চলতি করবর্ষ (২০২৫-২৬) থেকে ব্যক্তি করদাতাদের জন্য অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এ সেবার প্রযুক্তিগত বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান সিনেসিস আইটি। তবে সংস্থাটির সঙ্গে এনবিআরের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক চুক্তি নেই। চুক্তিবিহীনভাবে এমন স্পর্শকাতর সেবা নেওয়ায় তথ্যের সুরক্ষার পাশাপাশি ভবিষ্যৎ আইনি জটিলতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
অনলাইন পদ্ধতিতে কোনো ধরনের হয়রানি ছাড়াই স্বল্প সময়ে ঘরে বসেই করদাতারা নিজেদের আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে পারছেন। এর ফলে দীর্ঘদিন ধরে চলা কর কর্মকর্তাদের হয়রানি, ঘুসবাণিজ্য বন্ধ হয়েছে। ফলে এনবিআরের এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন ব্যক্তি শ্রেণির করদাতারা। গত ৪ জুলাই অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ আনুষ্ঠানিকভাবে এ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন। তবে চুক্তি ছাড়া এ ধরনের কার্যক্রম চালু হওয়ায় সংশ্লিষ্ট অনেকে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) অনুদানে সিনেসিস আইটি অনলাইন রিটার্ন দাখিলের সফটওয়্যার তৈরি করে। ২০২১ থেকে ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ইইউ প্রতিষ্ঠানটিকে সেবামূল্য (সার্ভিস চার্জ) পরিশোধ করে। এরপর ইইউর পক্ষ থেকে কোনো ধরনের আর্থিক অনুদান না দেওয়া এবং দুই পক্ষকে (এনবিআর ও সিনেসিস আইটি) চুক্তিতে উপনীত হওয়ার জন্য বারবার তাগাদা দেওয়া হয়। তবে সে চুক্তি না হওয়ায় ওই বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত নিজেদের চুক্তির মেয়াদ বাড়ায় ইইউ। কোনো ধরনের আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে নাÑএমন শর্তেই অবশ্য ইইউ চুক্তির মেয়াদ বাড়ায়। এরপর প্রায় এক বছর পার হলেও চুক্তি সম্পন্ন হয়নি। এর মধ্যেই এনবিআর চুক্তিবিহীন অবস্থায় অনলাইন রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করে।
সিনেসিস আইটির সঙ্গে চুক্তি না থাকার বিষয়টি স্বীকার করে এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান আমার দেশকে বলেন, চুক্তির বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়া দীর্ঘ; টেন্ডার, যাচাই-বাছাই—সব অনুসরণ করতে হয়। এ বিষয়ে কমিটি কাজ করছে।
চুক্তি ছাড়া এ ধরনের সেবা গ্রহণে আইনগত কোনো জটিলতা বা তথ্যের নিরাপত্তা নিয়ে কোনো ধরনের সমস্যা হবে কি নাÑএমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি মনে করি না কোনো ধরনের জটিলতা তৈরি হবে। চুক্তি নেই; তবে চুক্তি হবে। হয়তো কিছুটা সময় লাগছে। তিনি আরো বলেন, প্রতিষ্ঠানটি (সিনেসিস আইটি) দেশি ও দায়িত্বশীল। সুতরাং এখানে ঝুঁকির কোনো ইস্যু নেই। তাছাড়া এনবিআরের নিজস্ব জনবলও ব্যাকওয়ার্ড নিরাপত্তায় কাজ করছে।
চুক্তি ছাড়া সেবাদানের বিষয়টি স্বীকার করে সিনেসিস আইটির চিফ সলিউশনস অফিসার আমিনুল বারি শুভ্র আমার দেশকে বলেন, আমরা বহুবার চুক্তির জন্য অনুরোধ করেছি; কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় বিলম্ব হচ্ছে। চুক্তি না থাকায় আমর আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছি। তবে করদাতার তথ্য নিরাপত্তা নিয়ে ঝুঁকি নেই।
সিনেসিসের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমার দেশকে বলেন, এক বছর ধরে আমরা এনবিআর সেবা দিচ্ছি। কিন্তু চুক্তি না থাকায় কোনো বিল পাচ্ছি না। এ কারণে আর্থিকভাবে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। এনবিআরের সফটওয়্যারের নিরাপত্তাসহ সার্বিক বিষয়গুলো দেখভাল করতে আমাদের জনবল নিয়োজিত রয়েছে এবং তাদের বেতন-ভাতা দিতে হচ্ছে। এক বছর যাবৎ কোনো ধরনের ফি ছাড়া সেবা প্রদান অব্যাহত রাখা একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য খুবই কঠিন। তারপরও একটি দেশি প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতার বিষয়টি প্রমাণ করার জন্য আমরা অনলাইন রিটার্ন দাখিলের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ সেবা দিয়ে আসছি। কিন্তু এভাবে খুব বেশিদিন আমাদের পক্ষে চালিয়ে যাওয়া কঠিন। চুক্তির জন্য আমরা বারবার তাগাদা দিলেও তাতে সাড়া মিলছে না। এভাবে চালাতে গিয়ে কোম্পানির রক্তক্ষরণ ঘটছে বলে মন্তব্য করেন ওই কর্মকর্তা।
এদিকে কোনো ধরনের চুক্তি ছাড়া অনলাইন রিটার্ন দাখিলের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ সেবা গ্রহণের বিষয়টি নিয়ে এনবিআর কর্মকর্তারাও বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা আমার দেশকে বলেন, দেশের সব করদাতার জন্য বাধ্যতামূলক একটি সেবার চুক্তি নেইÑএটি বিস্ময়কর। এতে ভবিষ্যতে আইনি জটিলতার ঝুঁকি রয়েছে।
এ বিষয়ে এনবিআর সদস্য (কর তথ্য ব্যবস্থাপনা ও সেবা) আবু হান্নান দেলওয়ার হোসেন বলেন, চুক্তির বিষয়টি প্রকিউরমেন্টের সঙ্গে জড়িত বিধায় এটা বোর্ড প্রশাসন দেখে থাকে। এ বিষয়ে আমার কোনো কিছু জানা নেই।
বোর্ড প্রশাসনের সদস্য খালিদ আহম্মেদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না। বোর্ডের সব কেনাকাটা আমার দায়িত্বের মধ্যে নেই। বিষয়টি কর বিভাগ জানতে পারে।
সদস্য (কর প্রশাসন ও মানবসম্পদ) জিএম আবুল কালাম কায়কোবাদ আমার দেশকে বলেন, এ বিষয়ে আমার কোনো কিছু জানা নেই; কোনো ধারণাও নেই। ফলে সিনেসিসের সঙ্গে চুক্তি নিয়ে একধরনের লুকোচুরি চলছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চুক্তি ছাড়া সেবা গ্রহণে ভবিষ্যতে আইনি জটিলতা তৈরি হতে পারেÑএমন আশঙ্কায় কর্মকর্তারা দায় এড়ানোর চেষ্টা করছেন। চুক্তির বিষয়ে চেয়ারম্যানের পক্ষ থেকে বারবার তাগাদা দেওয়া হলেও কর্মকর্তারা নানাভাবে সময়ক্ষেপণ করছেন। এ কারণে প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও চুক্তি সম্পন্ন হচ্ছে না।
সূত্র জানায়, ২০১৩ সালে অনলাইন রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে ব্যক্তি করদাতার ইউনিক ট্যাক্স পেয়ার্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (টিন) পদ্ধতি চালু করে এনবিআর। বিশ্বব্যাংক গ্রুপের আইএফসির (ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন) অর্থায়নে সিনেসিস আইটি এটি বাস্তবায়ন করে। বর্তমানেও এ সেবাটি দিয়ে আসছে সিসেসিস। প্রত্যেক করদাতার টিন থাকা বাধ্যতামূলক।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১১ সালে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে অনলাইনে রিটার্ন দাখিলে ৭৮ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প নেয় এনবিআর। এটি বাস্তবায়নের কাজ পায় ভিয়েতনামের প্রতিষ্ঠান এফপিটি ইনফরমেশন সিস্টেম। দুবছরের মধ্যে ওই প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা থাকলেও দফায় দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে তা ২০১৯ সালে গিয়ে পৌঁছায়। ভিয়েতনামের ওই কোম্পানির তৈরি সফটওয়্যারটিতে করদাতার ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ডের জন্য স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা ছিল না এবং পেমেন্ট সিস্টেমও অনলাইনভিত্তিক না হওয়ায় বিপুল অর্থ ব্যয়ের ওই প্রকল্পে কোনো সুফল মেলেনি। এই সফটওয়্যারের মাধ্যমে ছয় হাজারের মতো আয়করদাতা তাদের রিটার্ন জমা দেন। সফটওয়্যারটি এনবিআরকে বুঝিয়ে না দিলেও ভিয়েতনামের ওই প্রতিষ্ঠানটিকে পুরো অর্থই পরিশোধ করা হয়। এর মধ্যে ২০২০ সালে করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ায় অনলাইনে রিটার্ন জমা দেওয়ার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তখন ভিয়েতনামের ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করে সিস্টেম আপগ্রেডেশনে এনবিআরের পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হয়। তারা এর জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ দাবি করে বসে। ফলে এই আলোচনা আর এগোয়নি। এ অবস্থায় টিন পদ্ধতি সফলভাবে বাস্তবায়ন করায় এনবিআরের পক্ষ থেকে সিনেসিসের সঙ্গে যোগাযোগ করে অনলাইন রিটার্ন দাখিলে মডিউল তৈরির জন্য অনুরোধ জানানো হয়।
সিনেসিস আইটির কর্মকর্তারা জানান, তারা বিনা খরচে চার মাসের মধ্যে সফটওয়্যারটি তৈরি করেন। আয়কর কর্মকর্তাদের ছয় সদস্যের একটি টিম আয়কর আইন, আয়কর হিসাবসহ বিভিন্ন জটিল বিষয় সমাধানে নিরলস কাজ করেছেন। তাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এটি সফলভাবে সম্পন্ন হয়। ২০২১ সালে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রেও তারা কাজটি পায়।
চলতি করবর্ষে সব করদাতার রিটার্ন অনলাইনে দাখিল বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তবে পাঁচ শ্রেণির করদাতাকে অনলাইনে রিটার্ন দেওয়া থেকে ছাড় দেওয়া হয়েছে। তারা হলেন ৬৫ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সের করদাতা, শারীরিকভাবে অসমর্থ বা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন করদাতা (সনদ দাখিলসাপেক্ষে), বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি করদাতা, মৃত করদাতার পক্ষে আইনগত প্রতিনিধি এবং বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি নাগরিক। তবে তারা চাইলে অনলাইনে রিটার্ন দাখিল করতে পারবেন।
এনবিআরের তথ্যানুযায়ী, এখন পর্যন্ত ২২ লাখের বেশি ব্যক্তি আয়করদাতা অনলাইনে তাদের রিটার্ন জমা দিয়েছেন। আয়কর আইন অনুযায়ী রিটার্ন জমা দেওয়ার শেষদিন ছিল ৩০ নভেম্বর। তবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সময় বাড়ানোর আবেদনের প্রেক্ষিতে তা ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

