রাকসু প্রার্থীদের এখতিয়ারবহির্ভূত প্রতিশ্রুতি

ফাহমিদুর রহমান ফাহিম, রাবি
প্রকাশ : ১৩ অক্টোবর ২০২৫, ০২: ২০

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) বিরাজ করছে নির্বাচনি উত্তাপ। প্রার্থী ও ভোটারের সরব পদচারণে মুখর পুরো ক্যাম্পাস। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু), হল সংসদ ও সিনেটের ছাত্রপ্রতিনিধি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আগামী ১৬ অক্টোবর। দীর্ঘ দুই যুগ পর আয়োজিত এই ভোটের মাত্র তিন দিন বাকি থাকায় প্রার্থীরা দিচ্ছেন নানা প্রতিশ্রুতি। প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিকতে এমনসব অঙ্গীকার করা হচ্ছেÑযা গঠনতন্ত্রে নেই। এতে ভোটাররা বিভ্রান্ত হচ্ছেন, কেউ কেউ হাস্যরসও করছেন।

ভোট দরজায় কড়া নাড়ায় ক্যাম্পাসে চলছে জোর প্রচার। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত প্রার্থীরা ছাপানো লিফলেট ও ইশতেহার নিয়ে দৌড়াচ্ছেন এক হল থেকে অন্য হলে, মেস থেকে মেসে। প্যানেল থেকে প্রার্থীরা কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে প্রচার চালাচ্ছেন। নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে চাইছেন ভোট। কাজলা, বিনোদপুর, মেহেরচণ্ডী ও ভদ্রা এলাকার রাস্তাঘাট, চা-দোকান ও ছাত্রাবাসে রাত ১০টা থেকে ১২টা পর্যন্তও চলছে প্রচারের জোয়ার। তবে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা পড়েছেন বিপদে, তারা এককভাবে সবার কাছে গিয়ে কুলাতে পারছেন না।

বিজ্ঞাপন

সৈয়দ আমীর আলী হলের শিক্ষার্থী প্রণব কুমার সাহা বলেন, ছুটি থাকায় সারাদিন হলে ছিলাম। অনেক প্যানেল ও স্বতন্ত্র প্রার্থী কক্ষে আসছেন, নিজেদের পরিচয় দিচ্ছেন। পড়াশোনায় কিছুটা ব্যাঘাত ঘটলেও নির্বাচনের উৎসবমুখর পরিবেশটা উপভোগ করছি।

ছাত্রদল সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ নতুন প্রজন্ম’ প্যানেলের ভিপি প্রার্থী শেখ নূর উদ্দিন আবীর বলেন, ‘আমরা আবাসিক হল ও মেসগুলোতে বেশি ফোকাস করছি। বিকালে শিক্ষার্থীরা ঘুরতে বের হলে ক্যাম্পাসেও প্রচারকাজ চালাচ্ছি। আচরণবিধি মেনে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রচারকাজ চলবে।’

ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোট’-এর ভিপি প্রার্থী মোস্তাকুর রহমান জাহিদ বলেন, ‘নির্বাচন একেবারেই সন্নিকটে। তাই আমরা টিম ভাগ করে সব শিক্ষার্থীর কাছে যাওয়ার চেষ্টা করছি। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ভালো সাড়াও পাচ্ছি।’

ইশতেহারে গঠনতন্ত্রের বাইরে প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি

রাকসু নির্বাচনে এখন পর্যন্ত পাঁচটি প্যানেল ইশতেহার ঘোষণা করেছে। তবে অধিকাংশের ইশতেহারে এমন অনেক প্রতিশ্রুতি আছেÑযা রাকসুর গঠনতন্ত্রের আওতায় পড়ে না।

শিবির সমর্থিত ‘সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোট’ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার সম্প্রসারণ, বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসাকেন্দ্রকে পূর্ণাঙ্গ মেডিকেলে রূপান্তর, নারী শিক্ষার্থীদের জন্য পৃথক মসজিদ কমপ্লেক্স নির্মাণ, ক্যাম্পাসে ই-কার চালু ও শিক্ষক রাজনীতি বন্ধের মতো উদ্যোগ নেওয়ার।

ছাত্রদল সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ নতুন প্রজন্ম’ প্যানেল বলছে, তারা সেশনজট নিরসনে অভিন্ন একাডেমিক ক্যালেন্ডার, নতুন হল নির্মাণ ও অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের মাসিক ভর্তুকি নিশ্চিত করবে।

‘রাকসু ফর র‍্যাডিক্যাল চেঞ্জ’ প্যানেলের দাবি, তারা নির্বাচিত হলে শিক্ষকদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে অডিট টিম গঠন করবে এবং ভর্তি, রেজিস্ট্রেশনসহ সব সেবা এক অ্যাপে নিয়ে আসবে।

বাম সমর্থিত ‘গণতান্ত্রিক শিক্ষার্থী পর্ষদ’ ইশতেহারে রাকসুর কাঠামো সংস্কার ও ক্ষমতা বৃদ্ধি, শিক্ষার্থীদের ক্ষমতায়ন, গবেষণায় অগ্রাধিকার, আবাসন সংকট নিরসন, লাইব্রেরি ও সেমিনার কক্ষ সংস্কার, খাদ্যের মান ও পুষ্টি সুরক্ষা, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা, নারীবান্ধব ক্যাম্পাস গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

রাকসুর প্রথম গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করা হয় ১৯৬২ সালে। গত বছর জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে এতে কিছু সংশোধনী আনা হয়।

বিদ্যমান গঠনতন্ত্রে রাকসুর সুনির্দিষ্ট কাজের কথা বলা হয়েছে। কাজগুলো হলোÑবিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের অনুষ্ঠান আয়োজন, বছরে অন্তত একবার সাময়িকী প্রকাশ করা, মানবহিতৈষী ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়া, বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা ও বক্তৃতার আয়োজন করা, প্রতিবছর অন্তত একবার সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন, আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় প্রতিযোগিতা এবং পরিবেশগত সম্মেলনে প্রতিনিধিদের পাঠানো। একই উদ্দেশ্যে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানানো, ভিপির অনুমোদনে সহ-পাঠ্যক্রমিক ও পাঠক্রমবহির্ভূত কার্যক্রমের আয়োজন করা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মুহাম্মদ আলী রেজা বলেন, ‘রাকসুর কাজ সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও মানবিক কর্মকাণ্ডে সীমাবদ্ধ। কিন্তু অনেকে এমনসব ইশতেহার দিচ্ছে যেন তারা প্রশাসনিক পদে বসবে। রাকসুর তহবিল ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের তহবিল আলাদা, তাই এসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।’

তবে শিবির সমর্থিত প্যানেলের ভিপি প্রার্থী মোস্তাকুর রহমান জাহিদ বলেন, ‘আমরা ১২ মাসে মাত্র ২৪টি ইশতেহার দিয়েছি। তাতেই সবাই আমাদের সমালোচনা করছে। ১২ মাসে (৩৬৫ দিনে) এত ছোট চিন্তা-ভাবনা কেন আপনাদের? আমার তো মনে হচ্ছে আরো বেশি দেওয়া উচিত ছিল। আমরা যে ইশতেহার দিয়েছি, তা ছয় মাসেই পূরণ করা সম্ভব।

শেখ নূর-উদ্দীন আবির বলেন, ‘আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে, তাদের মতামত নিয়ে ইশতেহারগুলো সাজিয়েছি। আমরা যে ইশতেহার দিয়েছি, তার কোনোটাই অসম্ভব নয়। শিক্ষার্থীরা যদি আমাদের সঙ্গে থাকে এবং প্রশাসনের সঙ্গে যদি আমরা সমন্বয় করতে পারি, তাহলে অল্প সময়ের মধ্যেই এগুলো বাস্তবায়ন করতে পারব।

অনাবাসিক ভোটার বড় চ্যালেঞ্জ

রাবিতে মোট ভোটার প্রায় ২৯ হাজার। এর ৬৮ শতাংশই অনাবাসিক শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭টি আবাসিক হল ও একটি আন্তর্জাতিক ডরমিটরিতে আবাসিক সুবিধা আছে মাত্র ৯ হাজার ৬৭৩ শিক্ষার্থীর জন্য। অন্যরা আশপাশের এলাকা যেমন বিনোদপুর, কাজলা, ভদ্রা ও মেহেরচণ্ডীতে মেস বা ভাড়া বাসায় থাকেন।

বড় সংগঠনগুলোর প্রার্থীরা তাদের দলীয় কর্মীদের মাধ্যমে অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছাতে পারছেন। কিন্তু স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য এটি রীতিমতো কঠিন কাজ। কর্মীসংখ্যা কম থাকায় অনেকে নিজেরাই মেসে গিয়ে প্রচারকাজ চালাচ্ছেন।

স্বতন্ত্র ভিপি প্রার্থী মোহাম্মদ মুসা বলেন, ‘দলীয় প্রার্থীদের মতো আমাদের বিভাগে বিভাগে কর্মী নেই। তাই সব মেসে যেতে অনেক সময় ও শ্রম লাগছে। তবুও যতটা পারি চেষ্টা করছি।’

রাকসুর প্রথম নারী ভিপি প্রার্থী তাসিন খান বলেন, ‘আমরা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নই, তাই আমাদের কর্মীও সীমিত। শহরের বিভিন্ন এলাকায় থাকা ভোটারদের কাছে পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়েছে। যদি সব ভোটারের কাছে গিয়ে আমাদের পরিকল্পনা জানাতে পারতাম, তবে ভালো ফল পেতাম।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের শিক্ষার্থী ফয়সাল রহমান বলেন, ‘আমাদের মেসে রাজনৈতিক দলগুলোর প্যানেলের প্রার্থীরা একাধিকবার এসেছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে কয়েকজন মাত্র একবার এসেছেন। দলের প্রার্থীরা প্রচারে অনেক বেশি সক্রিয়।’

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত