আমার দেশ জনপ্রিয় বাংলা নিউজ পেপার

কেমন কাটে অনাথদের ঈদ

তনিমা রহমান
কেমন কাটে অনাথদের ঈদ

সাধারণভাবে এতিম বলতে আমরা বুঝি যাদের মা-বাবা কেউ নেই। আবার যাদের বাবা আছে, মা নেই; মা আছে, বাবা নেই-তারাও এতিম। রাতের বেলা যে শিশুটি জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে ভাবলেশহীন হয়ে আকাশের দিকে নির্বাক তাকিয়ে থাকে, ওই দূর আকাশের তারার মাঝে মাকে খোঁজে, কোথাও খুঁজে না পেয়ে নিষ্পাপ মনটা ভারাক্রান্ত হয়, ছোট্ট বুকটায় কষ্ট দানা বাঁধে, চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসে—সে মাতৃহীন এতিম।

বিজ্ঞাপন

রাস্তায় চলতে গিয়ে বাবার আঙুল ধরে কোনো উৎফুল্ল শিশুকে চলতে দেখে অন্য যে শিশুটি ফ্যাল-ফ্যাল করে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, বাবার আদর দেখে, বাবার স্নেহের পরশে আগলে রাখা শিশুটিকে দেখে অন্যপাশের যে শিশুটির বিনা আঘাতে বুকের পাঁজর ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়—সে শিশুটি পিতৃহারা, এতিম।

অজস্র মানুষের ভিড়েও যার নিজেকে খুব একা লাগে, নিঃসঙ্গবোধ করে, সে এতিম। ঘুমানোর আগে বারবার মায়ের চেহারা মনে করতে গিয়ে তার বালিশ ভিজে যায়। বাবা না থাকার ব্যথা লুকাতে মায়ের স্নেহের আঁচলে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে চায়। কিন্তু মাথা গুঁজে কাঁদার মতো কোনো অবলম্বনই খুঁজে পায় না, কিংবা থাকে না। সে বাবা-মা হারা অনাথ শিশু, অসহায় হতভাগা এতিম।

মা-বাবার মতো আপন কেউ হয় না। মায়ের শরীরের ঘামের গন্ধও দামি সুগন্ধির চেয়ে মূল্যবান। মায়ের ভালোবাসার সঙ্গে কোনোকিছুরই তুলনা হয় না। আর বাবা হচ্ছে বটবৃক্ষের ছায়ার মতো। ধনী হোক আর গরিব হোক, প্রতিটি সন্তানই তার বাবা-মায়ের কাছে রাজকন্যা-রাজপুত্রের মতো আদরের। এই স্নেহের ছায়া ও বটবৃক্ষের ছায়া থেকে বঞ্চিত অনাথ শিশুদের কেমন দিন কাটে, তাদের ঈদ উদ্‌যাপনই বা কেমন হয়—এ বিষয়ে লিখেছেন তনিমা রহমান

আজিমপুর স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানা

এশিয়ার বৃহত্তম এতিমখানা ঢাকার আজিমপুরের স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানা। ১৯০৯ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রাজধানীর আজিমপুরে শতাব্দীর প্রাচীন এই এতিমখানায় বর্তমানে ১৯০ এতিমের বাস।

এখানে প্রথম শ্রেণি থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করানো হয়। এটি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। এতিমখানার সামনে যে মার্কেট আছে, সেটির আয় ও মানুষের দানে এতিমখানাটি চলে। অনুদানের মানি রিসিট আছে। আবার সরাসরি এখানে এসে সামর্থ্যবানরা দান করে থাকেন। উত্তরা ব্যাংকে এতিমখানার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে। বিদেশ থেকে চাইলে সেখানে অনুদান দেওয়া যায়। দুই ঈদে যে অনুদান পাওয়া যায়, তাতে সারা বছরই প্রায় চলে যায়।

স্যার সলিমুল্লাহ বালিকা বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণি পর্যন্ত আছে, সেখানে প্রাথমিক শ্রেণিতে ছেলে শিশুরাও পড়ালেখা করে। আরেকটি বিদ্যালয় আছে ফরিদ উদ্দিন সিদ্দিকী উচ্চ বিদ্যালয়। এখানে ছেলেরা ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণিতে পড়ে। স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানায় বর্তমানে মেয়ে আছে ৯৪ জন, ছেলে আছে ৯৬ জন।

কেমন কাটে মা-বাবা হারা শিশুদের ঈদ

ঈদুল আজহার সকালটা হবে অন্যদিনের চেয়ে অন্যরকম, অনেকটা আলাদা। ভোরে ফজরের নামাজের পর শিশুরা ঈদের সেমাই খেয়ে নতুন জামা পরে একে অপরের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করে।

ঈদের দিন তিন বেলা পেট পুরে ভালোমন্দ খেতে পারার মধ্যেই তাদের আনন্দ সীমাবদ্ধ। খাওয়া-দাওয়া ছাড়া বছরের অন্য দিনের চেয়ে ঈদের দিন তাদের কাছে খুব বেশি ভিন্ন নয়। বরং ঈদের দিনটায় তারা বিষণ্ণতায় ডুবে যায়। অন্য শিশুদের নতুন জামা পরে পরিবারের সঙ্গে ঈদ উদ্‌যাপন যেন তাদের বাবা-মা না থাকার কষ্ট আরো বাড়িয়ে দেয়। তাই ঈদে মেহেদির টকটকে লাল রঙও তাদের মন রাঙাতে পারে না।

বাবা-মা হারানো পরিবার ছাড়া বেড়ে ওঠা এসব শিশুর মলিন মুখ কিছু না বললেও শান্ত স্থির চোখদুটো নীরব ভাষায় অনেক কথা বলে। কিছু না বললেও তাদের নির্বাক মুখ অন্তর্দাহ, হৃদয়ে রক্তক্ষরণ, বোবা কষ্ট ও হাহাকারের কথা বলে।

ভালো খাবার বা নতুন জামা-কাপড়ের গন্ধ কি তাদের মায়ের গায়ের ঘর্মাক্ত মিষ্টি গন্ধ ভুলিয়ে দিতে পারে! বিস্মৃত করতে পারে বাবা-মা না থাকার অপূরণীয় গভীর শূন্যতা আর সীমাহীন বোবা কষ্ট!

তাই তো উৎসবের দিনেও তাদের চোখে থাকে হতাশা, প্রিয়জন হারানোর বুকে জমানো কষ্ট আর একরাশ বিষণ্ণতা! কারণ তাদের মাথার ওপর বাবা-মায়ের ছায়া নেই, নেই নিরাপদ আশ্রয়স্থল, নেই মমতামাখা স্নেহের পরশ এবং পরিবারের স্নেহময় সান্নিধ্য। নতুন পোশাক ও ভালো খাবার তাদের মা-বাবা না থাকার বেদনা ম্লান করতে পারে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কষ্ট আরো বেড়ে যায়।

এতিমখানার হিসাবরক্ষক আল-আমিন শাওন জানান, ঈদের দিন সকালে ভুনা খিচুড়ি, ডিম ভুনা, সেমাই ও নুডলস এবং দুপুরে গরুর মাংস, পোলাও ও মিষ্টান্নের ব্যবস্থা করা হয়। তিন বেলা ভালো খাবার পেলেও এই শিশুদের আনন্দ সীমিত থাকে শুধু খাবার পর্যন্তই। মায়ের ডালভাতও সন্তানের কাছে অমৃতের সমান, কারণ ঈদ মানেই তো পরিবার, আত্মিক সম্পর্ক, মায়ার জাল বিছানো; আর সেটাই তাদের নেই।

এতিমখানায় বেড়ে ওঠা লাকি বলছিল, ঈদ এলে মনটা বেশি খারাপ হয়ে যায়। ঈদে আত্মীয়-স্বজনরা কেউ দেখা করতে আসে না। অন্যদের হাসিখুশি ঈদ দেখে খুব খারাপ লাগে।

আরেক এতিম শিশু মরিয়ম জানায়, মা নেই বলেই ঈদ এলেই মন খারাপ হয়ে যায়। বাবা-মায়ের কথা খুব মনে পড়ে। এ কথাগুলো বলতে গিয়ে তার কণ্ঠ ধরে আসে। বলতে বলতে তার চোখ ভিজে যায়।

নয় বছরের মোবাস্বিরা এতিমখানায় থাকছে এক বছর ধরে। বাবার কথা জিজ্ঞেস করতেই সে কাঁদতে শুরু করে।

বালক শাখার হাবিবুর রহমান, রেদোয়ান ও ইয়াসিন আরাফাত মানিক জানায়, ঈদের দিনটা আসলে তাদের কাছে অন্য দিনের মতোই। পরিবার ছাড়া ঈদের আনন্দ হয় না!

ইয়াসিন জানায়, ‘আত্মীয়-স্বজন আছেন, মাসে দু-একবার দেখতে আসেন; কিন্তু ঈদে কেউ নিতে আসেন না।’

এতিমখানার এক কর্মচারী জানান, ‘ঈদে কিছু শিশু স্বজনদের কাছে যায়। তবে যারা এখানেই থাকে, তাদের জন্য নতুন পোশাক ও বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা করি। কিন্তু বাবা-মা না থাকার কষ্ট তো আর পূরণ করা যায় না।’

তিনি আরো বলেন, ‘শিশুরা মন খারাপ করলে, কাঁদলে তাদের সান্ত্বনা দিই। তাদের নিজের সন্তানের মতো দেখি। তবে পরিবার ছাড়া ঈদের আনন্দ কখনোই পূর্ণ হয় না।’

ঢাকার বায়তুন নাজাত মাদরাসায় প্লে থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয়। মোহাম্মদ জুনায়েদ, বয়স ১৩ বছর। সে এই হেফজখানায় লেখাপড়া করে। তার বাবা নেই। স্ট্রোকে মারা গেছেন। মা আছেন। মায়ের নাম নাসরীন। তার মা মানুষের বাসায় কাজ করে কোনো রকম দিন কাটান।

মোহাম্মদ ফারহান এই মাদরাসায় ভর্তি হয়েছে চার-পাঁচ বছর আগে। তার বাবা নেই। রাজমিস্ত্রি ছিলেন। ফেরি থেকে পড়ে মারা গেছেন। তার মা বাসায় বাসায় কাজ করেন। তিনি ছেলের খরচ বহু কষ্টে বহন করেন। ফারহান রাতেও মাদরাসায় থাকে। তার থাকার জায়গাটুকুও নেই। খাওয়া-দাওয়া এখানে করে। বেতন ১ হাজার টাকা। তাদের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর। তারা বছরে একবারই গ্রামে যায়।

এভাবেই কাটে এতিম শিশুদের ঈদ। নতুন পোশাক ও ভালো খাবার থাকলেও তাদের হৃদয়ে থাকে এক অমোচনীয় শূন্যতা।

Google News Icon

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন