চবিতে ‘সম্প্রীতির’ ঝড়: ২৬ পদের মধ্যে ২৪টিতেই শিবির–সমর্থিতদের জয়

জমির উদ্দিন ও আতিকুর রহমান চবি থেকে
প্রকাশ : ১৬ অক্টোবর ২০২৫, ০৬: ০১
আপডেট : ১৬ অক্টোবর ২০২৫, ০৬: ৩৩

দীর্ঘ এক যুগ পর অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবির–সমর্থিত বলে পরিচিত ‘সম্প্রীতি’ প্যানেলের একচেটিয়া জয় ক্যাম্পাস রাজনীতির চিত্র পাল্টে দিয়েছে। ২৬টি পদের মধ্যে ২৪টিতেই এই প্যানেলের প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালানোর পর মাত্র এক বছর প্রকাশ্যে আসা এবং এর আগে প্রায় ১০ বছরের বেশি সময় নিষ্ক্রিয় থাকা শিবিরের নীরব সংগঠিত প্রত্যাবর্তনের ইঙ্গিত মিলছে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকেরা।

ভিপি পদে বিজয়ী হয়েছেন ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী ইব্রাহিম রনি এবং জিএস পদে একই বিভাগের সাঈদ বিন হাবিব-দুজনই সম্প্রীতি প্যানেলের প্রার্থী। কেবল এজিএস পদে জয় পেয়েছেন ছাত্রদল–সমর্থিত আইয়ুবুর রহমান তৌফিক এবং সহ–ক্রীড়া সম্পাদক পদে নির্দলীয় এক প্রার্থী।

বিজ্ঞাপন

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু এই 'সম্প্রীতি শিক্ষার্থী জোট'। শিবির ২০১০ সাল থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কার্যত নিষিদ্ধ। ২০১২ সালের ভয়াবহ সংঘর্ষের পর সংগঠনটির বেশ কয়েকজন নেতা বহিষ্কৃত হন, অনেকেই গ্রেপ্তার হন। এরপর প্রায় এক দশক তারা ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে কোনো কার্যক্রম চালায়নি। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কয়েকজন প্রাক্তন নেতা ও নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা ধর্মীয়-সামাজিক উদ্যোগের নামে পুনরায় সংগঠিত হতে শুরু করেন। 'সম্প্রীতির শিক্ষার্থীর জোট নাম দিয়ে চাকসু কেন্দ্রিক প্রচারণায় নামেন। প্রথম প্রকাশ্যে আসে শেখ হাসিনা পালানোর পর ২০২৪ সালের শেষ দিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদে বিতর্ক প্রতিযোগিতা, রক্তদান ও 'নৈতিক শিক্ষা' সেমিনারের আয়োজনের মাধ্যমে।

ভিপি নির্বাচিত ইব্রাহিম রনি সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের লক্ষ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে নৈতিকতা, সম্প্রীতি ও শান্তি ফিরিয়ে আনা। শিক্ষার্থীদের আস্থার প্রতিফলন ঘটেছে এই ফলাফলে।

শিবিরের নীরব পুনরুত্থান?

বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিশ্লেষকরা জানান, শেখ হাসিনা আমলে চবিতে শিবিরকে পুরোপুরি নির্মূল করা যায়নি, বরং তারা নিজেদের ধর্মীয় ও নৈতিক ব্যানারে পুনর্গঠিত করেছে। সম্প্রীতির জয় সেই প্রক্রিয়ার পরিণতি। এই ফলাফল তাদের সাংগঠনিক পুনরুত্থানের স্পষ্ট ইঙ্গিত।

তারা আরও বলেন, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যদি ভবিষ্যতে তদারকি না করে, তাহলে এটি ক্যাম্পাস রাজনীতিতে এক নতুন দ্বৈরথের সূচনা করবে।

চবি অর্থনীতি বিভাগের ছাত্রী সাবরিনা নূর বলেন, নির্বাচনে শৃঙ্খলা ছিল, কিন্তু অনেকেই জানতেন কোন প্যানেলের পেছনে শিবির আছে।

ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী জসিম উদ্দিন বলেন, ছাত্রলীগের অনুপস্থিতিতে ক্যাম্পাসে একটা রাজনৈতিক শূন্যতা ছিল। সম্প্রীতি সেটাই কাজে লাগিয়েছে।

অন্যদিকে সম্প্রীতি–সমর্থক এক শিক্ষার্থী বলেন, আমরা কোনো সহিংসতা করিনি, শুধু ভোটে অংশ নিয়েছি। এটা আমাদের নৈতিক জয়ের প্রতিফলন।

২০১২ সালের সংঘর্ষে চবি ক্যাম্পাসে রক্তপাতের পর শিবিরের রাজনীতি কার্যত অপ্রকাশ্যে চলে যায়। শেখ হাসিনা আমলে শিবিরের ৫ নেতাকর্মী নিষিদ্ধ সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগের হাতে নিহত হন। তখন তাদের উপস্থিতি কেবল গোপনে অনুভূত হতো-হল রাজনীতি, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, বা ছাত্রনেতাদের ছায়ায়। এখন চাকসুর নির্বাচনে ‘সম্প্রীতি শিক্ষার্থীর ঐক্যজোট’ নামের প্যানেলের নিরঙ্কুশ জয় যেন সেই নিষিদ্ধ সংগঠনের দীর্ঘ নীরবতার অবসান ঘটিয়েছে।

চবি রাজনীতি এখন নতুন এক বাস্তবতায় প্রবেশ করছে। একদিকে ছাত্রদলের একক প্রতীকী পদ জয়, অন্যদিকে সম্প্রীতির একচেটিয়া আধিপত্য। অনেকেই আশঙ্কা করছেন, এটি শান্তির নয়, পুরোনো রাজনীতির পুনরাবৃত্তির শুরু হতে পারে।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত