বালাইনাশকের কাঁচামাল আমদানিতে শূন্য শুল্ক প্রতিশ্রুতিতেই সীমাবদ্ধ

বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশ : ২৪ আগস্ট ২০২৫, ১০: ২২
আপডেট : ২৪ আগস্ট ২০২৫, ১৪: ৪৩
ছবি: সংগৃহীত

চলতি অর্থবছরের বাজেট বক্তব্যে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ কৃষি খাতে ব্যবহৃত কীটনাশকের কাঁচামাল আমদানিতে সব ধরনের শুল্ক ও কর প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি দিলেও এখনো সেটি বাস্তবায়ন হয়নি। অথচ দেশের কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা এবং কৃষিপণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধির স্বার্থে বিষয়টি জরুরি। যদিও আগামীকাল সোমবার এ সংক্রান্ত একটি বৈঠক ডেকেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।

বিজ্ঞাপন

বৈঠকে কীটনাশক উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় এক্সিপিয়েন্ট বা সহায়ক উপাদানে আরোপিত শুল্ক ও কর যৌক্তিকীকরণ এবং স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যের সুরক্ষা বিষয়ে আলোচনা হবে বলে জানা গেছে। এর আগেও ২০২১ সালের ১৬ নভেম্বর কৃষি মন্ত্রণালয় বালাইনাশকের কাঁচামালের ওপর শুল্ক শূন্য করার অনুরোধ জানিয়ে রাজস্ব বোর্ডে চিঠি দিয়েছিল। কিন্তু সেটির কোনো বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে একদিকে দেশীয় শিল্প বিকাশে বাধা তৈরি হচ্ছে, অন্যদিকে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর একচেটিয়া বাজার গড়ে উঠছে।

বাংলাদেশ এগ্রোকেমিক্যাল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, দেশে বর্তমানে কৃষক পর্যায়ে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য অনুযায়ী বছরে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার এক লাখ টন বালাইনাশকের বাজার রয়েছে। যার প্রায় ৯৫ শতাংশ বাজারই আমদানিনির্ভর। আমদানিকারকরা যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার ফিনিশড পণ্য আমদানি করছেন, সিন্ডিকেট চক্র না থাকলে ও অতি মুনাফা বন্ধ হলে প্রকৃতপক্ষে সমপরিমাণ কীটনাশক আমদানি সম্ভব সাত থেকে আট হাজার কোটি টাকায়। সেই সঙ্গে কাঁচামাল ও সহযোগী পণ্য আমদানিতে বাড়তি শুল্ক তুলে নিয়ে স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করলে একই পরিমাণ বালাইনাশক কৃষকের হাতে পৌঁছাতে ব্যয় হবে মাত্র তিন থেকে চার হাজার কোটি টাকায়। সংগঠনের সভাপতি কেএসএম মোস্তাফিজুর রহমান আমার দেশকে বলেন, বালাইনাশকের পুরো বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে হাতেগোনা কয়েকটি দেশি ও বহুজাতিক কোম্পানি। তাদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে দেশের খাদ্যনিরাপত্তা।

কৃষি উপকরণের কাঁচামাল আমদানি ও ফিনিন্ড পণ্য আমদানিতে শুল্ক বৈষম্য দীর্ঘদিনের জানিয়ে তিনি জানান, কাঁচামাল ও সহযোগী কাঁচামাল আমদানিতে প্রায় ৫৮ শতাংশ শুল্ক দিতে হয় স্থানীয় শিল্প উদ্যোক্তাদের। অথচ বিদেশ থেকে মাত্র ১০ শতাংশ শুল্ক দিয়ে ফিনিন্ড পণ্য আমদানি হচ্ছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বর্তমানে এক হাজার ৩৮০ জন আমদানিকারক রয়েছেন বালাইনাশকের জন্য। তবে এনবিআর জানিয়েছে সর্বশেষ গত অর্থবছরে মাত্র ২১১ জন আমদানিকারক পণ্য আমদানি করেছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমদানিতে সক্রিয় না থাকলেও শত শত আমদানিকারক বিভিন্নভাবে বালাইনাশক নিজেদের প্রতিষ্ঠানের মোড়কে বাজারজাত করছে, যা সম্পূর্ণ অবৈধ। মূলত বহুজাতিক ও স্থানীয় কয়েকটি কোম্পানির আমদানি ফিনিন্ড পণ্যে আমদানি মূল্যের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি দামে কৃষকের কাছে বিক্রি করছে একটি সিন্ডিকেট চক্র।

পেস্টিসাইড টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজরি কমিটি (পিটাক) এ অবস্থার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ২০১৪ সালের পর থেকে পিটাকের সিদ্ধান্তে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর জন্য একের পর এক সুযোগ তৈরি হলেও দেশীয় প্রতিষ্ঠানের জন্য এসেছে নানামুখী শর্ত।

বর্তমানে দেশে ২২টি দেশীয় কোম্পানি কীটনাশক উৎপাদনে আগ্রহী থাকলেও তারা নিয়মগতভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে সাতটি বহুজাতিক কোম্পানি প্রায় ৪০ শতাংশ বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। দেশীয় কোম্পানিগুলো সোর্স পরিবর্তনের সুযোগ না পাওয়ায় আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায়ও টিকতে পারছে না। অথচ একই নিয়মে চলতে থাকা বিদেশি কোম্পানিগুলো বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে তুলনামূলক কম দামে কাঁচামাল সংগ্রহ করতে পারছে।

সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড পিস স্টাডিজের (সিএসপিএস) নির্বাহী পরিচালক কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. মিজানুর রহমান আমার দেশকে বলেন, দেশে প্রায় ৮০০-এর বেশি কীটপতঙ্গ, ৮৩০-এর বেশি রোগজীবাণু ও ১৭০টি আগাছা চিহ্নিত হয়েছে। এই বালাই নিয়ন্ত্রণে পেস্টিসাইডের ব্যবহার জরুরি হলেও তা যেন কৃষকের জন্য সাশ্রয়ী ও নিরাপদ হয়, সেটি নিশ্চিত করাও জরুরি। তিনি বলেন, ফিনিশড পণ্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে কাঁচামাল আমদানির শুল্কমুক্ত সুবিধা দিলে কৃষকের কাছে পেস্টিসাইডের দাম কমপক্ষে ৫৫ শতাংশ কমে যেত। পাশাপাশি দেশীয় শিল্পের বিকাশ হতো, কর্মসংস্থান বাড়ত এবং বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হতো।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত