পদ্মা সেতুর ধাক্কায় সদরঘাটের লঞ্চ ব্যবসায় ধস

প্রতিনিধি, জবি
প্রকাশ : ২৬ জুন ২০২৫, ১৪: ২৬

ঢাকার একমাত্র নদীবন্দর সদরঘাট, যেখানে প্রতিদিন হাজারো মানুষের গন্তব্য ছিল দক্ষিণাঞ্চলের দিকে। কুলিদের হাঁকডাক, লঞ্চের সাইরেন আর যাত্রীর ভিড়ে সরব ছিল এই ঘাট। পদ্মা সেতু চালুর পর সেই চিত্র বদলে গেছে রাতারাতি। কমে গেছে রুট, লঞ্চ আর যাত্রী। একসময় যেখানে প্রতিদিন ৯০ থেকে ৯৫টি লঞ্চ ছেড়ে যেত, এখন তা নেমে এসেছে ৬০-৬৫টিতে।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) জানায়, একসময় সদরঘাট থেকে দক্ষিণাঞ্চলের ৪৩টি নৌরুটে চলত প্রায় ২২০টি লঞ্চ। বর্তমানে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩৭ রুটে, আর লঞ্চ চলছে ১৭০টি।

বিজ্ঞাপন

পদ্মা সেতুর ফলে দক্ষিণাঞ্চলের যাত্রীরা সড়কপথে স্বল্প খরচ ও কম সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারছেন। ফলে জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে লঞ্চযাত্রা। আর তাতে সবচেয়ে বেশি ধাক্কা খেয়েছে সদরঘাট।

বিআইডব্লিউটিএ’র সদরঘাট ট্রাফিক ইনচার্জ হুমায়ুন কবির বলেন, “পদ্মাসেতুর প্রভাবে নৌরুট কমেছে ৬টি। বরিশাল বেল্টেই রুট কমেছে ৫টি। তরকি, মাদারীপুর, পাতাবুনিয়া, ঘুমা, তুষখালী, দেওয়ানবাড়ী—এসব রুটে লঞ্চ চলাচল একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে।”

তিনি আরও বলেন, “পদ্মা সেতুর আগে বরিশালে প্রতিদিন ৮টি লঞ্চ চলত, এখন চলছে মাত্র ২টি। পটুয়াখালীতে ৫টি লঞ্চ চললেও এখন চলছে ২টি, বরগুনায় ৪টি থেকে নেমে এসেছে ১টিতে।”

লঞ্চ মালিকদের তথ্য মতে, বর্তমানে প্রতি লিটার ডিজেলের দাম ১১৫ টাকা। একেকটি ট্রিপে (যাওয়া-আসা) খরচ পড়ে গড়ে পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকা। অথচ যাত্রী সংকটের কারণে ট্রিপপ্রতি হচ্ছে বড় ধরনের লোকসান।

সুন্দরবন লঞ্চ সার্ভিসের এক কোয়ার্টার মাস্টার বলেন, “এখন ডাল সিজন। যাত্রী নেই বললেই চলে। আগে সদরঘাটে তিল ধারণের জায়গা থাকত না, এখন লঞ্চ ফাঁকা নিয়েই ঘাট ছাড়ে।”

ট্রিপ কমে যাওয়ায় লঞ্চের কর্মচারীদের অনেকে চাকরি হারাচ্ছেন। কেউ কাজ নিয়েছেন বাল্কহেডে, কেউবা অয়েল ট্যাংকার বা বালুবাহী কার্গোতে।

ট্রাফিক ইনচার্জ হুমায়ুন কবির বলেন, “নৌখাত টিকিয়ে রাখতে বিকল্প জ্বালানির চিন্তা করতে হবে। ভারতের মতো সোলার প্যানেলচালিত লঞ্চ চালু করলে হয়তো এ খাতটা আবার ঘুরে দাঁড়াবে।”

লঞ্চ মালিক সমিতির হিসাবরক্ষক মো. হান্নান খান বলেন, “ঢাকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সদরঘাট আসতে যানজটে যাত্রীদের অনেক সময় লেগে যায়। গুলিস্তান থেকে সদরঘাট সড়কে অবৈধ হকারি দোকানের কারণে তীব্র যানজট থাকে। যাত্রীরা এই ভোগান্তি সহ্য না করে বাসে যাতায়াত করে। তাই আমাদের দাবি, সদরঘাটকে মেট্রোরেল প্রকল্পে যুক্ত করে যাত্রীদের ভোগান্তি দূর করা। অথবা সরকারকে পুরান ঢাকার যানজট কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে।”

তিনি আরও বলেন, “সদরঘাটে এসেও যাত্রীরা বিরক্ত হন। এখানকার কুলিরা মাল পরিবহনের বিনিময়ে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করে, যাত্রীদের হেনস্তা করে। আসলে কুলিদেরও উপায় নেই। সরকার ইজারা দিয়ে কুলি হাট বিক্রি করে। তাই আমরা সরকারের কাছে ইজারা প্রথা বাতিলের দাবি জানাই। হয়রানি ও ভোগান্তি কমলে যাত্রীরা লঞ্চে যাতায়াত করবে, এতে যাত্রীও বাড়বে।

লঞ্চ মালিকরা মনে করছেন, এই সংকট নিরসনে দরকার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও বাস্তবমুখী পদক্ষেপ। তা না হলে দেশের নদীপথভিত্তিক যাতায়াত ব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়বে। সদরঘাট হারাবে তার ঐতিহ্য ও প্রাণচাঞ্চল্য।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত