রাকসু নির্বাচনের উত্তেজনা ছাড়িয়েছে ক্যাম্পাসের বাইরেও

মঈন উদ্দিন, রাজশাহী
প্রকাশ : ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৪: ০৬

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচনের ঘোষণার পর থেকেই জেলাজুড়ে শুরু হয়েছে তুমুল আলোচনা। প্রায় ৩৫ বছর পর আগামী ১৬ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হচ্ছে বহু প্রতীক্ষিত এই ভোটযুদ্ধ। এবারের নির্বাচনে সবচেয়ে আলোচিত দুটি শক্তি হলো ছাত্রদল ও ইসলামী ছাত্রশিবির। মূল লড়াইটাও দুটি সংগঠনের সমর্থিত প্যানেল প্রার্থীদের মধ্যে হবে। তাই বিষয়টি নিয়ে আশপাশের সাধারণ মানুষ ছাড়াও দেশের রাজনীতি, গণমাধ্যম কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোড়ন তুলেছে।

বিজ্ঞাপন

রাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছে ছাত্ররাজনীতি। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষক, অভিভাবক ও সাধারণ মানুষও আগ্রহ নিয়ে নির্বাচনের খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ করছেন। কে কোন প্যানেলে কোন সংগঠন থেকে ভিপি-জিএস হচ্ছেন তা নিয়ে চলছে জল্পনা-কল্পনা। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে শুরু করে জেলাজুড়ে চায়ের দোকান কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সব খানেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু এখন রাকসু।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশকের শোষণামলে দেশের নির্বাচনব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল। প্রশ্নবিদ্ধ ব্যবস্থায় তরুণদের অনেকেই দেশের নির্বাচন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। যে কারণে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকারের মসনদ ধসে পড়ে। জুলাই বিপ্লবের পর নতুন করে ভোটাধিকার নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয়েছে জনগণের। এতে বাড়তি আনন্দ ও উদ্দীপনা যুক্ত করেছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র সংসদ নির্বাচন। পাল্টে যাচ্ছে ভোটের হিসাব-নিকাশও।

সচেতন নাগরিকরা বলছেন, এ নির্বাচন শুধু ছাত্র রাজনীতির ভবিষ্যৎ নয়, বরং দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক অঙ্গনেও প্রভাব ফেলতে পারে। শিক্ষার্থীরা আশা করছেন, গণতান্ত্রিক চর্চার এ মহড়া হবে সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ এবং অংশগ্রহণমূলক। রাজশাহীর মানুষ তাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন কেমন জমবে এবারের রাকুস নির্বাচন, কারা আসবে নেতৃত্বে, আর ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে এর প্রভাব কতটা বিস্তৃত হবে।

এদিকে, ডাকসু ও জাকসুর দুঃখ ঘোচাতে রাকসুতে বিজয়ের প্রত্যাশায় ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা মূল দলের নেতাদের সঙ্গে সব সময় যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন বলে জানা গেছে।

নির্বাচনে ছাত্রদল, ছাত্রশিবির, গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ, বাম ছাত্র সংগঠনসহ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন আলাদা প্যানেলে অংশ নিচ্ছে। স্বতন্ত্র প্রার্থীও হয়েছেন অনেকে। এই নির্বাচন নিয়ে নিজ নিজ দলগুলো জরিপ নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছে। এমনকি রাজশাহীজুড়ে প্রধান আলোচনায় এখন রাকসু নির্বাচন। গ্রাম-গঞ্জের চায়ের কাপে চুমুকের সঙ্গেও চলছে তর্ক-বিরর্ক, করা হচ্ছে চুলচেরা বিশ্লেষণও। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র সংসদ নির্বাচন দেশের রাজনীতিতে হঠাৎ কেন এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল সেই প্রশ্নও সামনে আনছেন অনেকে।

ডাকসু ও জাকসুতে ভরাডুবির পর ভাবমূর্তি উদ্ধারে রাকসুতে বিজয়ের প্রত্যাশায় মাঠে নেমেছে ছাত্রদল। কৌশলী প্যানেলের পাশাপাশি ভিন্ন ধাঁচের প্রচারণাতেও সাধারণ শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করার প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছে সংগঠনটি।

ক্যাম্পাসে ডাকসু-জাকসুর মতো শিবির প্যানেলের ভূমিধস বিজয়ের প্রত্যাশা নিয়ে নির্বাচনি মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন সংগঠনের নেতাকর্মীরা। ‘সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোট’ নামের বৈচিত্র্যময় ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্যানেল করে প্রথমেই চমক দেখিয়েছে ছাত্রশিবির।

ছাত্রদল সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ নতুন প্রজন্ম’ প্যানেলের ভিপি প্রার্থী শেখ নূর উদ্দিন আবীর বলেন, ‘ডাকসু কিংবা জাকসুর সঙ্গে রাকসুর তুলনা করা যথাযথ হবে না। সব বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব পরিবেশ, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আলাদা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আচার-আচরণ, চলাফেরা এবং ক্যাম্পাস সংস্কৃতিও অন্যদের থেকে ভিন্ন। তাই রাকসুর প্রেক্ষাপটকে ঢাবি বা জাহাঙ্গীরনগরের নির্বাচনের সঙ্গে এক কাতারে ফেলা সঠিক হবে না।’

বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি ও ‘সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেলের ভিপি প্রার্থী মোস্তাকুর রহমান জাহিদ বলেন, ‘ডাকসু, জাকসু এবং রাকসু সব নির্বাচনের প্রেক্ষাপট আলাদা এবং সেক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা নির্বাচনি ধারা ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিও স্বতন্ত্র। তাই সব নির্বাচনকে আলাদাভাবে মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। তবে ডাকসু ও জাকসুতে শিক্ষার্থীরা আমাদের প্রতি যে আস্থা রেখেছেন, সেটি আসলে শিক্ষার্থীদের একটি বার্তা, তারা পরিবর্তন চান।’

রাজশাহী মহানগরীর আলুপট্টি এলাকার চায়ের দোকানে আলাপকালে রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘অনেক দিন পর রাকসু নির্বাচন হচ্ছে, এতে ছাত্ররা আবার গণতান্ত্রিক চর্চায় ফিরবে।’

অন্যদিকে এক দিনমজুর জয়নাল আবেদীন প্রশ্ন ছুড়ে বলেন, ‘ভোট দিলে কি ছাত্রদের সমস্যা আসলেই কমবে, না আবার আগের মতো গোলমাল শুরু হবে?’

এ বিষয়ে এক তরুণ ব্যবসায়ী শিহাব উদ্দিন মন্তব্য করেন, ‘যদি যোগ্য ও সৎ ছাত্ররা নির্বাচিত হয়, তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ভালো হবে, তার সুফল আমরা বাইরের মানুষও পাব।’

মেহেরচণ্ডি এলাকার প্রবীণ নাগরিক সেফাতুল্লাহর আশঙ্কা, ‘দলীয় প্রভাব বেশি থাকলেও ছাত্রদের আসল কল্যাণ হবে না। নির্বাচনটা যদি নিরপেক্ষ হয়, তাহলেই কেবল ভালো ফল পাওয়া সম্ভব।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক আনোয়ার হোসেন ফিরোজ আমার দেশ-কে বলেন, ‘ছাত্র সংসদ নির্বাচনে হার-জিতের ব্যাপারটা রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য এখন ইজ্জতের লড়াই হয়ে গেছে। যে কারণে এই নির্বাচন ও এর ফলাফল নিয়ে বিএনপি, জামায়াত কিংবা এনসিপির মতো রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে উচ্ছ্বাস ও আশঙ্কা দুটাই আছে।’

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত