জন্মগত শারীরিক সীমাবদ্ধতা, দারিদ্র্য, চিকিৎসাজনিত সংকট আর পারিবারিক অনটন—সব প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে উঠে আসা এক অনুপ্রেরণার নাম সাজ্জাদ হোসেন। গাইবান্ধার এক প্রত্যন্ত গ্রামের সাধারণ পরিবারে জন্ম নেওয়া এই তরুণ আজ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী, সফল অনলাইন বই উদ্যোক্তা এবং এবার বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ—জকসুর কার্যনির্বাহী সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে যাচ্ছেন।
শারীরিক প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে পথচলা
জন্ম থেকেই শারীরিক প্রতিবন্ধী সাজ্জাদ। ছোটবেলায় সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাওয়া তার কাছে ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শারীরিক অবস্থা দ্রুত খারাপ হতে থাকে। কলেজে পড়াকালীন সময়েই সেই সাইকেল চালানো বন্ধ হয়ে যায়; দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়াই হয়ে ওঠে কঠিন।
তবুও থামেননি তিনি। দাখিল ও উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে এক সময় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। পরিবারের সামর্থ্য কমতে থাকলেও সাজ্জাদের পড়াশোনার আগ্রহ কোনোদিনও কমেনি।
অর্থনৈতিক সংকট থেকে উদ্যোক্তা হয়ে ওঠা
বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় বছরেই যে সংকটটা ভয়াবহ আকারে দেখা দেয় তা হলো অর্থনৈতিক টানাপোড়েন। পরিবারের পক্ষে আর নিয়মিত টাকা পাঠানো সম্ভব হচ্ছিল না। টিউশন বা কোচিং পড়ানোর মতো শারীরিক সক্ষমতাও ছিল না সাজ্জাদের। ঠিক তখনই শুরু হয় তাঁর জীবনের নতুন অধ্যায়—উদ্যোক্তা হওয়া।
নিজের হাতে সামান্য পুঁজি নিয়ে তিনি খোলেন একটি ফেসবুক পেইজ। শুরু করেন পুরোনো বই সংগ্রহ ও বিক্রি। প্রথমে অর্ডার কম ছিল, কিন্তু নিষ্ঠা, সততা আর নিয়মিত সেবার কারণে ধীরে ধীরে তা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। পরে তিনি নতুন বইও বিক্রি করতে শুরু করেন।
এখন তার মাসিক আয় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকার মতো। নিজের পড়াশোনার খরচ, জীবনযাপনের ব্যয়—সবকিছুই নিজের হাতেই সামলাচ্ছেন তিনি।
সাজ্জাদ বলেন, “প্রতিটি ছোট কাজই আমার কাছে ছিল বড় দায়িত্ব। তবে আমি কখনো মনে করিনি যে পারবো না।”
জকসু নির্বাচনে লড়াই: ফিজিক্যাল চ্যালেঞ্জড শিক্ষার্থীদের অধিকারের জন্য
সাজ্জাদ এবার শাখা জাতীয় ছাত্রশক্তি সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ জবিয়ান’ প্যানেলের হয়ে জকসু নির্বাচনে লড়ছেন কার্যনির্বাহী সদস্য পদে। তাঁর প্রধান লক্ষ্য—বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য অধিকার ও সুযোগ নিশ্চিত করা।
তিনি বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা অনেক প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী নিজেদের ছোট করে দেখে, হীনমন্যতায় ভোগে। তাদের পাশে দাঁড়ানোর মতো কাউকে তারা পায় না। আমি চাই তাদের কণ্ঠস্বর হতে।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ভবনে লিফট না থাকা, হুইলচেয়ার র্যাম্প না থাকা, মেসে থাকা সমস্যা, ক্লাসরুমে পৌঁছানোর দুর্ভোগ—এসব বিষয়ে সাজ্জাদের দাবি কঠোর।
তিনি বলেন, “শহীদ সাজিদ ভবন ছাড়া কোথাও হুইলচেয়ার নিয়ে ওঠার মতো ব্যবস্থা নেই। এতে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা ব্যাহত হয়। আমি নির্বাচিত হলে এসব সমস্যার সমাধানই হবে আমার প্রথম কাজ।”
গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার একটি ছোট গ্রামের ছেলে সাজ্জাদ। বাবা-মা সাধারণ মানুষ হলেও তাঁদের চাওয়া ছিল ছেলে যেন শুধু মানুষের মতো মানুষ হয়—লড়াই থেমে না যায়।
সাজ্জাদ বলেন, “আমার জীবনে প্রতিটি পদক্ষেপে বাধা এসেছে। কিন্তু আমি হাল ছাড়িনি। আমি চাই, যাদের অবস্থা আমার মতো, তারা যেন আর পিছিয়ে না পড়ে।”

