আমার দেশ জনপ্রিয় বাংলা নিউজ পেপার

বাংলা বসন্ত

নাঈম সালেহ
বাংলা বসন্ত

গায়ে কম্বল ফেলে ঘুমাচ্ছি। সকাল পড়ে রোদ উঠেছে বাইরে। কার্নিশে একটা জংলি এসি বন বন করে হাওয়া গিলছে, ছাড়ছে। ঘুমের ভেতর মনে হলো দরজা খুলে কেউ একজন ঢুকেছে। লোকটা কেচিনে কিছু একটা করছে। সম্ভবত চাচা। চাচা মানে আড়পাতা চাচা। রুমে সিগারেটের কড়া গন্ধ। অ্যাশট্রে তো নেই, চাচা সিগারেটের গোড়াটা কাগজের চা-কাপে পুরে রাখে। মুখ দিয়ে যখন উনি ধোঁয়া ছাড়তে থাকে, তখন মনে হয় যেন শীতকালীন সময়ে বাচ্চা ছেলের পেশাব থেকে ধূসর বাষ্প উড়ে যাচ্ছে। দরজা খুলে ঢোকা লোকটা এরপর আমার কামরায় এলো। চাচাদের চৌকির নিচে কিছু একটা খুঁজছে। চৌকির তলে দোকানের এক গাদা নতুন সাবান আছে, কয়েক বছরের পুরোনো বকেয়ার খাতা। যেসব খাতার বেশিরভাগ টাকা উসুল করার হাল ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। মামলা দিয়ে টাকাগুলো উদ্ধার করা যায়। কিন্তু কে যায় এসব ঝামেলায়। দোকানেরও বদনাম ছড়াবে। লোকটা রুমে পা ঘষে ঘষে বাজেভাবে হাঁটছে। আমি ঘোরের ভেতর দিনে দেখা একটা বীভৎস দৃশ্য দেখছি।

‘আবু সাঈদ বুক টান টান করে দাঁড়িয়ে আছে বন্দুকের সামনে। একটা দাড়িওয়ালা পুলিশ এগিয়ে এসে গুলি ছুঁড়ল। আবু সাঈদ বসে গেল। তারপর আবার সিনা উঁচিয়ে দাঁড়াল। সে টলছে। আশপাশের পোলাপান দৌড়ে পালাচ্ছে। আবু সাঈদ পালায়নি। হাত দুটো মেলে দিয়েছে বাজপাখির মতো। দাড়িওয়ালা পুলিশটা এগিয়ে এসে গুলি ছুঁড়ল। আবু সাঈদ পেট ধরে বসে গেল। এক দল ছেলে ধরাধরি করে তাকে নিয়ে যাচ্ছে ইমার্জেন্সি হসপিটালে।’

বিজ্ঞাপন

রুমে ঢোকা লোকটা আমার কম্বলে হাত রাখল। কম্বলটা চেহারার ওপর থেকে সরিয়ে দিল। আমি চোখ খুললাম। আর দেখতে পেলাম ঝুঁকে আছে একটা জঘন্য কালো, বিকৃত মুখের আরব্য বানর। আমি লাফ দিয়ে বসে গেলাম। আর অমনি বানরটা লাফাতে লাফাতে দরজা হয়ে পালিয়ে গেল। এতক্ষণ সারা রুম তছনছ করেছে। জলদি দরজায় এসে দাঁড়ালাম। বানরটা পায়ে-হাতে লাফাতে লাফাতে, দেয়াল টপকে টপকে দূরের একঝাঁক বানরের সঙ্গে মিশে গেল। সকালের সোনাঝরা রোদে ঘুম ঘুম চোখ দুটি জ্বালা করে উঠল। মুখটাকে চিমসে যাওয়া শসার মতো কুঞ্চনে ভরিয়ে তুললাম। দূরে গতকালের জমা হওয়া ময়লার স্তূপে বানরগুলো খাবার খুঁজে কাড়াকাড়ি করছে। একটু বাদে পৌরসভাকর্মীরা এসে ময়লাগুলো তুলে নিয়ে যাবে।

দোকানে চাচা আছে। কাস্টমার নেই। বানর কাহিনির পর দোকান থেকে রুটি এনে রাতের সালুন দিয়ে পেটের কীড়াদের পিঠে ঠাসঠাস নলা ফেলে ফের ঘুমিয়েছিলাম। চাকরি হয়নি এখনও, আসলাম যে কদ্দিন হলো শুধু। দোকানে এসে শুনি বাংলাদেশের পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে। কোটা আন্দোলন থেকে রূপ নিয়েছে গণঅভ্যুত্থান। সময় চব্বিশ সালের জুলাই।

দেশের সমস্ত নেট বন্ধ করে গতরাতে সারাদেশে গণহত্যা চালিয়েছে সরকার। প্রথম আলোসহ দু-একটা পরিচিত গণমাধ্যম কীভাবে যেন এখনও অনলাইনে খবর প্রচার করতে পারছে। গত রাতের বেশ কয়েকটি গণহত্যার ভিডিও ফুটেজ প্রবাসীদের টাইমলাইনে সমানে প্রচার হচ্ছে। আমি দোকানের বারান্দায় এসে বসলাম। চাচার দোকানটা দুই শাটারের। এক শাটারের দোকান এখানে নিষিদ্ধ। বাইরে এসে বসে আছি। নারীর গন্ধবিভোর চুল ওড়ানো বাতাস এসে গায়ে নরম হয়ে আন্দোলিত হচ্ছে । হাওয়াগুলো শরীর স্পর্শ করে যাচ্ছে, যেন প্রেমিকার মাখন ছোঁয়া। জায়গাটা খানিক উঁচু। নিচে গ্যারেজ। একটা লোক মুখ গোমড়া করে তার সামনে বসে আছে। ময়লা সোফা। ঝড়ে ভেজে, রোদে শুকায়। গদির এক পাশে ফোম নাই হয়ে গেছে। লোকটার নাম মিন্টু। মন খারাপ। গ্যারেজওয়ালা বাঙালি এক সৌদির গাড়ি মেরামত করে দিচ্ছে। পুরাতন টায়ার গাড়ি থেকে প্যাঁচ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খুলে স্ট্যানে বসাল। তারপর চাকাটাকে শক্ত আঁটুনি দিয়ে কায়দা করে ভেতর থেকে লোহার অংশ উঠিয়ে নিচ্ছে। মিন্টু লোকটাকেও আমি চাচা ডাকি। সহজ-সরল মানুষ। বেজায় বেঁটে। ইচ্ছে করলে দুই আঙুলের ভেতর নিয়ে উকুনের মতো টুন্নুর করে ফাটিয়ে দেওয়া যায়, এমন। মিন্টুর এমনিতে বৈদেশিক বর্তমান অবস্থা ভালো যাচ্ছে না। কাজ-কাম নেই, তাই টাকাপয়সাও নেই। ভীষণ টানাপোড়েন চলছে। তার ওপর গত রাতে দেশে তার ভাইকে ছাত্র আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে গুম করা হয়েছে। পরে একটা ডাস্টবিনের পানিতে মিন্টুর ভাইয়ের লাশ পাওয়া গেছে। আমাদের বাঙালিরা কাজকাম ফেলে জায়গায় জায়গায় মুখ ভার করে আছে।

আকাশ বিশ্রী হয়ে আসছে। চারদিকে ধুলো উড়ছে। যথাসম্ভব ঝড় হবে। আকাশ কালো হচ্ছে, কালো কালো মেঘে সূর্য ডুবে গেছে।

দূরের ধূলিধূসর পাহাড়গুলোর কুঁজো ভিজে যাচ্ছে বৃষ্টির জলে। ঝুপ করে কারেন্টটা চলে গেল। আমি এখনও বাইরে বসে আছি। ভেতরে চাচা একটা মোম জ্বালিয়েছেন। মোমের জায়গাটা ছাড়া সবটা অন্ধকার। ক্যাশে চাচাসহ বেশ কয়েকজন গুমোট মেরে দাঁড়িয়ে।

চাচা, বাংলাদেশ টেলিভিশনের ভবন নাকি জ্বালিয়ে দিয়েছে?

চাচাসহ সবাই বেশ উচ্চ স্বরে হেসে উঠলেন। একজন উচ্ছ্বাসে বলল, আরে শুনলাম ইন্টারনেট বন্ধ করার প্রতিবাদে বিআরটিসি ঘেরাও করবে ছেলেরা।

আমাদের চোখে আনন্দ ঝিকিমিকি খেলে গেল। তারপর আকাশ হঠাৎ মানচিত্রের আঁকাবাঁকা দাগের মতো চিরে গিয়ে প্রচণ্ড শব্দে কেঁপে উঠল। তুমুল বৃষ্টি। মুহূর্তে মুহূর্তে আকাশ চিরে যাওয়া, খাড়া ঝিলকি।

কিছু ভাল্লাগছিল না। দেশে কোনো যোগাযোগই করতে পারছি না। শুনলাম নোয়াখালীতে পোলাপান পুলিশকে থানায় ঢুকিয়ে বাইরে থেকে তালা মেরে দিয়েছে। পুলিশ আত্মসমর্পণ করেছে। এটা অবশ্য খুশির সংবাদ। কিন্তু যোগাযোগ অবস্থার বিচ্ছিন্নতায় কিছুই ভাল্লাগছিল না। দেশে কী না কী হচ্ছে আল্লাহ জানে। সান্ডে সাসপেন্স থেকে একটি ভুতুড়ে গল্পের অডিও শুনতে শুরু করলাম। রাত একটা বাজে তখন। একটু আগেও আমার ইচ্ছে ছিল ছাদে গিয়ে গল্পটার বকেয়া অংশ শুনব। কিন্তু গল্প যত এগোচ্ছিল, ততই ইচ্ছেটা ভয়ে রূপান্তরিত হচ্ছে। একদিকে রান্নার কাজ করছি, কারণ একটু আগে দোকান থেকে ফিরেছি, এখন খেতে হলে রান্না করতে হবে। ময়লার বড় ঝুড়িটা ভরে উঠেছিল। দুহাতে ঝুড়ির হাতল ধরে বাইরে নিয়ে এলাম। যদিও একেবারেই ইচ্ছে হচ্ছে না বাইরে যেতে। কারণ খুব ভয় পাচ্ছি। বাইরে কুয়াশা উড়ছে। বাতাসটা সব সময়ের মতো। দাঁড়ালে গায়ের কাপড় উড়তে থাকে। আর গায়ে শীত শীত লাগে। কানে গল্পের আবৃত্তি চলছে, গল্পে এক বয়োবৃদ্ধ লোক ডাক্তারকে নিজ জমিদার বাড়ির ভৌতিক বর্ণনা দিচ্ছিলেন। ডাক্তার সাহেব মানসিক সমস্যা মনে করে তাকে কিছু ওষুধপত্তর লিখে বিদায় দিচ্ছিলেন। বৃদ্ধ রোগী চেম্বার থেকে বেরুতে গিয়ে কী মনে পড়ল এমন একটা ভাব নিয়ে আবার ডাক্তারের সম্মুখে এসে দাঁড়াল। বললেন, ‘গত রাতের একটা কথা আপনাকে বলা হয়নি’।

আমার সারা গা শিরশির করে উঠল। না জানি আবার পেছনের অনুল্লেখ্য কোনো ভৌতিক গল্প বর্ণনা দেন গল্পের বৃদ্ধ। কুয়াশায় শরীরের ভেতর সবকটা রোম দাঁড়িয়ে গেল। আরেকটু পর বের হলেই হতো। কানের হেডফোনটা কি খুলে ফেলব?

সৌদিতে আসার পর থেকে আমি কখনোই রাতে ভয় পাইনি। হুটহাট করে বেরিয়ে গিয়েছি অন্ধকারে। সব সময় নির্ভার ছিলাম।

দূরে পাহাড়গুলো বসে থাকা উটের মতো শরীর উঁচুনিচু করে পড়ে আছে। কুয়াশায় ভার হয়ে আছে সেদিকটা। কয়েকটা গাড়ি পরপর সামনে হয়ে কুয়াশায় গলে যাচ্ছে। পেছনের লাইটগুলো স্পষ্ট থেকে ফ্যাকাশে হতে হতে অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমি ঝুড়ির ওজনে বুকের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছিলাম। ঝুড়ির ময়লা মুখ থেকে বড়জোর আধ হাত দূরত্বে। বাসি ভাতের মতো গন্ধ আসছে। রাস্তায় নামলাম। ঝুড়ি নিচে রেখে কিছুটা হাঁপালাম। বৃদ্ধ রোগী আমার কানে তার গত রাতে ঘটে যাওয়া ভৌতিক সময়টা বর্ণনা দিচ্ছেন। আমার শরীর কাঁটা দিয়ে উঠল। ঝুড়িটা নিয়ে ডাস্টবিনের সামনে এগোচ্ছি। আদালত ভবনের নিয়নবাতি জ্বলছে। সদর দরজার জায়গাটা বেশ আলোকিত। ঝুড়ি নিয়ে ডাস্টবিনের সামনে এনে রাখলাম। পায়ের নিচটা বড়-ছোট পাথরে উঁচুনিচু। ডাস্টবিনের পর থেকে গর্ত। হালকা পাতার ঝোপঝাড়। গর্তের পরের উঁচু জায়গাটা ছন্নছাড়া বড় বড় পাথরে উঁচু হয়ে আছে। জায়গাটা বেশ অস্পষ্ট। একে তো রাত, তার ওপর কুয়াশা। আবার এদিকে পাথরগুলো কালো-ও। সান্ডে সাসপেন্ডের গল্পকথক এমন ভয়জড়িতভাবে কাঁপা কাঁপা গলায় অশ্বত্থগাছের গুচ্ছ শেকড় যে তার গলা চেপে ধরে নাভিশ্বাস উঠিয়েছিল, সে বর্ণনা দিচ্ছে।

আমার মনোযোগ দূরের কালো কালো পাথরের ঢিবিটার দিকে গিয়ে স্থির হয়ে গেল। কিছু একটা দেখা যাচ্ছে। নড়ছে মানুষের মতো। সেটা পাথরের আড়ালে বসেছিল যেন। আমাকে দেখে ধীরে ধীরে আড়াল থেকে উঠে দাঁড়াল। কুয়াশার কারণে আমি তাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি না। শুধু দেখছি একটা কালো মূর্তি দণ্ডায়মান। নাক, কান, মুখ ও শরীরের কাপড়চোপড় কোনো কিছুই দৃশ্যত নয়। সবটাই অন্ধকার আর অন্ধকার। ‘কে? কে আপনি?’ আমি চেঁচিয়ে উঠলাম। রুমে ফিরলাম।

লোকটা ছিল মিন্টু। হ্যাঁ, মিন্টুর মতোই তো লাগছিল। কিন্তু এত রাতে সে এখানে কী করে? তারপর শুলাম। চোখ লেগে এলো। কানে কীসের ধ্বনি এসে মখমলের মতো ভাজছিল। ক্রমে শব্দটা স্পষ্ট হয়ে উঠল। আমি ঘুমে। তবু অনুভব করতে পারছি শব্দটা আসছে টিলার ওদিক থেকে। যেখানে ডাস্টবিন ফেলতে গিয়ে একটি কালো মূর্তির সম্মুখীন হয়েছিলাম। মিন্টু যেন গরগর করে বলছে, ‘স্বৈরাচারের গদিতে’, তাল দিয়ে পিঠাপিঠি কয়েকজন বলে উঠল, ‘আগুন জ্বালো আগুন জ্বালো’। মিন্টু বলল, ‘খুনিদের গদিতে’, জবাব এলো, ‘আগুন জ্বালো আগুন জ্বালো’। তারপর কণ্ঠটা আরও তেজোদীপ্ত হয়ে উঠল।

‘ও জেগেছে রে জেগেছে’।

‘ছাত্রসমাজ জেগেছে।’

‘লেগেছে রে লেগেছে।’

‘রক্তে আগুন লেগেছে।’

মরুর ঘুমন্ত ভেজা বালি সব কামারের ফাঁপরের মতো দাউ করে উঠল। সেই দীপ্তিমান সম্মিলিত কণ্ঠস্বর হামাগুড়ি দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। তারা হাঁটছে, হাঁটতে থাকে। পাহাড়ি ঢালুর পথ মাড়িয়ে আকাশ ছোঁয়, তারপর নেমে আসে বন্যার পানির মতো। তারা ঝড়ের আকাশের মতো গর্জে ওঠে, ‘দিয়েছি তো রক্ত’

জবাব আসে, ‘আরও দিব রক্ত’।

গর্জে ওঠে, ‘এই আমার ভায়ের রক্ত’,

জবাব আসে, ‘বৃথা যেতে দিব না’।

গুলির মতো ইথারে-পাথারে বিদ্ধ হতে থাকে, ‘জ্বালো রে জ্বালো’।

জবাব আসে, ‘আগুন জ্বালো’।

কণ্ঠগুলো ধীরে ধীরে মুছে গেল। মনে হলো মিছিল করতে করতে তারা অনেক দূরে চলে গেছে।

সকালে ঘুম থেকে উঠলাম। মসজিদে ফজরের আজান দিচ্ছে। একজন বাইরের সৌদি লোক আমাকে দেখে কী সব বকওয়াজ শুরু করল। আমি নতুন, আরবি জানি না। তবে বুঝতে পারলাম এখানকার বাথরুম অপরিষ্কার হওয়াটাকে তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না। অজুখানায় গেলাম অজু বানাতে। একজন বলল, রাতে মিন্টুদের পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে!

Google News Icon

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন