ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজ

ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মোবাশ্বেরের বিরুদ্ধে পাহাড়সম অভিযোগ

রাফিউজ্জামান লাবীব, ঢাবি
প্রকাশ : ২৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১৮: ০২
আপডেট : ২৬ জানুয়ারি ২০২৫, ২০: ৪৯

প্রাতিষ্ঠানিক কাগজপত্র জালিয়াতি ও গোপন করা, লেজুড়বৃত্তি ও ধরণা দিয়ে পদোন্নতি পাওয়া, বৈদেশিক সনদপত্র গোপন করা ও ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের সাথে সখ্যতা করে স্বার্থ হাসিলসহ প্রাতিষ্ঠানিক নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে রাজধানী ঢাকার ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ও রসায়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোবাশ্বের হোসেনের বিরুদ্ধে।

বিজ্ঞাপন

কলেজটির একদল শিক্ষক তার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ করেন। নথিপত্র জালিয়াতি, বৈদেশিক সনদপত্র গোপনসহ অন্যায়-অনিয়মের সকল কাগজপত্র আমার দেশ-এর হাতে এসেছে।

এসব অনুসন্ধান করে জানা যায়, কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পদে যোগদান থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধাপে নিজের পদ পাকাপোক্ত করতে অন্যায় ও জালিয়াতির আশ্রয় নেন তিনি। এছাড়াও ভারতীয় নাগরিকত্ব ও সনদের বিষয়ে কলেজের বিভিন্ন সভায় একাধিকবার প্রশ্ন উঠলেও সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে ব্যর্থ হন।

এ বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে গভীর অনুসন্ধান ও তদন্তের দাবি জানিয়েছেন অভিযোগকারী শিক্ষকরা।

'আমার দেশে'র হাতে আসা নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, গত বছরের ১ এপ্রিল মোবাশ্বের হোসেন কলেজটির ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্বে যোগদান করেন। এর আগে ওই বছরের ৩১ জানুয়ারি কলেজের এডহক কমিটির সভায় মোবাশ্বের হোসেনকে কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ করার জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পত্রপ্রেরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১০ মার্চ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় মোবাশ্বের হোসেনকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দিয়ে একটি চিঠি পাঠায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। যদিও সেই চিঠিতে কলেজ প্রেরিত পত্রের কোনো সূত্র উল্লেখ ছিলো না।

অভিযোগ রয়েছে কলেজের এডহক কমিটির তৎকালীন সভাপতি নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুকে কাজে লাগিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উক্ত চিঠিটি তৈরি করে আনা হয়।

পরবর্তী সময়ে ১৪ মার্চ এডহক কমিটির সভায় মোবাশ্বের হোসেনের বিদেশী অ্যাকাডেমিক সনদ ও নাগরিকতার বৈধতা বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য ও ব্যাখ্যা জানতে মোবাশ্বের হোসেনকে চিঠি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও নাসিরউদ্দিন ইউসুফ (বাচ্চু) কৌশলে সেটি বাধা দেন।

এবিষয়ে নাসিরউদ্দিন ইউসুফ (বাচ্চু) বলেন, আমি আইনানুসারে কাজ করেছি। মোবাশ্বের হোসনের বিষয়ে আমার একক কোনো সিদ্ধান্ত ছিলো না। মিটিংয়ে আলোচনার মাধ্যমে সকল সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

এই বিষয়ে কলেজে ২৫ মার্চ এডহক কমিটির আরেকটি সভায় কলেজের এডহক কমিটির তৎকালীন শিক্ষক প্রতিনিধি ও কলেজটির কম্পিউটার সায়েন্স ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রভাষক মো. নূর আল মারুফ নেওয়াজ 'নোট অব ডিসেন্ট' দেন। এসময় মোবাশ্বের হোসেনেকে সনদপত্র ও নাগরিকত্ব নিয়ে কোনো আইনগত জটিলতা তৈরি হলে তার দায় নিজেকে নিতে হবে মর্মে এক 'অঙ্গিকারনামা'য় স্বাক্ষর করে ১ এপ্রিল থেকে 'পরবর্তী ছয়মাসে'র জন্য ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

এখানে মোবাশ্বের জালিয়াতির আশ্রয় নেন। অঙ্গিকারনামাটি 'স্ট্যাম্প'-এ হওয়ার কথা থাকলেও তিনি 'সাদা কাগজে' ২৬ মার্চ সেই অঙ্গিকারনামায় স্বাক্ষর করেন। এক্ষেত্রেও কমিটির বাকি সদস্যদের সহযোগিতা পেয়েছেন বলে দাবি শিক্ষক প্রতিনিধি মারুফ নেওয়াজের।

তবে এবিষয়ে মোবাশ্বের হোসেন বলেন, তৎকালীন কমিটি আমার কাছে স্ট্যাম্পে অঙ্গিকারনামা চায়নি বা এবিষয়ে কিছু বলেনি। আমি যেভাবে জমা দিয়েছি সেভাবেই তারা নিয়েছেন।

পরে ২৭ মার্চ কলেজ এডহক কমিটির ২৫ তারিখের সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১ এপ্রিল থেকে পরবর্তী ছয়মাসের জন্য মোবাশ্বের হোসেনেকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব প্রদানের নিয়োগপত্র ইস্যু করে।

তবে এপ্রিলের ৩ তারিখে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পদে যোগদানের পরে ২৭ মার্চের নিয়োগপত্রকে একই স্মারক ও স্বাক্ষর একই রেখে 'ছয়মাসে'র পরিবর্তে 'পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত' এবং ২৫ মার্চের সভার সিন্ধান্তের পরিবর্তে '৩১ জানুয়ারির সভার সিদ্ধান্তে'র কথা উল্লেখ করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছেন মোবাশ্বের।

জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়লে ৩০ এপ্রিলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কলেজ পরিদর্শক ফাহিমা সুলতানা স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে '১ এপ্রিল থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পদে দায়িত্বভার গ্রহণের' বিষয়টি বিধিসম্মত না হওয়ায় ওই চিঠিটি বাতিলের জন্য বলা হয়। তবে রেজ্যুলেশনে এই চিঠিটি গোপনের অভিযোগ রয়েছে মোবাশ্বের ও নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর বিরুদ্ধে।

এবিষয়ে মোবাশ্বের হোসেন বলেন, আমি কলেজের অন্য আরেকজনকে দিয়ে টাইপ করিয়ে নিয়েছি, তাই 'ছয়মাসের' পরিবর্তে 'পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত' কথাটি ‘ভুলক্রমে’ লেখা হয়েছে। তবে এই চিঠিটিতে নাসিরউদ্দিন ইউসুফের স্বাক্ষর নিয়েছিলেন তিনি।

বিষয়টি স্বীকার করে নাসিরুদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, একটা ভুল হয়েছে, উনি যখন ছয় মাস থেকে এক বছর করাবার জন্য আমার কাছে আসেন তখন আমি ‘সম্ভবত’ উনার একটা কাগজে সই করেছি যেটা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে যায় এবং উনার চাকরি অনির্দিষ্টকাল থেকে এক বছর হয়ে যায়।

জালিয়াতি করা নিয়োগপত্র ব্যবহার ও ২৫ মার্চের এডহক কমিটির সভার রেজ্যুলেশন গোপন করে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগের বিষয়ে ২৪ এপ্রিল মোবাশ্বেরের বিরুদ্ধে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিযোগ করেন ওেই কলেজের শিক্ষক প্রতিনিধি মারুফ নেওয়াজ।

এবিষয়ে নেওয়াজ বলেন, নানা অসঙ্গতির কারণে আমি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে মোবাশ্বের হোসেনের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করি। এরফলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এডহক কমিটির সভাপতিকে জালিয়াতি করা নিয়োগপত্রটি বাতিলের ব্যবস্থা নিতে বলে। তবে সেই চিঠিটি গোপন করে রাখা হয় বলেও অভিযোগ করেন নেওয়াজ।

এদিকে ২৮ মে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে ১ এপ্রিল ২০২৪ থেকে 'পরবর্তী ছয়মাস' দায়িত্ব পালন করতে পারবেন মর্মে মোবাশ্বের হোসেনকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরেকটি চিটিতে জানানো হয়। এই চিঠিটিও কলেজ থেকে গোপন করা হয় বলে অভিযোগ করেন মারুফ আল নেওয়াজ।

এদিকে নথিপত্রে জালিয়াতি চলমান থাকলেও ২২ সেপ্টেম্বর কলেজের নতুন এডহক কমিটির প্রথম সভায় মোবাশ্বের হোসেন তার সম্পর্কে বিতর্কিত বিষয়গুলোর ব্যাখ্যা দেন। সার্বিক দিক পর্যালোচনা করে সেই কমিটি মোবাশ্বের হোসেনের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের মেয়াদ ৬০ বছর পূর্তি পর্যন্ত বৃদ্ধির পক্ষে একমত হন। সেসময় কমিটির বিদ্যুৎসাহী সদস্য সরদার তমিজ উদ্দিন মোবাশ্বেরের জন্য জোর প্রচেষ্টা চালান বলে অভিযোগ রয়েছে। পরে ৭ অক্টোবর এডহক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ড. এস এম মোস্তফা আল মামুন স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে তাকে আগামী ১৬ মার্চ পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পদে রাখার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়৷

এবিষয়ে মোস্তফা আল মামুন বলেন, সভায় মোবাশ্বের হোসেন তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো খণ্ডন করেন। এছাড়াও তার ৬০ বছর পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পদে বহাল থাকার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় সভায়।

নথিপত্র ঘেঁটে আরো দেখা যায়, ২০০২ সালের ১ জুলাই তিনি ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজে রসায়ন বিভাগের প্রভাষক পদে যোগদান করেন। পরে সেবছরের ২১ আগস্ট এমপিওভুক্তির সময়ে নথিপত্র জমা দেওয়ার সময় শিক্ষাগত সনদের বিষয়টি না আনলেও পরে সেই একই আবেদনপত্রে কলম দিয়ে সনদের বিষয়টি উল্লেখ করেন। এখানে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা ভারতে দিলেও লেখার সময় বাংলাদেশি 'এসএসসি' ও 'এইচএসসি' উল্লেখ করেন।

সেসময়কার কলেজটির অধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. শামসুল আলমের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, প্রতিটি কলেজে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিয়োগ বোর্ড দেয়া হয়। সেসময়ে নিয়োগ বোর্ড তার কাগজপত্র দেখেশুনে নিয়োগ দিয়েছে।

এছাড়াও তিনি ২০১৩ সালে প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পান। ২০২০ সালে সহকারী অধ্যাপক থেকে 'স্কুলে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা' ও 'মানবিক বিবেচনায়' সহযোগী অধ্যাপকে পদোন্নতি পান। এসময় কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন মো. জসিম উদ্দীন আহম্মেদ। এ বিষয়ে তিনি বলেন, সেসময় আওয়ামীলীগের প্রভাব খাটিয়ে মোবাশ্বের হোসেন পদোন্নতি পান। যদিও আমি বাঁধা দিয়েছিলাম।

তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে সখ্যতা করে ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের বিষয়ে মোবাশ্বের হোসেন বলেন, আমি আওয়ামী লীগকে ঘৃণা করি। আমি কখনো লিয়াঁজু করে পদ বাগিয়ে নেইনি। কমিটি আমাকে পছন্দ করেছে তাই এ পদে রেখেছে। আগস্টের পরে কলেজের নতুন কমিটি হয়েছে। আমার অসংগতি থাকলে তো সেসময়ই আমাকে বের করে দিতো। জালিয়াতি করলে আবার উল্টো মেয়াদ বাড়াবে কেন - এমন প্রশ্ন করেন মোবাশ্বের।

তবে মোবাশ্বের হোসেনের বিরুদ্ধে নথিপত্র জালিয়াতি ও গোপন করা এবং আওয়ামী সংশ্লিষ্টতার গভীর তদন্তের দাবি করেছেন কলেজটির কিছু শিক্ষক। এবিষয়ে ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক রাজু আহম্মেদ বলেন, উনার বিরুদ্ধে নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। কারণ, উনি জালিয়াতি ও ধরণা দিয়ে পদ টিকিয়ে রাখতে ব্যস্ত। ভারতীয় নাগরিকতা ও পড়াশোনা ঢাকতেই উনি বিভিন্ন সময়ে জালিয়াতির আশ্রয় নেন।

ফিন্যান্স ব্যাংকিং ও বিমা বিভাগের প্রভাষক সাদিয়া সিদ্দিকা সিমি বলেন, কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ যেভাবে কলেজের প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করছেন এতে কলেজের দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির আশঙ্কা করছি। উনার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ উঠলে সেটা ভুল বা সঠিক হোক তা নিয়ে অবশ্যই তদন্ত হওয়া উচিত।

এমএস

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত