রুগ্ন স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ অপ্রতুল

আজাদুল আদনান
প্রকাশ : ০৩ জুন ২০২৫, ০৯: ১২

নীতিগত জটিলতায় বরাদ্দ অর্থের ব্যবহার করতে না পারা ও অব্যবস্থাপনার কারণে চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। চিকিৎসাসেবা কিনতে গিয়ে ১০০ টাকা ব্যয়ের ৭৪ টাকা চলে যাচ্ছে ব্যক্তির পকেট থেকে। স্বাভাবিকভাবেই জুলাই বিপ্লবের পর স্বাস্থ্যখাতের সংস্কার বিষয়ক কমিশন স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বাড়ানোর জোরালো সুপারিশ করেছিল।

কিন্তু বাস্তবে হয়েছে উল্টো। সামান্য পরিমাণে বাড়লেও স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ আগের মতো ৫ শতাংশের মধ্যেই রয়েছে। এমন বরাদ্দে রুগ্ন স্বাস্থ্যখাতে কোনো আশা দেখছেন না বিশেষজ্ঞরা।

বিজ্ঞাপন

তাঁরা বলেন, অতীত থেকে বর্তমান কোনো সরকারই স্বাস্থ্যখাতকে গুরুত্ব দেয়নি। বরাদ্দ বাড়লে তার লাভের গুড় গেছে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের পেটে। ফলে সরকারি হাসপাতালেই চিকিৎসা নিতে দরিদ্ররা আরো দরিদ্র হচ্ছেন। জনবান্ধব সরকার না হলে কখনোই এ অবস্থার পরিবর্তন হবে না বলেও মনে করেন স্বাস্থ্যখাতের বিশেষজ্ঞরা।

২০২৪-২৫ অর্থবছরে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ ছিল ৪১ হাজার ৪০৭ কোটি টাকা। যদিও সংশোধিত বাজেটে পরবর্তীতে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কমে এসেছিল। এবার ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ৪১ হাজার ৯০৮ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। যা চলতি বছরের চেয়ে মাত্র ৫০১ কোটি টাকা বেশি। যা মূল বাজেটের ৫ দশমিক ৩ শতাংশ।

গতকাল সোমবার উপস্থাপন করেন স্বাস্থ্য উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।

হাসপাতালের যন্ত্রপাতি আমদানিতে শুল্ক-কর হ্রাসের প্রস্তাব:

প্রস্তাবিত বাজেটে ৫০ শয্যার বেশি হাসপাতাল স্থাপনের জন্য যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম আমদানিতে শুল্ক-কর হ্রাসের প্রস্তাব করা হয়েছে। পাশাপাশি নার্সিং শিক্ষায় পিএইচডি কোর্স চালু এবং আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য একটি নার্স শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার বিষয়টি এসেছে বাজেটে। একই সঙ্গে ‘হাসপাতাল বেড উৎপাদনে ব্যবহৃত প্রয়োজনীয় উপকরণ ও খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানি ও স্থানীয়ভাবে ক্রয়ের ক্ষেত্রেও ২০৩০ সালের জুন পর্যন্ত শুল্ক-কর থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

ক্যানসার প্রতিরোধ ওষুধের কাঁচামালের দাম কমছে:

বাজেটে ক্যানসার প্রতিরোধক ওষুধসহ সব ধরনের ওষুধ শিল্পের কাঁচামাল আমদানি এবং এপিআই তৈরির কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক-কর অব্যাহতি সুবিধা সম্প্রসারণের প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে করে দাম কমবে ক্যানসারের ওষুধের।

একই সঙ্গে অন্যান্য ওষুধের কাঁচামাল (এপিআই) উৎপাদনের ক্ষেত্রে উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা বহাল রাখা হয়েছে। চলতি অর্থ বছর এই শুল্ক ১০ শতাংশ বলবদ রয়েছে। এ ছাড়াও সাধারণ ও আইসিইউ (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) অ্যাম্বুলেন্সস আমদানিতেও অব্যাহতির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।

তবে এই বরাদ্দ রুগ্ন স্বাস্থ্যখাতের কোনো পরিবর্তন ঘটাতে পারবে না বলে মনে করেন বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব। আমার দেশকে তিনি বলেন, সরকারি হাসপাতালে গরিব, মধ্যবিত্ত ও উচ্চ বিত্তরা যায়। বিত্তশালীরা তাদের পছন্দমতো চিকিৎসা নিতে পারলেও মধ্যবিত্ত ও দরিদ্ররা সেই সেবা পান না। চিকিৎসা নিতে গিয়ে তাদের নিঃস্ব হতে হয়। তাই, বরাদ্দ যাই দেওয়া হোক না কেন, রুগ্ন দশার কোনো পরিবর্তন হবেনা।

বিএমএ সাবেক সভাপতি বলেন, স্বাস্থ্যখাতের বরাদ্দ থেকে সামরিক বাহিনীতে চিকিৎসাবাবদ ব্যয় করা হয়। কিন্তু সেখানে যে মানের সেবা দেওয়া হয়, বেসামরিক জনসাধারণকে তা দেওয়া হয় না। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনগত কারণে যেসব রোগব্যাধির চিকিৎসা করা হয় সেই বরাদ্দও এখান থেকে যায়। সবকিছু মিলিয়ে এই বাজেটে নতুনত্ব বলতে কিছুই নেই। দরিদ্রদের চিকিৎসার বিষয়টি এবারও উপেক্ষিত থাকছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা অনুযায়ী স্বাস্থ্যখাতে মোট বাজেটের ১৫ শতাংশ রাখার বিষয়ে জোর সুপারিশ করেছিল অন্তর্বর্তী সরকারের স্বাস্থ্য সংস্কার বিষয়ক কমিশন। কিন্তু তারপরও বরাদ্দ ৫ শতাংশের ভেতরেই রয়েছে।

এ ব্যাপারে রশিদ-ই মাহবুব বলেন, ‘সংস্কার কমিশনে সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি নয়, সবাই ছিল ওপর তলার লোকের প্রতিনিধি। যার প্রভাব সহজেই বাজেটে পড়েছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বাস্থ্যখাতের সংস্কার না হলে কখনোই কিছু বদলাবেনা। এজন্য দরকার জনবান্ধব সরকার।

এদিকে চলতি অর্থবছরে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হলেও পরবর্তী সংশোধিত বাজেটে আকার এক-তৃতীয়াংশ কমে আসে। এছাড়া আরও ২০ শতাংশ অব্যহৃত থাকছে বলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। ফলে স্বাস্থ্যখাতের ব্যবহৃত অর্থ বরাদ্দের অর্ধেক।

এমতাবস্থায় প্রস্তাবিত স্বাস্থ্যখাতের বরাদ্দ সংশোধিত বাজেটে না কমানোর আহ্বান স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদদের। একই সঙ্গে যেসব জটিলতায় অর্থ অব্যবহৃত থাকছে সেসব সমস্যা দূর করতে এখনই ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তারা।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়িদ আব্দুল হামিদ বলেন, ‘প্রতিবছর প্রস্তাবিত বাজেটে যা থাকে পরে সংশোধিত বাজেটে কমানো হয়। গত বাজেটেও তাই হয়েছে। ফলে বরাদ্দ ৪১ কোটি টাকা থাকলেও মন্ত্রণালয় ব্যয় করতে পারছে সবোর্চ্চ ২০ থেকে ২১ হাজার কোটি টাকা। তাই সরকারের কাছে আহ্বান থাকবে এবার সংশোধিত বাজেটে যেন কোন বরাদ্দ কমানো না হয়।

তিনি বলেন, ‘প্রস্তাবিত বরাদ্দ যদি সঠিকভাবে কাজে লাগানো যায় তবে এখাতের আরো উন্নয়ন সম্ভব। এজন্য সরকারকে জানতে হবে কী কী কারণে, কোন কোন বাধায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় টাকা খরচ করতে পারছে না। ইডিসিএল, নিমিউ অ্যান্ড টিসি, অডিট, পলিসিসহ স্বাস্থ্যের সঙ্গে জড়িত সব বিভাগের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে হবে। এগুলো ঠিক করা গেলে আগামী বছর সহজেই বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি তোলা যাবে।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত