বৃষ্টি ভেজা আগুন: বিক্ষুব্ধ কবি-লেখক সমাজের একদফা

আবিদ আজম
প্রকাশ : ০২ আগস্ট ২০২৫, ১৮: ১৫
আপডেট : ০২ আগস্ট ২০২৫, ১৮: ৩৬

লাল জুলাইয়ে আমাদের ভেতর কী যেন একটা হয়েছিলো। ভয়লেশহীন, জীবন্মৃত, আবেগশূন্য অথচ দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। বুকে ছিল প্রত্যয়, মুখে বজ্র স্লোগান আর জীবন বাজী রাখার অসীম হিম্মত। সম্বল এটুকুই। জুলাইয়ে খুনি হাসিনার নির্মম গণহত্যা দেখে আমরা যখন ভাবলেশহীন, একটা বিষয়ে আমাকে ভয়ানক পীড়িত করে।

খেয়াল করলাম বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষেরা স্মরণকালের এই ভয়ানক এই রাষ্ট্রীয় কিলিংয়ের নিন্দায় রাজপথে সরব, কেবল কবি লেখকদের সম্মিলিত ও দৃশ্যমান কোন প্রতিবাদ নাই। জাতির সংকটে কাণ্ডারি কবি- লেখকদের কলমের বন্ধ্যাত্ব আর বোবা জবান কী কৈফিয়ত দেবে আগামীর কাছে?

বিজ্ঞাপন

বিষয়টা ভয়ানক অবাক করলো। কয়েকজনের সাথে পরামর্শ করলেও তারা সাহস দিলেন না। এমনিতেই আমার জানা আছে, ঢাকার লেখকরা একটু ভীরু ও সুবিধাপন্থী। কলমে কেউ কেউ খুব শক্তিমান, কিন্তু রাজপথে নামতে নারাজ; বুক কাঁপে। অনেকটা ‘যুদ্ধ যুদ্ধ যুদ্ধ চাই, যুদ্ধ থাকলে আমি নাই’ টাইপের।

কাপুরুষতা, স্বার্থ ভাবনা, নোংরা দলবাজি, গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব আর ক্ষমতার অন্ধ পদলেহন কারও কারও নিত্যকর্ম। জুলাইজুড়ে দেশজুড়ে নির্মম হত্যাকাণ্ড, গুম, আটক আর নিপীড়ন চলতেই থাকলো। রাজপথে লাশ পড়ছে। রক্ত ঝরছেই। স্বজন হারাদের কান্না আর সন্তানের শোকে মায়ের আর্তনাদের আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠছিলো কেবল।

হাসান রোবায়েতসহ আরও কারা কারা যেন লিখছেন অসাধারণ সব স্লোগান, ‘বুকের ভেতর অনেক ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর’। কোন কোন কবি-লেখক-সাহিত্যিক ফেসবুকে সক্রিয় প্রতিবাদ জারি রাখছিলেন। ব্যক্তিগত পর্যায়ে ‘নাগরিক’ হিসেবে রাজপথে নেমেছেন। প্রতিদিন রাজপথে নেমে খুন ও নিপীড়নের সাক্ষী হই আর চাপা রোদন আর দীর্ঘশ্বাস সঙ্গী করে বাসায় ফিরি।

মনের রক্তক্ষরণ বুঝতে পেরে স্ত্রী জড়িয়ে ধরে কাঁদেন। আবার পরক্ষণেই সাহস জোগান। আবার নিষেধও করেন। এক বছরের বাচ্চাটা কেবল বাইরে ঘুরতে যেতে কান্না করে। একদিন বের হবার পর রাস্তায় পুলিশের টিয়ার শেল-গুলির মুখে দ্রুত ফিরে আসতে হয়। এ সময় কবি জুননু রাইন, ‘রাজাচেক’র কবি সাম্য শাহ, দ্রোহী কবি ইমরান মাহফুজ, কবি ফারুক হোসেন খান, লেখক ফরিদুল ইসলাম নির্জনের সাথে আশু করণীয় নিয়ে নিয়মিত আলোচনা করি।

কোন সুরাহা পাই না। কী করা যায়। কাছের কেউ কেউ ভয়ে ঘর ছেড়ে বেরোচ্ছে না। ফারুক ভাই ও সাম্য কাকা আমাকে রাত-বিরাতে একা চলাচল করতে সাবধান করে দেন। মাঝে-মধ্যে সেঞ্চুরি আর্কেডে অধমের অস্থায়ী অফিস, কবি-প্রকাশক নাজমুস সায়াদাত ভাইর ‘সরলরেখা’য় এসে আমাকে তাদের ভক্ত-শিষ্যসহ পাহারাও দিয়েছেন, সেই দুর্দিনে।

কবিদ্বয়ের ধারণা, আমি স্পষ্টবাদী হবার কারণে হাসিনা বাহিনী বা আততায়ী টার্গেটও করতে পারে। (রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্যাপক হুমকি-ধামকি ও ৫ আগস্ট গণভবন থেকে উদ্ধার হওয়া কিল লিস্টে নিজের নামটা দেখে তার প্রমাণও পাওয়া গেলো।) আমি তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে নিজের কাজেই মশগুল থাকি বা কখনো কখনো একটু সাবধানি ভণিতা করি।

দেখা গেলো যাবো পল্টন কোন প্রতিবাদী সভায়, তারা মোটরসাইকেলে নিয়ে গেলো অন্য কোথাও। ‘কাকু, ওদিকে গুলি চলে, যাওয়া যাবে না। তোমাকে দেশের দরকার।’ সাম্য শাহের অকপট মন্তব্য। এটা শুনে আমি হাসি, একটু কৌতুকবোধও হয়। এদিকে শেখ হাসিনার হত্যার পিপাসা কিছুতেই মিটছিল না।

আমাদের লেখকদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ‘কালের কলস লেখক সম্প্রীতিতে প্রতিদিনের নানা খবরাখবর ও করণীয় নিয়ে আলাপ করতাম। মানে, বলা চলে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে বিপ্লবী কবি-লেখকরা এই গ্রুপটা থেকে নানান নির্দেশনা পেয়েছেন। গণহত্যার দোসর ও উস্কানীদাতা হিসেবে শনাক্ত করে দু’জনকে গ্রুপ থেকে বাদও দিতে হয়েছে।

কারণ, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে লেখকদের একমাত্র দৃশ্যমান কর্মসূচি ‘বিক্ষুব্ধ কবি-লেখক সমাজ’র আয়োজন ও পরিকল্পনা করা হয়েছে এই গ্রুপটি থেকে। ২০১৩ সালে কবি আল মাহমুদের সাচিবিক দায়িত্ব পালনের সময় ‘কালের কলস’র জন্ম। এ নামে একটি ওয়েবসাইট তৈরি করতে কবি আবুল হাসান তাহেরের অফিসে গেলে আমাদের ‘সরকার বিরোধী’ আখ্যা দিয়ে ঠুনকো অজুহাতে পুলিশ গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়।

কিছু টর্চারও করে। পেশাদার সাংবাদিকদের তীব্র প্রতিবাদের সুবাদে আমি মুক্তি পেলেও আওয়ামী লীগ ও ভারত বিরোধী এক্টিভিজমে জড়িত তাহের ভাইর কয়েকদফায় জেল ও রিমান্ড হয়। পুলিশ আমাকে ছেড়ে দিয়ে আবারও খুঁজতে থাকে। ওনার দীর্ঘ দিনের গোছানো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লুটে নিয়ে যায় ফ্যাসিবাদী গোষ্ঠী। এ গল্প না হয় আরেকদিন বলবো।

রাজপথে ততদিনে শত শত শহিদের লাশ পড়েছে, আহত সারথীদের রক্তে আমার শার্টও রক্তাক্ত, পুলিশের তাড়া খেয়ে নিজেও কিছুটা আহত-বিপর্যস্ত; জুলাইয়ের শেষের দিকে অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান ও শিল্পী সমাজের জোড়ালো প্রতিবাদ দেখে নিজের ভেতর ভয়ানক দহন শুরু হলো।

ভিডিও শেয়ার করে ‘কালের কলস’র গ্রুপে দিলাম বন্ধুদের খোঁচা ‘কবি সমাজের ঘুম কবে ভাঙবে, কবে তাঁরা পথে নামবে, নির্যাতিত গণমানুষকে সংহতি জানাবে, আর কতো ভাই- বোন শহীদ হলে? চলো পথে নামি।’ সাথে সাথে সাড়া দিলেন কবি পথিক রানা। বললেন, ‘কালই আমরা পথে নামি’? জ্বলে উঠলেন ইমরান মাহফুজ।

সম্মতি দিলেন, নিমগ্ন দুপুর, ফারুক হোসেন খান, নাহিদ যাযাবর, ফরিদুল ইসলাম নির্জন, সরোজ মেহেদী ও হালিমা মুক্তা। ‘কাজের কাজী’ কবি ইমরান মাহফুজ আমাকে ফোন দিয়ে বললেন, কালকের আয়োজন উপলক্ষ্যে আমরা উপলক্ষ্যে মিটিং করবো। -‘খুবই ভালো হয়’। গ্রুপ কলে দ্বায়িত্ব ভাগ করে দেয়া হলো।

মূল এই সংগঠকেরা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ব্যানারে কী লেখা থাকবে? একটু ভেবে লিখে দিলাম ‘জুলাই গণহত্যা ও দেশব্যাপী নিপীড়নের প্রতিবাদ। বিক্ষুব্ধ কবি-লেখক সমাজ। ২ আগষ্ট-২০২৪, বাংলা মোটর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রবেশ মুখ)’।

সবাই আনন্দচিত্তে সম্মতি দেবার পর বললাম, শাহবাগ বা বাংলা একাডেমির সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ করলে কেমন হয়? পথিক ও ইমরান জানালেন, সেখানে ব্যাপক ধরপাকড় ও নিপীড়ন চলছে।

আমরা বাংলামোটরে দাঁড়াতে পারি, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সামনে, সকালে। সম্মিলিত পরামর্শের প্রতি সম্মান জানিয়ে আমিও রাজি হলাম। ‘বিক্ষুব্ধ কবি-লেখক সমাজ’ নামটি তখন কেবল একটি চিন্তা ছিল; কিন্তু এই আয়োজন ঘোষণার মধ্যেই তা পরিণত হয় একটি আদর্শ, এক বিপ্লব ও এক সম্মিলিত প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে।

রক্ত দেখলে সম্ভবত প্রতিবাদ-প্রতিরোধের সাহস বাড়ে। আড়মোড়া ভেঙ্গে জেগে উঠলেন সবাই। অনুষ্ঠানের ব্যানার বানানোর দ্বায়িত্ব নিলেন পথিক রানা, ব্যাপক ভাইরাল দাওয়াত কার্ড বানালেন ইমরান, অন্যটি দুপুরের তৈরি, ফরিদুল ইসলাম নির্জন ফলোআপ করবেন সাদাত হোসাইনকে, অন্য সংগঠকেরা বিভিন্ন লেখকদের উপস্থিত নিশ্চিত করার দ্বায়িত্ব নিলেন।

ইমরানও সম্ভাব্য লেখকদের তালিকা দিলেন। সাম্য শাহ অসুস্থ হয়ে গ্রামে থাকায় আয়োজনের হ্যান্ড মাইক জোগানের দ্বায়িত্ব দেয়া হলো তাকে। বলে রাখি, স্বৈরাচারীনীর ১৪৪ ধারা ও আদালতের ‘বিশৃঙ্খলাকারী’দের দেখামাত্র গুলির নির্দেশ এবং গুম-খুন-রিমান্ডের ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে এই আয়োজন বাস্তবায়নের নেপথ্য মূল কাণ্ডারি হলেন উল্লিখিত সদস্যরা। যেই সময়টাতে সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দেওয়া হয়েছিল।

জাতির ভয়ানক সংকটকালে অসাধারণ সাংগঠনিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে আয়োজনের মুখপাত্রের ভূমিকায় ছিলেন কবি ইমরান মাহফুজ। আর সবকিছুর তদারকি ও নির্দেশনার গুরুভারটা অবধারিতভাবে আমার উপর অর্পিত ছিলো। পরিস্থিতি হয়ত এই গুরু-দ্বায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছিলো। ভাবলে অবাক লাগে। গ্রুপের কারো কারো ভেতর দ্বিধা-ভয় বা সংশয় যে কিছুটা ছিলা না, তা নয়, বরং তারচেয়ে বেশি ছিল দেশাত্ববোধ আর সাহস।

মোটামুটি জীবন বাজি রেখে আমরা ‘প্রতিবাদ সমাবেশ’ বাস্তবায়নে নেমে পড়লাম। রাতভর অনলাইনে ঝড়ের গতিতে ছড়িয়ে পড়লো এ খবর। সাড়া পড়ে গেলো চারদিকে। রাতের ভেতর ঝড়ের গতিতে এ খবর ছড়িয়ে পড়লো। হাজার হাজার পোস্ট-শেয়ার হলো। আলহামদুলিল্লাহ। কবি জব্বার আল নাঈম ও কবি পলিয়ার ওয়াহিদসহ অনেকেই অনুষ্ঠানের কথা প্রচার করলেন।

২ আগস্ট, ২০২৪। সকালে উঠেই আমার মনে পড়লো, আয়োজনের প্ল্যাকার্ড, সাইন পেন ও ফিতাসহ আরো কিছু জিনিস আমার নেয়ার কথা। রওনা হতেই শুরু হলো বৃষ্টি। ওদিকে বারবার ইমরান ও পথিক রানার ফোন। পতাকা খুঁজলাম দোকানে পেলাম না। খুঁজলাম লাল কাপড়ও। পেলাম না। তার বদলে হাতে ও কপালে বাধার জন্য লাল ফিতা কিনলাম অনেকগুলো।

এই ফিতা মূলত মেয়েদের চুল বাধার জন্য ব্যবহার করা হয়। সেটাই আমরা কপালে হাতে বেধে প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেছি। অভিনব ব্যাপার। এর আগে, সংবাদ উপস্থাপক বন্ধু সাইনা ইসলাম, কবি হালিমা মুক্তা ও কবি ফারজানা ইয়াসমীন জুলাইয়ের সারথী হয়ে বৈষম্যবিরোধী বন্ধুদের পাশে দাঁড়ান। আমাদের সাহস জোগান।

ধানমন্ডির নিপীড়নবিরোধী শিল্পী সমাজের অনুষ্ঠান থাকায় নির্ধারিত সময়ে আগেই অনুষ্ঠান শুরু করা হয়। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশে দাঁড়াতে না দেয়ায় গলি ছেড়ে মূল রাস্তায় দাঁড়াতে বাধ্য হই আমরা। আলোর কথিত ফেরীওয়ালারা এই ‘রাজাকারী’ ভূমিকার জন্য লজ্জিত কী না আমি জানি না। এতে অবশ্য ভালোই হয়েছে।

১০ মিনিট বিলম্বের পর আমি পৌঁছে দেখি স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছে বিক্ষুব্ধ কবি লেখক সমাজ। শহীদুল্লাহ ফরায়েজী, অধ্যাপক আসাদুজ্জামান, সাদাত হোসাইনসহ শতাধিক লেখক। সামনে জনাপঞ্চাশেক সংবাদকর্মী। বৃষ্টির তেজ আরও বেড়েছে। আমাকে সবাই টেনে নিয়ে গেলো সমাবেশ পরিচালনার জন্য। আর বিপ্লবের আগুন কোন ভাষায় জ্বালাতে হয় তারুণ্যজুড়ে সেই প্রশিক্ষণ আমার নেয়া আছে।

‘জাতির পতাকা আজ খামচে ধরেছে সেই পুরোনো শকুন...’। চারপাশে ধ্বনিত হলো, ‘স্বৈরাচারের গদিতে, আগুন জ্বালাও একসাথে’। ‘জেগেছে রে জেগেছে, ছাত্র-সমাজ জেগেছে। লেগেছে রে লেগেছে, রক্তে আগুণ লেগেছে’। ‘আমার ভাই মরলো কেন, প্রশাসন জবাব চাই’। অনুষ্ঠান ভিন্নমাত্রা পেলো। রক্তে আগুন লাগা ঝাঁঝালো শ্লোগানে প্রতিবাদ তীব্র থেকে তীব্রতর হলো।

অনুষ্ঠানে অধিকাংশ বক্তারা মূলতঃ একদফার ঘোষণা দিয়েছেন। বলেছেন, নির্মম এই হত্যাকাণ্ডের পর খুনি সরকার আর রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকতে পারে না। চলমান নিপীড়ন একাত্তরের গণহত্যাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এভাবে একটা দেশ চলতে পারে না। আমরা নিন্দা জানাই, হাসিনা সরকারের পদত্যাগ দাবি করি।

এ সময় কোটা সংস্কার আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবির সঙ্গে জোড়ালোভাবে একাত্মতা প্রকাশ করে বিক্ষুব্ধ কবি-লেখক সমাজ। বলা হলো, ‘শেখ হাসিনা রক্তপিপাসায় মেতে উঠেছে। মানুষ খুন করে স্বজনদের হাতে টাকা হত্যাকাণ্ডের দিচ্ছে। ক্ষমতা থেকে সে নামতে না চাইলে তাকে টেনে নামিয়ে ফেলতে হবে।’

এ সকল বক্তব্য দেশের প্রায় সকল টেলিভিশন, পত্রিকা ও গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচারিত হয়েছে। সংগঠনের নাম লিখলে যার লিংক পাওয়া যায় গুগল ও ইউটিউবে। তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। তার ভেতর কবিরা বক্তব্য দিচ্ছেন, কবিতা পড়ছেন, শ্লোগান তুলছেন। হঠাৎ কে যেন বললো, সব ছাতা বন্ধ করতে। আমরা বৃষ্টিতে ভিজবো। এটাই দ্রোহ। এটাই বিপ্লব। বর্ষা বিপ্লব।

টানা আড়াই ঘণ্টা চললো সে সমাবেশ। সবাই বৃষ্টিতে ভিজলেও কারো জ্বর আসেনি। কারণ, রক্তে বুঝি জ্বলছিলো বারুদ।

বিক্ষুব্ধ কবি-লেখক সমাজের আহ্বায়ক আবিদ আজমের পরিচালনায় প্রতিবাদ সমাবেশে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য দেন- গীতিকবি শহীদুল্লাহ ফরায়েজী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গবেষক মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান, কবি কাজল শাহনেওয়াজ, কবি টোকন ঠাকুর, আহমেদ স্বপন মাহমুদ, কথাসাহিত্যিক মোহাম্মদ নাজিমুদ্দিন, কবি বকুল আশরাফ, কথাসাহিত্যিক আশরাফ জুয়েল, জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক সাদাত হোসাইন, কবি আদিত্য নজরুল, ডাকটিকিটের প্রকাশক কবি বোরহান মাহমুদ, শিক্ষক সরোজ মেহেদী, কবি রাকিব লিখন, কথাসাহিত্যিক কিঙ্কর আহসান, ফটোসাংবাদিক সুদীপ্ত সালাম, কবি জব্বার আল নাঈম, সাংবাদিক এহসান মাহমুদ, কবি পলিয়ার ওয়াহিদ, কবি ও গবেষক ইমরান মাহফুজ, কথাসাহিত্যিক নিমগ্ন দুপুর এবং কবি তানজীনা ফেরদৌস প্রমুখ।

স্মরণীয় সমাবেশে সংহতি প্রকাশ করেন লেখক ফরিদুল ইসলাম নির্জন, কবি ও শিক্ষক মঈন মুনতাসির, শিশুসাহিত্যিক মামুন সারওয়ার, কথাসাহিত্যিক মাসউদ আহমাদ, কবি আল হাফিজ, হাসনাইন ইকবাল, আবদুর রহমান মল্লিক, পথিক রানা, ফারুক আহমেদ খান, ফারজানা ববি, সাম্য শাহ্, নাহিদ যাযাবর, রি হোসাইন, টিভি উপস্থাপক তাসনুভা মোহনা, মোস্তফা মাহাথির, রাইয়ান জহির, রাফসান গালিব, সালমান হাবিব, তানিয়া সুলতানা, হালিমা মুক্তা, নকিব মুকশি, রাব্বি আহমেদ, রকিবুল ইসলাম, সীমান্ত আকরাম, রাসেল আহমেদ, জুবায়ের ইবনে কামাল, মুস্তাফা মুন্তাজ, নাসরিন সুলতানা, কামাল মুস্তাফা, আরমানুল হক, শারমিন তন্বী, রিয়াজ ইনসান, জায়েদ আলম, মোস্তফা মুন্তাজ, তানজিম তানিম, সোহরাব শান্ত, স্মিতা জান্নাত, ফারহানা সাদিকা ও শাহ্ কামাল। উপস্থিত ছিলেন প্রকাশক মহিউদ্দিন কলি, ব্যাংকার নেয়ামুল হক, রাকিবুজ্জামান লিয়াদ, অর্বাক আদিত্য, তাসলিমা শাহনূর, সুজন হাসান শর্ত, জান্নাতুল বাকী, অধম নূর ইসলাম, রিদওয়ান নোমানী, আবদুল্লাহ আল মামুন ও মানজুলুল হকসহ আরও অনেকে।

সমাবেশ শেষ হবার পর তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নিলাম, একটা প্রতিবাদী মিছিল করবো। যেখানে বোনেরা ব্যানার ধরে সামনে থাকবে। আমাদের এই পুরো আয়োজনে তারা বিপ্লবের ভ্যানগার্ড হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন। অনুষ্ঠানে তাঁরা বলেছেন, বাংলার মেয়েরা আবু সাইদ ও মুগ্ধের মা...শহিদের এই জননীদের স্পেশাল স্যালুট। শ্লোগান দেবার উত্তম লোক না পাওয়ায় লেখকদের মিছিলে আমাকেই শ্লোগান দিতে হলো। পরে বাংলামোটরের মোড়ে কবি মোস্তফা মাহাথিরের সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের মাধ্যমে শেষ হয় সেদিনের সমাবেশ।

আয়োজনের আশপাশে ছিল পুলিশে গাড়ি। সাদা পোশাকে তৎপর ছিল গোয়েন্দা বিভাগে। বারবার তারা আমাদের ছবি তুলছিল। খুব সাদামাটা আয়োজন হলেও এর প্রভাব ছিল বড়। উত্তাল-অগ্নিগর্ভ জুলাইয়ে এই আয়োজন হয়ত নিতান্তই সামান্য, তবে সময়ের বিবেচনায় ‘অসামান্য’ হয়ে বিপ্লবের হয়ে জ্বলেছে আপন মহীমায়। কবি-লেখক ও সংস্কৃতিকর্মীদের শ্লোগানের ক্যানভাসটি ছড়িয়ে পড়েছিলো ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইলে।

পরদিন কবি ফরহাদ মজাহার, আবদুল হাই শিকদার ও জাকির আবু জাফরের নেতৃত্বে জাতীয় প্রেসক্লাবে একই শিরোনামে এবং একই ব্যানারে একটি প্রতিবাদ সমাবেশ হলো। অনুমতি নিয়েই আমাদের নামটা তারা ব্যবহার করেছেন। আমরাও সেখানে অ্যাটেন্ড করেছি। পরে সেদিন একদফায় ছাত্রদের সাথে গিয়ে মিলিত হয়েছি শহিদ মিনারে।

সেই অভ্যূত্থানের প্রধান নেতৃবৃন্দও বলেছেন, আগের দিন সকালে বিক্ষুব্ধের এই আয়োজন ও ধানমন্ডিতে নিপীড়ন বিরোধী শিল্পী সমাজের আরেকটা সমাবেশ আর দেশবাসীর সম্মিলিত সমর্থনের কারণে তাঁরা এ দফা ঘোষণায় অনুপ্রাণিত হয়েছেন। সেজন্য আমরা বলতে পারি ‘আধুনক ফেরাউন’ খুনি হাসিনার পতনে কবি-লেখকদের সামান্য হলেও অবদান রয়েছে। আয়োজনটা হয়ত সময়ের লেখক-শিল্পীদের কিছুটা দায়মোচনও করেছে।

কবি-লেখকদের প্রতিবাদ সমাবেশের ‘ইতিহাস’ বলতে গিয়ে নিজের কথা প্রসঙ্গক্রমে বারবার উল্লেখ করতে হলো বলে ক্ষমা চাচ্ছি। কেবল হাসিনা পতনের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনই নয়, ছোট্ট এই সাহিত্যিক প্রতিবাদ নিয়েও নানান লোককথা ও গসিপ শোনা যায় মাঝে মধ্যে। অনলাইনে হুমকি-ধামকি ছাড়াও গেল বইমেলায় দেশের পরিচিত চুল সাদা এক লেখক আমাকে ‘জুলাই সন্ত্রাসী’ আখ্যা দিয়ে বলেছেন, বিশেষ কোন গোষ্ঠী আমাকে নামিয়ে দিয়ে এই সমাবেশটা করিয়েছে। জবাবে অট্টহাসি দেয়া ছাড়া আর কী’ইবা করার ছিল।

জাতির ভয়াবহ সংকটকালে এই প্রতিবাদ ও সংহতি সমাবেশে আয়োজনের জন্য আমাদের ‘বীরের তকমা’ প্রয়োজন নেই, দরকার নেই ফুলমাল্যেও ভূষণ, দীর্ঘ স্বৈরশাসনে লাইনচ্যুত দেশটা আবার ঠিকপথে চলুক। এটাই কামনা করি। আর প্রকৃতপক্ষে জুলাইয়ের নায়ক-মহানয়ক হলেন শহীদ ও আহত গাজীগণ, আর মুক্তিকামী-অকুতোভয় একদল ছাত্রসেনা।

আমরা নই। কর্মী হিসেবে আমরা নিজেদের কাজটাই করে যাবো ইনশাআল্লাহ। আমাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সেদিন যারা, রক্তের পিচ্ছিল পথ পেরিয়ে ছুটে এসেছেন, ইতিহাস নিশ্চয়ই তাদের স্মরণ করবে। ডেকেও অনেককে আনা যায় নি, তাদের প্রতি আমাদের অভিযোগ নেই। প্রশ্ন হলো, দেশে হাজারো কবি বা কবি সংগঠন তারা কোন অজুহাতে রাজপথে নামেন নি? ‘আত্মবিক্রিত’ বা ভীরুতা দাস এই কবি ও লেখকরা মহাকালের কাছে কী জবাব দেবেন?

জুলাইয়ের পর ঝাঁকে ঝাঁকে বসন্তের কোকিলের মতো আবার অনেকে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এসেছেন। তাঁদের অভিনন্দন না জানালে পাপ হবে। প্রশ্ন হলো, জুলাইতো এলো, স্বৈরাচার পালালো, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত মুক্তি এলা কী? জুলাই ঘোষণাপত্রও আমরা পাইনি।

হাজার শহিদের আকাঙ্ক্ষার দিকে হাঁটছে কী বাংলাদেশ? আমিরুল মোমেনীন মানিকের ভাষায় বলি ‘আবু সাইদ-মুগ্ধ, শেষ হয় নি যুদ্ধ’। এ যুদ্ধ কবে শেষ হবে জানি না। আপনি জানেন?

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত