করার সময় সর্বোচ্চ বাদযোগ্য অঙ্কের পরিমাণ সাড়ে চার লক্ষ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫ লাখ টাকা করা হয়েছে।
জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের আয় ও সর্বজনীন পেনশন স্কিম থেকে কোনো আয় এবং জিরো কুপন ইসলামিক ইনভেস্টমেন্ট সার্টিফিকেট থেকে আয় করমুক্ত রাখা হয়েছে। চাকরিজীবী কর্মচারীদের কিডনি, লিভার, ক্যান্সার, হার্ট, মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার ও কৃত্রিম অঙ্গ প্রতিস্থাপন সংক্রান্ত চিকিৎসা ব্যয় বাবদ প্রাপ্ত অর্থ করমুক্ত রাখা হয়েছে।
বেড়েছে করের চাপ: এবারের বাজেটে সার্বিকভাবে অধিকাংশ করদাতার ওপর করের চাপ বাড়ানো হয়েছে। এক্ষেত্রে করহারের ধাপে কিছুটা পরিবর্তন এনে সাতটির জায়গায় ছয়টি ধাপে করহার প্রস্তাব করেছেন অর্থ উপদেষ্টা। সর্বোচ্চ করহার আগের মতো ৩০ শতাংশ রাখা হলেও আগের ধাপগুলোর সীমা কমিয়ে আনার ফলে গত বছরের সমান আয় করেও অনেক করদাতাকে বেশি হারে কর দিতে হবে।
বাজেট প্রস্তাব অনুযায়ী, নতুন অর্থবছরে আয়করের হার আগের মতোই থাকবে। তবে পরের দুই বছরের করহারে পরিবর্তন আনা হয়েছে। ২০২৬-২৭ ও ২০২৭-২৮ অর্থবছরে বার্ষিক তিন লাখ ৭৫ হাজার টাকা পর্যন্ত আয়ে কর দিতে হবে না। পরবর্তী তিন লাখ টাকা আয়ে কর দিতে হবে ১০ শতাংশ হারে। যেহেতু কর হিসাব করা হয় আগের বছরের জুলাই মাস থেকে আয়বছর ধরে, ফলে এই জুলাই মাস থেকেই নতুন করের হার প্রযোজ্য হবে। আগে সাড়ে ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ের ওপর ৫ শতাংশ এবং তার পরের চার লাখ টাকার ওপর ১০ শতাংশ হারে কর দিতে হতো।
অন্যদিকে, সাড়ে ৮ লাখ টাকার ওপরে পরবর্তী ৫ লাখ টাকা আয়ের জন্য ১৫ শতাংশ হারে কর দিতে হতো। এখন ৬ লাখ ৭৫ হাজার টাকার ওপরে পরবর্তী ৪ লাখ টাকা আয়ের জন্য একই হারে কর দিতে হবে। সাড়ে ১৩ লাখ টাকার ওপরে পরবর্তী ৫ লাখ টাকা আয়ের জন্য আগে যেখানে ২০ শতাংশ হারে কর দিতে হতো, এখন সেখানে ১০ লাখ ৭৫ হাজার টাকার ওপরে পরবর্তী ৫ লাখ টাকা আয়ের জন্য ২০ শতাংশ হারে কর দিতে হবে।
একইভাবে, এখন ১৫ লাখ ৭৫ হাজার টাকার ওপরে পরবর্তী ২০ লাখ টাকা আয়ের জন্য ২৫ শতাংশ হারে কর দিতে হবে, যা আগে সাড়ে ১৮ লাখ টাকার ওপরে পরবর্তী ২০ লাখ টাকা আয়ের জন্য দিতে হতো। আর সাড়ে ৩৮ লাখ টাকার ওপরে পরবর্তী সকল আয়ের জন্য আগে ৩০ শতাংশ হারে কর দিতে হতো, এখন সেখানে ৩৫ লাখ ৭৫ হাজার টাকার ওপরে সকল আয়ের জন্য ৩০ শতাংশ হারে কর দিতে হবে।
ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘এখানেও সরকার পুরনো কাঠামো অনুসরণ করেছে। করের আওতা না বাড়িয়ে বরং করহার বাড়ানো হয়েছে। এতে যারা ইতোমধ্যে কর দিচ্ছেন, তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি হচ্ছে।’
কালো টাকা সাদা করার বিধান বহাল: প্রস্তাবিত বাজেটে আগের বছরের মতো এবারও কালো টাকা সাদা করার সুযোগ অব্যাহত রাখা হয়েছে। সরকারের এই সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
টিআইবি বলেছে, সরকার দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সংস্কারের মূল উদ্দেশ্যের সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী অবস্থান নিয়েছে, যা অনৈতিক, বৈষম্যমূলক ও সংবিধান পরিপন্থী।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘সরকারের এমন সিদ্ধান্ত স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, রাষ্ট্রসংস্কার, বিশেষ করে দুর্নীতিবিরোধী সংস্কারের মূল উদ্দেশ্যকে রীতিমতো উপেক্ষা করা হচ্ছে। সরকার দুর্নীতিকে উৎসাহ দিয়ে রিয়েল এস্টেট লবির ক্ষমতার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে।’
তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, এমন সিদ্ধান্ত দুর্নীতিকে উৎসাহ দেবে। কালো টাকা সাদা করার সুযোগ একই সঙ্গে বৈষম্যমূলক। কারণ, এই সিদ্ধান্তের ফলে আবাসন খাতে অবৈধ অর্থের মালিকদের অধিকতর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হবে এবং সৎ উপার্জনকারীদের ফ্ল্যাট বা ভবনের অংশীদার হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করবে।
বাজেটের চ্যালেঞ্জ: মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়ানোর বিপরীতে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি ও সামাজিক বৈষম্য দূর করা এবারের বাজেটের বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানের দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বৈষম্যবিরোধী চেতনা ও কর্মসংস্থান। কিন্তু বিনিয়োগকে উৎসাহিত করা না গেলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না।’
বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাসহ বিভিন্ন কারণে নতুন বিনিয়োগ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। অন্যদিকে, করের আওতা না বাড়িয়ে সরকার যেভাবে করের হার বাড়িয়েছে, তাতে করদাতাদের ওপর চাপ বেড়েছে।
ড. রায়হান বলেন, ‘কিন্তু এই করহারের বিপরীতে তাদের সামনে এমন কোনো সুযোগ-সুবিধা তুলে ধরা হয়নি, যা দেখে তারা কর দিতে উৎসাহিত হবে।’ অন্যদিকে, রাজস্বখাতের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে বিভিন্ন ইস্যুতে যে অসন্তোষ দেখা যাচ্ছে, সেটি দ্রুত সমাধান করা না গেলে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা কতটুকু অর্জিত হবে, সেটি নিয়েও শঙ্কা রয়েছে।
আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা।
অর্থ উপদেষ্টা প্রস্তাব করেছেন, মোট ঘাটতির মধ্যে এক লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে এবং এক লাখ এক হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক উৎস থেকে মেটানো হবে। এক্ষেত্রে দেশি-বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে এক লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের প্রায় সাড়ে ১৫ শতাংশ। এটাকেও নতুন বাজেটের একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম রায়হান।
ক্ষমতা গ্রহণের দশ মাস পর প্রথমবারের মতো বাজেট ঘোষণা করেছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। গতকাল সোমবার অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছেন, যা আগের বছরের তুলনায় ৭ হাজার কোটি টাকা কম। এবারের বাজেট এমন একটি সময়ে ঘোষণা করা হয়েছে, যখন উচ্চ মূল্যস্ফীতি, রাজস্ব ঘাটতি, বিদেশি ঋণের কঠোর শর্ত এবং বিনিয়োগে স্থবিরতাসহ বিভিন্ন কারণে দেশের অর্থনীতি চাপের মধ্যে রয়েছে। খবর বিবিসির।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর প্রথম ঘোষিত বাজেটে এসব সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়নে নতুন উদ্যোগ নেয়া হবে কিনা, তা নিয়ে আগ্রহ ছিল। তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রস্তাবিত বাজেটে আগের রাজনৈতিক সরকারগুলোর সঙ্গে খুব একটা পার্থক্য নেই।
অর্থনীতি বিষয়ক বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং’ (সানেম)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘এবারের বাজেটে কিছু ভালো উদ্যোগের কথা বলা হলেও কাঠামো পুরনো। ফলে গতানুগতিক বাজেটের সমস্যাগুলো এখানেও রয়ে গেছে। এই সরকারের সামনে ভিন্নধর্মী বাজেট উপস্থাপনের সুযোগ ছিল, যা তারা কাজে লাগাতে পারেনি।’
বাজেটে করদাতার সংখ্যা বাড়ানোর পদক্ষেপ না নিয়ে আগের মতো করদাতাদের করের হার বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে, যা অর্থনীতিবিদদের সমালোচনার মুখে পড়েছে।
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমাদের এবারের বাজেট কিছুটা ব্যতিক্রমধর্মী। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আমরা বিগত বাজেটের চেয়ে ছোট আকারের বাজেট আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাব করছি। প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রিক ধারণা থেকে সরে এসে আমরা সামগ্রিক উন্নয়নের ধারণায় জোর দিতে চেষ্টা করেছি।’
‘উচ্চাকাঙ্ক্ষী’ বাজেট: অন্য বছর জাতীয় সংসদে পেশ করা হলেও এবার বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে বেতার ও টেলিভিশনের মাধ্যমে। প্রস্তাবিত বাজেটে আগামী অর্থবছরের জন্য মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘মূল্যস্ফীতির সঙ্গে লড়াইয়ের ফলে আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার অন্যান্য বছরের তুলনায় কিছুটা কম হতে পারে। চলতি অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধি সাময়িক হিসাবে তিন দশমিক ৯৭ শতাংশ হয়েছে, যা চূড়ান্ত হিসাবে কিছুটা বাড়তে পারে। তবে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এটি বৃদ্ধি পাবে এবং মধ্যমেয়াদে ছয় দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত হবে বলে আমরা আশা করছি।’
এছাড়া চলতি বছরের উচ্চ মূল্যস্ফীতির হার আগামী বছর কমিয়ে সাড়ে ছয় শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সরকার।
তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই লক্ষ্য পূরণ করতে হলে নতুন বিনিয়োগসহ অর্থনীতিতে যে ধরনের পরিবর্তন দরকার, সেটি আনার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য যে বাঁধাগুলো রয়েছে, সেগুলো কতটুকু দূর করা গেছে? বর্তমানে দেশে ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগের অবস্থা স্থবির। সরকারের নির্ধারিত জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা বেশ উচ্চাকাঙ্ক্ষী মনে হচ্ছে।’
বাড়েনি করমুক্ত আয়ের সীমা: এবার বাজেটে ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়সীমা বাড়েনি। গত বছরের মতোই ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বার্ষিক করমুক্ত আয়সীমা সাড়ে ৩ লাখ টাকা রাখা হয়েছে। তবে ২০২৬-২৭ এবং ২০২৭-২৮ অর্থবছরের জন্য করমুক্ত আয়ের সীমা ২৫ হাজার টাকা বাড়িয়ে তিন লাখ ৭৫ হাজার টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে।
এছাড়া নারী করদাতা ও ৬৫ বছরের বেশি বয়সীদের জন্য করমুক্ত আয়সীমা চার লাখ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। তৃতীয় লিঙ্গের করদাতা ও স্বাভাবিক ব্যক্তি করদাতাদের ক্ষেত্রে এই আয়সীমা হবে পৌনে ৫ লাখ টাকা। গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা করদাতাদের করমুক্ত আয়ের সীমা পাঁচ লাখ টাকা হবে। গেজেটভুক্ত জুলাই গণঅভ্যুত্থান ২০২৪ এ আহত ‘জুলাই যোদ্ধা’ করদাতাদের জন্য ২০২৬-এ করমুক্ত আয়ের সীমা পাঁচ লাখ ২৫ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
নতুন করদাতাদের ক্ষেত্রে ন্যূনতম করের পরিমাণ এক হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে পরের দুই বছর করমুক্ত আয়ের সীমা অতিক্রম করলে ন্যূনতম কর দিতে হবে ৫ হাজার টাকা। বেসরকারি চাকরিজীবীদের করযোগ্য আয় হিসাব করার সময় সর্বোচ্চ বাদযোগ্য অঙ্কের পরিমাণ সাড়ে চার লক্ষ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫ লাখ টাকা করা হয়েছে।
জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের আয় ও সর্বজনীন পেনশন স্কিম থেকে কোনো আয় এবং জিরো কুপন ইসলামিক ইনভেস্টমেন্ট সার্টিফিকেট থেকে আয় করমুক্ত রাখা হয়েছে। চাকরিজীবী কর্মচারীদের কিডনি, লিভার, ক্যান্সার, হার্ট, মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার ও কৃত্রিম অঙ্গ প্রতিস্থাপন সংক্রান্ত চিকিৎসা ব্যয় বাবদ প্রাপ্ত অর্থ করমুক্ত রাখা হয়েছে।
বেড়েছে করের চাপ: এবারের বাজেটে সার্বিকভাবে অধিকাংশ করদাতার ওপর করের চাপ বাড়ানো হয়েছে। এক্ষেত্রে করহারের ধাপে কিছুটা পরিবর্তন এনে সাতটির জায়গায় ছয়টি ধাপে করহার প্রস্তাব করেছেন অর্থ উপদেষ্টা। সর্বোচ্চ করহার আগের মতো ৩০ শতাংশ রাখা হলেও আগের ধাপগুলোর সীমা কমিয়ে আনার ফলে গত বছরের সমান আয় করেও অনেক করদাতাকে বেশি হারে কর দিতে হবে।
বাজেট প্রস্তাব অনুযায়ী, নতুন অর্থবছরে আয়করের হার আগের মতোই থাকবে। তবে পরের দুই বছরের করহারে পরিবর্তন আনা হয়েছে। ২০২৬-২৭ ও ২০২৭-২৮ অর্থবছরে বার্ষিক তিন লাখ ৭৫ হাজার টাকা পর্যন্ত আয়ে কর দিতে হবে না। পরবর্তী তিন লাখ টাকা আয়ে কর দিতে হবে ১০ শতাংশ হারে। যেহেতু কর হিসাব করা হয় আগের বছরের জুলাই মাস থেকে আয়বছর ধরে, ফলে এই জুলাই মাস থেকেই নতুন করের হার প্রযোজ্য হবে। আগে সাড়ে ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ের ওপর ৫ শতাংশ এবং তার পরের চার লাখ টাকার ওপর ১০ শতাংশ হারে কর দিতে হতো।
অন্যদিকে, সাড়ে ৮ লাখ টাকার ওপরে পরবর্তী ৫ লাখ টাকা আয়ের জন্য ১৫ শতাংশ হারে কর দিতে হতো। এখন ৬ লাখ ৭৫ হাজার টাকার ওপরে পরবর্তী ৪ লাখ টাকা আয়ের জন্য একই হারে কর দিতে হবে। সাড়ে ১৩ লাখ টাকার ওপরে পরবর্তী ৫ লাখ টাকা আয়ের জন্য আগে যেখানে ২০ শতাংশ হারে কর দিতে হতো, এখন সেখানে ১০ লাখ ৭৫ হাজার টাকার ওপরে পরবর্তী ৫ লাখ টাকা আয়ের জন্য ২০ শতাংশ হারে কর দিতে হবে।
একইভাবে, এখন ১৫ লাখ ৭৫ হাজার টাকার ওপরে পরবর্তী ২০ লাখ টাকা আয়ের জন্য ২৫ শতাংশ হারে কর দিতে হবে, যা আগে সাড়ে ১৮ লাখ টাকার ওপরে পরবর্তী ২০ লাখ টাকা আয়ের জন্য দিতে হতো। আর সাড়ে ৩৮ লাখ টাকার ওপরে পরবর্তী সকল আয়ের জন্য আগে ৩০ শতাংশ হারে কর দিতে হতো, এখন সেখানে ৩৫ লাখ ৭৫ হাজার টাকার ওপরে সকল আয়ের জন্য ৩০ শতাংশ হারে কর দিতে হবে।
ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘এখানেও সরকার পুরনো কাঠামো অনুসরণ করেছে। করের আওতা না বাড়িয়ে বরং করহার বাড়ানো হয়েছে। এতে যারা ইতোমধ্যে কর দিচ্ছেন, তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি হচ্ছে।’
কালো টাকা সাদা করার বিধান বহাল: প্রস্তাবিত বাজেটে আগের বছরের মতো এবারও কালো টাকা সাদা করার সুযোগ অব্যাহত রাখা হয়েছে। সরকারের এই সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
টিআইবি বলেছে, সরকার দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সংস্কারের মূল উদ্দেশ্যের সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী অবস্থান নিয়েছে, যা অনৈতিক, বৈষম্যমূলক ও সংবিধান পরিপন্থী।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘সরকারের এমন সিদ্ধান্ত স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, রাষ্ট্রসংস্কার, বিশেষ করে দুর্নীতিবিরোধী সংস্কারের মূল উদ্দেশ্যকে রীতিমতো উপেক্ষা করা হচ্ছে। সরকার দুর্নীতিকে উৎসাহ দিয়ে রিয়েল এস্টেট লবির ক্ষমতার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে।’
তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, এমন সিদ্ধান্ত দুর্নীতিকে উৎসাহ দেবে। কালো টাকা সাদা করার সুযোগ একই সঙ্গে বৈষম্যমূলক। কারণ, এই সিদ্ধান্তের ফলে আবাসন খাতে অবৈধ অর্থের মালিকদের অধিকতর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হবে এবং সৎ উপার্জনকারীদের ফ্ল্যাট বা ভবনের অংশীদার হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করবে।
বাজেটের চ্যালেঞ্জ: মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়ানোর বিপরীতে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি ও সামাজিক বৈষম্য দূর করা এবারের বাজেটের বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানের দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বৈষম্যবিরোধী চেতনা ও কর্মসংস্থান। কিন্তু বিনিয়োগকে উৎসাহিত করা না গেলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না।’
বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাসহ বিভিন্ন কারণে নতুন বিনিয়োগ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। অন্যদিকে, করের আওতা না বাড়িয়ে সরকার যেভাবে করের হার বাড়িয়েছে, তাতে করদাতাদের ওপর চাপ বেড়েছে।
ড. রায়হান বলেন, ‘কিন্তু এই করহারের বিপরীতে তাদের সামনে এমন কোনো সুযোগ-সুবিধা তুলে ধরা হয়নি, যা দেখে তারা কর দিতে উৎসাহিত হবে।’ অন্যদিকে, রাজস্বখাতের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে বিভিন্ন ইস্যুতে যে অসন্তোষ দেখা যাচ্ছে, সেটি দ্রুত সমাধান করা না গেলে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা কতটুকু অর্জিত হবে, সেটি নিয়েও শঙ্কা রয়েছে।
আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা।
অর্থ উপদেষ্টা প্রস্তাব করেছেন, মোট ঘাটতির মধ্যে এক লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে এবং এক লাখ এক হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক উৎস থেকে মেটানো হবে। এক্ষেত্রে দেশি-বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে এক লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের প্রায় সাড়ে ১৫ শতাংশ। এটাকেও নতুন বাজেটের একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম রায়হান।
পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামকে আজীবন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। একই সঙ্গে বহুল আলোচিত সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান এলআর গ্লোবালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রিয়াজ ইসলামকেও অনুরূপ শাস্তি দেওয়া হয়েছে।
১৪ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশে বিনিয়োগের সুবর্ণ সুযোগ কাজে লাগাতে দক্ষিণ কোরিয়ার উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীদের আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)।
২১ ঘণ্টা আগেব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, অডিট টিমের তদন্ত শেষে অনিয়মের পূর্ণাঙ্গ চিত্র ও দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। একইসঙ্গে ব্যাংকের পক্ষ থেকে দুর্নীতি দমন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে যাতে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দ্রুত আইনী শাস্তিমুলক ব্যবস্হার মুখোমুখি করা যায়।
১ দিন আগেবাংলাদেশ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অথরিটি (বিপিপিএ) সরকারি ক্রয় বিষয়ে মন্ত্রণালয় পর্যায়ে সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং উচ্চ-পদস্থ নীতি নির্ধারণী কর্মকর্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছে।
২ দিন আগে