অনিশ্চয়তায় দুই সিটির ১৯ গরুর হাটের ইজারা

মাহমুদা ডলি
প্রকাশ : ২৬ মে ২০২৫, ০৯: ৩১

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) আন্দোলন কর্মসূচি ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে (ডিএনসিসি) রাজনৈতিক দলগুলোর তদবিরবাণিজ্য, অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে গরুর ১৯টি হাটের ইজারা নিয়ে সম্পূর্ণ অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।

অনিয়ম, দুর্নীতি ও দখলের অভিযোগে উত্তর সিটিতে আগের আহ্বান করা দরপত্র সম্পূর্ণ বাতিল করে ফের দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। আজ সোমবার দরপত্র আহ্বান করে আজকেই তা চূড়ান্ত করতে বলা হয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে।

বিজ্ঞাপন

চাঁদ দেখাসাপেক্ষে আগামী ৭ জুন পবিত্র ঈদুল আজহা। কিন্তু রাজধানীতে এখন পর্যন্ত ১৮টি হাটের মধ্যে ১৩টির ইজারা এখনো চূড়ান্ত করা সম্ভব হয়নি। বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে মেয়র পদে বসানো নিয়ে গত ১৪ মে থেকে ডিএসসিসির কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। আর ডিএনসিসিতে চলছে প্রশাসকের সঙ্গে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরোধ। এই অস্বস্তিতে গত সপ্তাহের পুরোটাই অফিসে অনুপস্থিত ছিলেন প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ।

আগ্রহী ইজারাদাররা বলছেন, অন্যান্য বছর ঈদের অন্তত ২০ দিন আগেই ইজারাদার চূড়ান্ত হয়ে যেত। কিন্তু এবার সব হাটের দরপত্র জমা দেওয়ার সময়ই শেষ হয়নি।

তারা বলছেন, হাট বসাতে গেলে ইজারাদারের অনেক প্রস্তুতির প্রয়োজন। হাটের অবকাঠামো তৈরি, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে হাটে পশু আনতে উদ্বুদ্ধ করা, ক্রেতাদের মধ্যে প্রচার চালানো, জনবল প্রস্তুত, ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমসহ অনেক বিষয় থাকে। অথচ আজও কয়েকটি হাটের দরপত্র জমাদানের শেষ সময় নির্ধারণ করা আছে। এ অবস্থায় নগরবাসীও কোন হাট থেকে কোরবানির পশু কিনবেন- তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েছেন।

এবার ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে রাজধানীর ১১টি স্থানে অস্থায়ী পশুর হাট বসানোর জন্য গত ২১ এপ্রিল বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিল ডিএসসিসি। আর গত ২৯ এপ্রিল ১০টি স্থানে অস্থায়ী পশুর হাটের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেয় ডিএনসিসি। ইতোমধ্যে ডিএসসিসির আফতাবনগর ও মেরাদিয়া পশুর হাটটি জনবহুল স্থানে হওয়ায় আদালত বাতিল করে দিয়েছে। আর ডিএনসিসির বাড্ডা ইস্টার্ন হাউজিং ও খিলক্ষেত বনরূপা আবাসিক এলাকার হাট দুটিও স্থগিত করেছে আদালত। গত শনিবার নতুন করে ৪৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাঁচকুড়া বাজার-সংলগ্ন রহমাননগর আবাসিক এলাকার খালি জায়গায় অস্থায়ী হাট বসাতে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে।

ডিএসসিসি সূত্র জানায়, তাদের ৯টির মধ্যে ৫টি হাটের ইজারাদার চূড়ান্ত করতে পেরেছে; কিন্তু তাদের চূড়ান্ত কার্যাদেশ দেওয়া হয়নি। অন্য ৪টি হাটের ক্ষেত্রে দুই দফায় পুনঃদরপত্র আহ্বান করেও সেগুলোর ইজারাদার চূড়ান্ত করতে পারেনি। তৃতীয় পর্যায়ের পুনঃদরপত্র প্রকাশের সর্বশেষ সময়সীমা গত বৃহস্পতিবার অতিবাহিত হয়েছে। চতুর্থবার যে পুনরায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করবে, অচলাবস্থার কারণে সেটাও সম্ভব হয়নি। এ চারটি হাটের মধ্যে রয়েছে দনিয়া কলেজের পূর্ব পাশ ও সনটেক মহিলা মাদরাসার পূর্ব পাশের খালি জায়গা, সাদেক হোসেন খোকা মাঠের দক্ষিণ পাশের খালি জায়গা ও ধোলাইখাল ট্রাক টার্মিনাল হাট, ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাবের দক্ষিণ-পূর্ব পাশের খালি জায়গা এবং শ্যামপুর-কদমতলী ট্রাকস্ট্যান্ড-সংলগ্ন খালি জায়গা। কোরবানি ঈদের সময় এগিয়ে এলেও এ চারটি হাটের ইজারা ঝুলে আছে।

জানা গেছে, ৯টি হাটের মধ্যে মাত্র দুটি হাটের ইজারা কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়েছে। এ দুটি হাট হলো ঢাকা পলিটেকনিক খেলার মাঠ ও খিলক্ষেত মস্তুল চেকপোস্ট-সংলগ্ন খালি জায়গা। বাকি সাতটি হাটের ইজারাদার এখনো চূড়ান্ত করা যায়নি।

মিরপুর কালশী মাঠের খালি জায়গার হাটটিতে একটি দরপত্র বিক্রি হলেও সেটা জমা পড়েনি। মিরপুর সেকশন ৬-এর ইস্টার্ন হাউজিংয়ের হাটটিতে দুটি শীর্ষ দরদাতা প্রতিষ্ঠানই সমান ইজারামূল্য দাখিল করে। এ জন্য পুনরায় দরপত্রে যায় ডিএনসিসি। বাকি চারটি হাটের বিপরীতে যে দর পড়েছিল, তা সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়েও কম।

গত শনিবার ডিএনসিসি নতুন করে ৪৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাঁচকুড়া বাজার-সংলগ্ন রহমাননগর আবাসিক এলাকার খালি জায়গায় অস্থায়ী হাট বসাতে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। ডিএনসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মোহাম্মদ শওকত ওসমান বলেন, ‘কোরবানির পশুর হাটে প্রথম পর্যায়ে দু্‌টি হাটে ইজারাদার নির্ধারণ করা হয়েছে। বনরূপা আবাসিক এলাকার হাটটিতে আদালত নতুন করে স্থগিতাদেশ দেওয়ায় সেটির কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে। আর বাকিগুলো আগামীকাল সোমবার (আজ) দ্বিতীয় পর্যায়ের ইজারার জন্য বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে।’

গাবতলীর স্থায়ী পশুর হাটেও ইজারা নিয়ে জটিলতা

রাজধানীর একমাত্র গাবতলী স্থায়ী পশুর হাটের ইজারা নিয়েও চলছে নানা জটিলতা। গত ৩ মার্চ দরপত্র বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার পর এই হাটের বিপরীতে সর্বোচ্চ দর সোয়া ২২ কোটি টাকা দাখিল করেছিল মেসার্স আরাত মোটরস নামে একটি প্রতিষ্ঠান, যা নির্ধারিত দরের চেয়ে সাত কোটি টাকা বেশি। সঙ্গে আরো ২৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর এবং আয়কর (ভ্যাট ও আইটি) রাজস্ব খাতে যুক্ত হতো। কিন্তু সর্বোচ্চ দরদাতাকে হাটের ইজারা না দিয়ে ডিএনসিসি হাটটিতে খাস আদায়ের সিদ্ধান্ত নেয়। তবে ইজারায় অংশ নিয়ে পঞ্চম হওয়া দারুস সালাম থানা বিএনপির আহ্বায়ক এসএ সিদ্দিক সাজু খাস আদায়ের দায়িত্ব পান। দরপত্রে সাজুর প্রতিষ্ঠান এসএ করপোরেশন দ্বিতীয় হয় ২১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা দর দিয়ে। আর তৃতীয় হয় রাইয়ান এন্টারপ্রাইজ নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠান। অভিযোগ ওঠে, তৃতীয় দরদাতাকেই ইজারা দিতে চেয়েছিল ডিএনসিসি। কিন্তু সেটা না হওয়ায় সাজুকে খাস আদায়ের জন্য দেওয়া হয়। এ ঘটনায় সম্প্রতি দুদক ডিএনসিসিতে অভিযান চালিয়ে কাগজপত্র জব্দ করে। পরে গত বৃহস্পতিবার ফের গাবতলী পশুর হাটের পুনরায় ইজারার জন্য বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে করপোরেশন।

এদিকে টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার আগেই দখল হয়ে গেছে রাজধানীতে কোরবানির পশুর হাট। টেন্ডার প্রক্রিয়ার সিদ্ধান্ত আজ সোমবার আসার কথা থাকলেও টেন্ডার জমা করে এসেই কোরবানির হাটের কাজ শুরু করেছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ব্যানারে থাকা ইজারাদাররা। হাটের গর্ত ভরাট, ঘাস পরিষ্কারসহ প্যান্ডেল টানানো পর্যন্ত প্রায় অর্ধেক কাজ সম্পন্ন হয়ে গেছে একটি চক্রের দখলে।

ইজারায় দরপতনের আশঙ্কা

গত বৃহস্পতিবার কোরবানির পশুর অস্থায়ী হাট ইজারা দিতে ডিএসসিসির হাটবাজার ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা হয়। সভার একটি সূত্র জানায়, দরপত্র উন্মুক্ত করার সময় অংশগ্রহণকারীরা প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা কাইজার মোহাম্মদ ফারাবীর কাছে হাটের সরকারি দর কমানোর আরজি জানান। তাদের মতে, স্বৈরাচারী সরকারের আমলে কালোটাকা সাদা করার জন্য আওয়ামী লীগ নেতারা কোরবানির পশুর হাটকে ব্যবহার করতেন। তারা হাটের প্রকৃত মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি মূল্য দেখাতেন। প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা কাইজার মোহাম্মদ ফারাবী পিপিআর অনুযায়ী হাটের দর কমানোর ব্যাপারে তার এখতিয়ার নেই বলে জানান। তবে দরদাতাদের আরজি করপোরেশনের প্রশাসকের কাছে জানানোর প্রতিশ্রুতি দেন তিনি।

দনিয়া কলেজের পূর্ব পাশ ও সনটেক মহিলা মাদরাসার পূর্ব পাশের খালি জায়গার সরকারি মূল্য ৪ কোটি ৭২ লাখ টাকা। এ হাটের জন্য তিনটি শিডিউল বিক্রি হলেও একটিও জমা পড়েনি। অথচ গতকাল রোববার সরেজমিনে দেখা গেছে হাট প্রস্তুতের প্রায় ২৫ শতাংশ আগাম কাজ শেষ করা হয়েছে। গত বছর আওয়ামী লীগ নেতা কামরুজ্জামান ৪ কোটি ২১ লাখ টাকায় হাটটি ইজারা নিয়েছিলেন।

শ্যামপুর-কদমতলী ট্রাকস্ট্যান্ড সংলগ্ন খালি জায়গার সরকারি মূল্য প্রায় ৬৭ লাখ টাকা। দুজন অংশগ্রহণকারীর মধ্যে নাজমুল আলম সর্বোচ্চ ৩০ লাখ টাকা মূল্য ধরেন। গত বছর স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা সিরাজুল ইসলাম ৬৮ লাখ টাকায় হাটটি ইজারা নেন।

সাদেক হোসেন খোকা মাঠের দক্ষিণ পাশের খালি জায়গা ও ধোলাইখাল ট্রাক টার্মিনালের সরকারি মূল্য ৪ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। এ হাটে তুষার আহমেদ ইমরান ২ কোটি টাকা ইজারামূল্য দিয়ে অংশ নেন। গত বছর হাটটির ইজারা হয়েছে ৪ কোটি ৩ লাখ টাকায়।

ডিএসসিসির পোস্তগোলা শ্মশানঘাট সংলগ্ন খালি জায়গার অস্থায়ী হাটের সরকারি ইজারামূল্য ২ কোটি ৭০ লাখ টাকা। ইজারায় অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে সর্বোচ্চ দর দিয়েছেন মোহাম্মদ আলী মিলন, ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে টানা সাতবার এটি ইজারা নেন ৪৭ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি মইন উদ্দিন চিশতি।

ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাবের দক্ষিণ-পূর্ব পাশের খালি জায়গার সরকারি মূল্য ছিল ৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। আকরাম হোসাইন নামে একজন ১ কোটি ৫ লাখ টাকা দর দিয়েছেন। এর আগে হাটটি ডিএসসিসির ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর আওয়ামী লীগ নেতা সিরাজুল ইসলাম ভাট্টির নিয়ন্ত্রণে ছিল।

ডিএসসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা (উপসচিব) কাইজার মোহাম্মদ ফারাবী বলেন, ‘এ বছর পশুর হাটের ইজারা নিতে কোনো আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী নেই। এবার বিএনপি, এনসিপি, গণঅধিকার পরিষদের নেতাসহ অনেকেই এসেছেন। তবে সর্বোচ্চ দরদাতাই ইজারা পাবেন। দরদাতাদের উপস্থিতিতে দর উন্মুক্ত হয়েছে। পরে সংশ্লিষ্ট কমিটি যাচাই করে সিদ্ধান্ত নেবে। তবে সরকারি মূল্যের চেয়ে যেসব হাটে কম মূল্য উঠেছে, সেগুলো নিয়ম অনুযায়ী দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ে যাবে।’

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত