বাজি: সময়, ঐতিহ্য আর বাংলার সুরের হৃদয়ভূমি ভ্রমণ

এলিটা করিম
প্রকাশ : ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৬: ৩৬

দীপ্ত টিভির স্টুডিওটা ছিল সেদিন মানুষের ভিড়ে সরগরম—টেকনিশিয়ান, এজেন্সির লোক, শিল্পীসহ আরও অনেকেই। কোথাও নাচের দল প্রপস হাতে এক কোণ থেকে আরেক কোণে ছুটে যাচ্ছে, কেউবা ব্যস্ত তাদের পোশাক আর অলংকার গুছিয়ে নিতে। বাদ্যযন্ত্রশিল্পীরা তাদের যন্ত্রের তার ঠিক করে নিচ্ছেন, এদিকে অন্যান্য শিল্পীরা পর্দার অন্তরালে ফটোগ্রাফারদের সঙ্গে গল্প করছে, আবার কখনো কফির কাপে আড্ডা দিচ্ছে। পুরো ফ্লোরে যেন উৎসবের আমেজ।

তবে এই কোলাহলের মাঝেও গায়ক-গীতিকার হাশিম মাহমুদ যেন তার নিজের জগতে ডুবে আছেন। কোক স্টুডিও বাংলার সাম্প্রতিক গান ‘বাজি’-র স্রষ্টা তিনি চারপাশের শব্দ-হট্টগোল থেকে যেন বিচ্ছিন্ন, নিজের ভাবনায় নিমগ্ন। সেটে দাঁড়ালেই প্রাণবন্ত মনে হচ্ছিল। তার হাসি যেন শুধু প্রিয় জিনিসগুলোর জন্য রাখা। কৌতূহলী দর্শক ও ভক্তরা চেষ্টা করছিলেন তার সঙ্গে কথা বলতে, কিন্তু নিজস্ব স্বস্তির গণ্ডিতে হাশিম মাহমুদ দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন ভাইবোনদের হাতে।

বিজ্ঞাপন

এর মাঝে কিছু বিরল মুহূর্তও ছিল, যখন হাশিম ভাই নিজেই সাড়া দিচ্ছিলেন এবং আশেপাশের মানুষের সঙ্গে কথায় মেতে উঠেছিলেন। তখন তিনি শোনালেন ‘বাজি’-র গল্প। “গানটি আসলে লেখা হয়েছিল ১৯৯৬ সালে,” স্মৃতিচারণ করলেন তিনি। “আমি কখনোই একসাথে পুরো গান লিখি না, ধাপে ধাপে লিখি। প্রথম অংশটা লিখেছিলাম বগালেক ভ্রমণের সময় তিন বন্ধুর সঙ্গে। আট-নয় মাস পর সেন্ট মার্টিনে গিয়ে বাকি স্তবক লিখে শেষ করি।” তিনি জানান, গানের অনুপ্রেরণা এসেছে মানুষ ও প্রকৃতি থেকে। প্রথম স্তবক এসেছিল বান্দরবানের এক কিশোরীর অভিব্যক্তিপূর্ণ চাহনি থেকে। পরে সেন্ট মার্টিনের সমুদ্র ও তার গভীরতা শেষের চিত্রকল্প তৈরি করেছে।

ভাবতেই অবাক লাগে, কীভাবে সুর আর শব্দ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ভেসে বেড়ায়—ঠিক যেন বাতাসে ছড়ানো জাদুর ধুলোর মতো। ‘বাজি’ সেই নিয়মকে ছাপিয়ে গেছে। গান আর ভিডিওর শুরুতেই উঠে এসেছে বিলুপ্ত প্রায় কপেয়া সুর, গেয়েছেন ম্রাকোই চিং মারমা। বহু শ্রোতার কাছে সুরটি অপরিচিত হলেও প্রথম শ্রুতিতেই মুগ্ধতা সৃষ্টি করেছে।

তার নাতি ক্যউপ্রু মারমা বললেন, শুটিং ফ্লোর ছিল ভীষণ ভিন্ন অভিজ্ঞতা। গ্রামের বাইরে খুব বের হননি, ঢাকায় আসাটা তার কাছে স্বপ্নের মতো। সেখানে তিনি যেমন খুশি ছিলেন, তেমনই কিছুটা নার্ভাসও। এমনকি তার নাতিকে তিনি তার ছবি তুলতেও বলেছিলেন, যাতে এই মুহূর্তটা তার কাছে স্মৃতি হয়ে থেকে যায় আজীবন।

এক সময় গ্রামীণ উৎসবের অপরিহার্য অংশ ছিল কপেয়া বা লাঙ্গা গীতি। প্রধান গায়ক গান ধরতেন, বাঁশি বা হারমোনিয়াম সুর তুলে প্রতিধ্বনি তৈরি করত। গল্পের মতো বোনা এই সঙ্গীত মানুষকে একত্রিত করত, ভাবনা আর আনন্দের মুহূর্ত গেঁথে দিত। এখন ডিজিটাল বিনোদন ও পার্টি মিউজিক মঞ্চ দখল করেছে। প্রবীণ শিল্পীরা একে একে চলে যাচ্ছেন, তরুণরা খুব কমই এগিয়ে আসছেন। জীবন্ত ঐতিহ্য তাই স্মৃতির কিনারায় দুলছে।

ক্যউপ্রুর কাছে কাপেয়া মানেই শৈশব—সাংগ্রাই, প্রবারণা পূর্ণিমা, বুদ্ধ পূর্ণিমা, শীতের মেলা। শিল্পীরা গাইতেন, লোকজন ভিড় করে শুনত। এই ভিড়-ভাট্টার মাঝেই তার নানির প্রেমে পড়া এই ধারার সঙ্গে।

‘বাজি’-র মাধ্যমে যেন বাংলাদেশের এক প্রাণময় ছবি তুলে ধরা হলো বিশ্ব-দরবারে। সংস্কৃতি, কবিতা আর সুরের সংমিশ্রণে দেশি সংগীত নতুনভাবে জায়গা করে নিলো। ইমন চৌধুরী বলেন, “আসলে তিনটা আলাদা গান একসঙ্গে মিশে তৈরি হয়েছে ‘বাজি’। শুরুটা মারমা কপেয়া দিয়ে, তারপর বম সম্প্রদায়ের বাঁশ নাচের সঙ্গে হামিং, আর শেষে এসে বাজি। মাঝখানে আছে ‘আসমানে তোর ছায়া রে কন্যা, জমিনে তোর বাড়ি’—জালালউদ্দিন খানের লেখা, আমার সুরে।”

কপেয়া ছাড়াও যোগ হয়েছে স্থানীয় নাচ, স্বতন্ত্র গায়নভঙ্গি আর অনন্য এক রিদম সেকশন। বম সম্প্রদায়ের বাঁশ নাচের সঙ্গে হামিং, শ্রীমঙ্গল থেকে আসা শিল্পীদের পরিবেশনায় মণিপুরীদের ‘পুং চোলম’, ঢাকার আশপাশের ধুয়া গান, সঙ্গে কয়ার, বাঁশি আর ঢাকা স্ট্রিং অর্কেস্ট্রা। রিদম সেকশনে নেতৃত্ব দিয়েছেন মিঠুন চক্র— বিভিন্ন সংস্কৃতির শিল্পীদের একসাথে নিয়ে বুনেছেন মসৃণ, স্তরযুক্ত এক শব্দ ভুবন।

বাজির গল্প শুধু সংগীতে সীমাবদ্ধ নয়। তার ভিজ্যুয়ালও দর্শকদের অবাক করেছে। পরিচালক কৃষ্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায় গানটিকে পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছেন এমনভাবে, যেখানে ধরা পড়েছে সংস্কৃতির গভীরতা আর একাত্মতার আবহ। তিনি চেয়েছিলেন এই অঞ্চলের মাটি-মানুষকে পর্দায় আনতে। সাঁওতাল পল্লি, চাঁপাইনবাবগঞ্জের টিকইল, পাহাড়ি জনপদ—সব মিলিয়ে যেন এক প্রতীকী বাংলাদেশ হাজির হলো দর্শকের সামনে। মণিপুরি, মারমা, বম, আর সমতলের ধুয়ার শিল্পীরা হয়ে উঠলেন এক ছবির অংশ, এক সুরের ধ্বনি।

বাইরে থেকে কেউ দেখলে দীপ্ত টিভির শুটিং ফ্লোরকে বিশালই বলবে। আসলেই, এই ফ্লোরে এর আগে দেশের সবচেয়ে বড় বড় রিয়্যালিটি শো হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশকে এক ফ্রেমে ধরতে গেলে—তার রঙ, ভূদৃশ্য আর বৈচিত্র্য নিয়ে—এমনকি এই বিশাল জায়গাটাও ছোট মনে হয়। স্পেসের সীমাবদ্ধতা ছিল বলে মনে করেন কৃষ্ণেন্দু। ‘কিন্তু আর্ট ডিরেক্টর তারেক বাবলু আর সিনেমাটোগ্রাফার কামরুল হাসান খসরুর দল সেই সীমাবদ্ধতাকে পরিণত করেছে শক্তিতে।’

প্রতিক্রিয়াও ছিল তেমনই—দর্শকের উচ্ছ্বাসে সেট কেঁপে উঠেছিল। আর হাশিম মাহমুদের চমকপ্রদ উপস্থিতি যেন এই আনন্দকে ব্যক্তিগত স্মৃতিতে রূপ দিল। বাজি তখন কেবল গান নয়—এটি হয়ে উঠল স্মৃতি, এক আপনত্বের উৎসব।

তাহলে প্রশ্ন থাকে—আমাদের গল্পগুলোকে বিশ্বে পৌঁছে দিতে কী লাগে? আধুনিক সুর, মায়াময় ভিজ্যুয়াল, প্রাচীন সুরভি, লোকনৃত্য, কবিতা আর অনন্য ছন্দ—বাজি এই সবকিছুর সমন্বয়। এটা আমাদের শিকড়ের ডাক, অতীত আর বর্তমানের মধ্যে এক সেতুবন্ধন। এক আহ্বান—শুনতে, অনুভব করতে আর মনে রাখতে।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত