আমার দেশ

আফরিদার সাফল্যের রহস্য

ফাহিম হাসনাত
আফরিদার সাফল্যের রহস্য

‘দর্শন’ শব্দটি শুনলেই মাথায় আসে সক্রেটিস, প্লেটো কিংবা অ্যারিস্টটলের মতো মহাজ্ঞানীদের মুখ। মানবসভ্যতার বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাসে দর্শন এমন এক শাস্ত্র, যা চিন্তার গভীরতা দিয়ে পরিমাপ করা হয়। একে বলা হয় সব বিজ্ঞানের মা। আর এই ভাবনার রাজ্যে হেঁটেই নিজের পথ খুঁজে নিয়েছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের স্নাতকে প্রথম হওয়া ছাত্রী আফরিদা রহমান।

পাবনায় জন্ম হলেও আফরিদার শৈশব কেটেছে চট্টগ্রামে বাবার সরকারি চাকরির বদলির সুবাদে। পরে তাদের পরিবার স্থায়ীভাবে ঢাকায় চলে আসে। সেখান থেকেই শুরু হয় তার শিক্ষাজীবনের মূল অধ্যায়। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ইংরেজি ভার্সন থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি ও এইচএসসি শেষ করেন আফরিদা। তখন তার স্বপ্ন ছিল একদিন হয়তো প্রকৌশলী হবেন বা চিকিৎসক। কিন্তু ভাগ্যের চাকা তাকে নিয়ে এলো এক অন্য পথের বাঁকে—দর্শনের ভুবনে।

বিজ্ঞাপন

দর্শন বিষয়টি ছিল তার কাছে একেবারেই অপরিচিত। বিজ্ঞান থেকে হঠাৎ দর্শনে আসার সিদ্ধান্তকে অনেকেই দেখেছিল ভ্রু কুঁচকে। কেউ বলেছিল, ‘বিজ্ঞান ছেড়ে এই বিষয় কেন?’ নিজেকে প্রমাণ করতে হয়েছিল প্রতিনিয়ত। সে এক ভিন্ন লড়াই, যার নাম আত্মবিশ্বাস আর অধ্যবসায়।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে ভর্তি হয়ে শুরু হয় তার নতুন যাত্রা। শুরু থেকেই তিনি ছিলেন অত্যন্ত মনোযোগী, পরিশ্রমী ও আত্মবিশ্বাসী। দর্শনের বিমূর্ত ধারণাগুলো বুঝতে গিয়ে তিনি আশ্রয় নেন দার্শনিকদের লেখা, তাদের তত্ত্ব, মতবাদ ও চিন্তায়। যুক্তি, নৈতিকতা, সমাজ ও মানবজীবনের মৌলিক প্রশ্নগুলো তার মনে এক গভীর প্রভাব ফেলে।

প্রথম বর্ষ থেকে শেষ বর্ষ পর্যন্ত তিনি ছিলেন বিভাগের সেরা শিক্ষার্থী। স্নাতকে সিজিপিএ ৩.৭১ পেয়ে বিভাগের সর্বোচ্চ স্থান অর্জন করেন। শুধু একজন মেধাবী শিক্ষার্থীই নন, বিভাগের প্রতিনিধি হিসেবেও তিনি ছিলেন সবার নির্ভরতার প্রতীক। বিভাগীয় কার্যক্রমে নেতৃত্ব, সহপাঠীদের একাডেমিক সহায়তা এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যস্থতায় তার ভূমিকা ছিল অনন্য।

আফরিদার মতে, ‘Philosophy is the basis of all sorts of science and engineering.’ দর্শনের জগতে এসে তিনি উপলব্ধি করেন, চিন্তা, প্রশ্ন ও নিজেকে গড়ে তোলার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য। তিনি বলেন, ‘তুমি কী বিষয় পড়ছো, সেটা মুখ্য নয়—তুমি নিজেকে কীভাবে গড়ছো, সেটাই আসল।’

তিনি বিশ্বাস করেন, একজন মানুষ হিসেবে সমাজ ও দেশের উপকারে আসাটাই জীবনের সবচেয়ে বড় সাফল্য। তার প্রেরণা এসেছে পরিবার ও শিক্ষকদের কাছ থেকে। মা-বাবা তার নৈতিক ভিত্তি গড়েছেন, আর শিক্ষকেরা তাকে চিন্তার কাঠামো উপহার দিয়েছেন।

দর্শনের জগতে পথ চলার পাশাপাশি আফরিদা ভালোবাসেন বই পড়তে, বাগান করতে এবং ভ্রমণে যেতে। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এখনো প্রক্রিয়াধীন থাকলেও তিনি নিশ্চিত যে আত্মপ্রশ্ন আর মানবিক দর্শনকে সঙ্গী করেই তিনি ভবিষ্যতের পথ খুঁজে নেবেন।

আফরিদা আরো বলেন, ‘তিনটি বিষয়ের দিকে সবসময় মনোযোগী হও—কার প্রতি মনোযোগ দেবে, কখন দেবে এবং কী বিষয়ে দেবে।’ লিও তলস্তয়ের এই শিক্ষা তাকে জীবনের প্রতিটি ধাপ আলোকিত করেছে।

আজ আফরিদার এই সাফল্য শুধু তার একার নয়; এটি তার পরিবারের, বিভাগের, এমনকি সমাজেরও গর্বের বিষয়। তিনি প্রমাণ করেছেন, বিজ্ঞান হোক কিংবা দর্শন—নিজেকে গড়ে তোলার গল্পটা আসলে দৃঢ় মনোবল, নিষ্ঠা আর চিন্তার মধ্য দিয়েই রচিত হয়।

Google News Icon

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন