পাহাড় আর লেকের মাখামাখিতে রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

প্রফেসর ড. মো. আতিয়ার রহমান
প্রকাশ : ১১ নভেম্বর ২০২৫, ১৫: ৪১

বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটি জেলার পাহাড়ি উপত্যকায় সবুজের কোল ঘেঁষে নয়নাভিরাম কাপ্তাই লেকের পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (রাবিপ্রবি)। পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন, এর সংস্কৃতি ও প্রকৃতির গল্পগুলোর সঙ্গে একাডেমিয়ার যোগসূত্র তৈরি ছিল রাবিপ্রবি প্রতিষ্ঠার এক অনিবার্য-অনুল্লিখিত অভিপ্রায়।

সারি সারি পাহাড় আর বিস্তীর্ণ জলরাশির মাঝখানে দাঁড়িয়ে পাহাড়ের অজানা গল্পগুলোকে নতুন রূপে উপস্থাপনের মাধ্যমে এখানকার শিক্ষা, সংগ্রাম আর স্বপ্নের মাখামাখিকে দারুণভাবে তুলে ধরবে, এমন বাস্তবতায় প্রতিষ্ঠিত হয় রাবিপ্রবি। ক্যাম্পাসের প্রতিটি কোণে পাহাড়ের পদধ্বনি, সকালের কুয়াশায় ঢাকা পাহাড়, সন্ধ্যার আলোয় হ্রদের ঝিলমিল আর শিক্ষার্থীদের হাসি-আড্ডা—সব মিলিয়ে রাবিপ্রবি একটি জীবন্ত কাব্য তৈরি করবে, তেমন প্রত্যাশাও ছিল রাবিপ্রবি প্রতিষ্ঠার পেছনে। কিন্তু শুরুর দিকের তিক্ততা আর হাজারো প্রতিবন্ধকতার সিঁড়ি বেয়ে দীর্ঘ এক যুগে রাবিপ্রবি কোথায় এসে দাঁড়াল তা জানান দেওয়ার জন্যই এই নিবন্ধ।

বিজ্ঞাপন

পাহাড়ের ক্যানভাসে যেভাবে রাবিপ্রবির পথচলা শুরু

পার্বত্য চট্টগ্রামের একমাত্র পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান। এটি রাঙ্গামাটি শহর থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে আসামবস্তি-কাপ্তাই সড়কে কাপ্তাই লেক পরিবেষ্টিত পাহাড়ি ভূমির ওপর ঝগড়াবিল মৌজায় অবস্থিত। ২০০১ সালের আইনে প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয় আজ রাঙ্গামাটির পাহাড়ি পথ, কাপ্তাই হ্রদের নীল জল আর ঘন সবুজ বনাঞ্চলের মাঝে উচ্চশিক্ষার একমাত্র আলোকবর্তিকা। এটি পার্বত্য এলাকার শিক্ষার্থীদের জন্য শুধু উচ্চশিক্ষার দুয়ারই খুলে দেয়নি, বরং ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের মনস্তত্ত্বে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনে আকৃষ্ট করেছে। শিক্ষা আর প্রকৃতি মিলে এটি এখন একটি জীবন্ত পোস্টকার্ড। তবে সবুজের মাঝে স্বপ্ন জাগানো এ বিশ্ববিদ্যালয়ের পথচলার শুরুর ইতিহাসটা ছিল একটু কাঠিন্যে ভরা অসমতল গল্পের আবরণে মোড়ানো। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ২০০১ সালের ৩৯নং আইন অনুযায়ী, রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু তার অবয়ব ধারণ করতে সময় লেগে যায় প্রায় ১৫ বছর। রাবিপ্রবি’র প্রথম ভাইস-চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. প্রদানেন্দু বিকাশ চাকমার হাত ধরেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক অভিযাত্রা শুরু হয়।

rang1

পাঠদানের জন্য রাঙ্গামাটি শহরের শাহ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের দুটি কক্ষ ভাড়া নিয়ে ২০১৫ সালের ৯ নভেম্বর এ বিশ্ববিদ্যালয় ২০১৪-২০১৫ শিক্ষাবর্ষে ছাত্র ভর্তি করে এবং অত্যন্ত সংগত কারণে ওই শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদে। বন্ধুরতার মাত্রা এত বেশি ছিল যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাজ শুরু করা হয় ঢাকার মিরপুর ডিওএইচএসের একটি ভাড়া বাসায়, যা পরে স্থানান্তরিত হয় রাঙ্গামাটির ভেদাভেদিতে অবস্থিত পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের প্রায় পরিত্যক্ত একটি দ্বিতল ভবনে। আর সেখানেই অফিসসহ ছাত্রীদের ও ভিসি মহোদয়ের আবাসনের ব্যবস্থা ছিল আর ছাত্রদের জন্য ভাড়া করা হয়েছিল শাহ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের অব্যবহৃত ত্রিতল একটি ছাত্রাবাস। সব স্থাপনা ছিল কড়া পুলিশি নিরাপত্তায় ঘেরা। দীর্ঘ চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ২০১৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ করা সম্ভব হয় এবং ২০১৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর রাঙ্গামাটি শহরের অদূরে ৬৪ একর নিজস্ব জমিতে এর শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে। কিন্তু সে যাত্রাও এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী-শিক্ষকদের জন্য খুব সুখকর সময় উপহার দিতে পারেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বরাদ্দকৃত ডিপিপি’র আওতায় কোনো ভবন নির্মাণ শুরু করা যায়নি দীর্ঘ বছরে, তৈরি হয়নি কোনো গবেষণা ল্যাব এবং স্থাপিত হয়নি ছাত্রছাত্রীদের জন্য কোনো আবাসিক ভবন। ভীষণ দীনহীন ও একেবারেই অপ্রতুল অবয়বে উপাচার্যকে দাপ্তরিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়েছে। রাষ্ট্রের ফ্যাসিবাদী কাঠামোর কারণে অন্যান্য আর ১০টি প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো এখানেও উপাচার্য নিয়োগ করা হয়েছে ব্যবসা অনুষদের শিক্ষকদের মধ্য থেকে। ফলে বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতা অর্জনের জন্য যেরকম ভিশন সামনে রাখা দরকার ছিল, তা অনুপস্থিতই রয়ে গেছে। এ রকম বাস্তবতায় এদেশের ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে হাজির হয় ২০২৪ সালের ৩৬ জুলাই। গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। প্রথমবারের মতো বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়োডাটা যাচাই করে দেখে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয়। সে প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের দায়িত্ব প্রদান করা হয় আমাকে। তার পর থেকে প্রতিনিয়তই দেখছি কেমন করে বদলে যাচ্ছে বিমর্ষতার ছোঁয়ায় ভরা এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবয়ব।

গবেষণা যখন অগ্রাধিকার

এখানে গবেষণা কাজ তথা গবেষণার পরিবেশ এর আগে শুরুই করা হয়নি। আমরা এরই মধ্যে নতুনভাবে শুরু করেছি রিসার্চ এবং ইনোভেশন ম্যানেজমেন্ট সেল (আরআইএমসি), যার মাধ্যমে শিক্ষকদেরকে গবেষণায় উৎসাহিত করার জন্য নেওয়া হয়েছে নানামাত্রিক উদ্যোগ। গবেষণার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকপ্রতি দু-তিন লাখ টাকা গবেষণা বরাদ্দ প্রদান, কিউ-১ জার্নালে প্রকাশের জন্য প্রথমবারের মতো ইনসেনটিভ প্রদান, সব শিক্ষকের নিয়োগ-পদোন্নতিতে স্কোপাস ইনডেক্সডসহ উঁচু মানের জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাপত্রকে সর্বোচ্চ মূল্যায়নের ব্যবস্থা করা হয়েছে। দেশে এবং দেশের বাইরে কনফারেন্স, সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামে অংশগ্রহণ এবং গবেষণা উপস্থাপনে বাড়ানো হয়েছে কনফারেন্স গ্রান্ট। ফলে শিক্ষকেরা রাবিপ্রবিতে সম্পাদিত গবেষণাকে বিশ্বদরবারে উপস্থাপনের জন্য উৎসাহিত হবেন বলে বিশ্বাস করি। এরই মধ্যে রিসার্চ অ্যান্ড ইনোভেশন হাব স্থাপনের জন্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে ৮৬২ কোটি টাকার প্রজেক্ট। গবেষণার জন্য এরই মধ্যে প্রায় ৩০ লক্ষাধিক টাকার যন্ত্রপাতি ক্রয় করা হয়েছে। আরআইএমসি সেন্টারের সংস্কার এবং সামগ্রিক ল্যাব ডিজাইনের কাজ শেষ হবে এ মাসেই বলে আশা করা যাচ্ছে। ফলে ছাত্রছাত্রীদের ল্যাবে গিয়ে গবেষণা করতে না পারার হতাশা কাটবে বহুলাংশে, সম্পৃক্ততা তৈরি হবে গবেষণার সঙ্গে।

বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আমাদের কোলাবরেশন প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে এরই মধ্যে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে তুরস্ক ও চায়নার একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে, যে চুক্তির ফলে রাবিপ্রবির শিক্ষক-ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে বিশ্বের অন্যান্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞান ও গবেষণার আদান-প্রদান সহজ হবে। বাড়িয়ে বলা হবে না যে, এরই মধ্যে বিশ্বসেরা অ্যালপার ডগার (এডি) সায়েন্টিফিক ইনডেক্সের প্রকাশিত র‍্যাংকিংয়ে বিশ্বসেরা গবেষকদের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪ জন শিক্ষক। এছাড়া এলসেভিয়ার নামক প্রকাশনা জরিপ অনুসারে প্রতিবছর বিশ্বের সেরা দুই শতাংশ গবেষকের তালিকায়ও স্থান করে নিয়েছেন রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষক।

ছাত্রছাত্রীরাই হোক মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু

বলতে দ্বিধা নেই, রাবিপ্রবিতে ছাত্রছাত্রীদের আবাসন সুবিধা একেবারেই অপ্রতুল। বাসা ভাড়া করে হলের কাজ চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে। তবে আমি যোগদানের পরপরই বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারপ্ল্যান চূড়ান্ত করে করা হয়েছে। স্থানীয় বিভিন্ন গ্রুপের শত বাধা সত্ত্বেও আমরা আমাদের লক্ষ্যে স্থির থেকেছি। কাজ শুরু করেছি একটি প্রশাসনিক ভবন, একটি একাডেমিক ভবন, একটি ছাত্র হল ও একটি ছাত্রী হলের, যেগুলোর কাজ শেষ হবে আগামী ২০২৬ সালের ৩০ জুনে। এ চারটি ভবন মাথা উঁচু করে দাঁড়ালে এ বিশ্ববিদ্যালয় যে নতুন রূপ পরিগ্রহ করবে তার তুলনা হবে রাবিপ্রবি শুধু নিজেই, কারণ পাহাড় আর লেকের মাখামাখির মাঝে বাংলাদেশের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবনগুলোর নান্দনিকতাও অসাধারণ। নতুন ডিপিপি প্রণয়নের কাজ এগিয়ে চলেছে একইসঙ্গে। তবে আমাদের আপাত অসুবিধাগুলোকেও আমরা আমাদের দৃষ্টির বাইরে রাখিনি। ভাড়া বাসার দুটো হলকেই পরিপূর্ণ সংস্কার করা হয়েছে, বিশেষ করে ছাত্র হলকে আদ্যোপান্ত সংস্কার করা হয়েছে।

rang5

ভাড়া হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব অর্থায়নে রুচিশীল পরিবেশ তৈরি করে দুটি হলের জন্যই ছাত্রছাত্রীদের চাহিদার সঙ্গে মিল করে চালু করা হয়েছে ডাইনিং সিস্টেম, প্রদান করা হচ্ছে ভর্তুকি, যা তাদের সাশ্রয় প্রদান করার ক্ষেত্রে অনেকখানি সাহায্য করছে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেও ছিল না ক্যাফেটেরিয়া। পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ক্যাটারার নিয়োগ করা হয়েছে। চালু হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাফেটেরিয়া, যদিও তার মানোন্নয়ন প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে রাঙ্গামাটিতে গেস্ট হাউস চালু করা যায়নি। যোগদানের পর অন্য উদ্যোগের সঙ্গে সমানতালে গেস্ট হাউস চালুর উদ্যোগকেও এগিয়ে নিয়েছি। নতুন নতুন সব আসবাবপত্র বানানো এবং নতুন পর্দা লাগানোর পর্বগুলো আমাদের একটি প্রতিষ্ঠানের বেড়ে ওঠবার সঙ্গে কী যত্নে গেঁথে দিয়েছে, তা মনে থাকবে বহুকাল। বলা যায়, মেহমানদের স্বাচ্ছন্দ্য পূরণে টুকটাক লজিস্টিকসের কোনোটা বাদ রাখিনি। মেহমানদের জন্য ওয়াশিং মেশিন, প্রতিটি কক্ষে দৃষ্টিনন্দন নকশিকাঁথাসহ সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা আপনাকে টানবে রাবিপ্রবির এই গেস্ট হাউস।

যে কথাটি না বললেই নয় তা হলো, দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই একটি ‘ক্লিন ক্যাম্পাস মুভ’ তৈরি করা। পুরো ক্যাম্পাস ক্লিন করার পাশাপাশি শ্রেণিকক্ষগুলো পরিপূর্ণভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে, জানালা-দরজা রঙ করা হয়েছে, সব চেয়ার-টেবিল যেগুলো ছাত্রছাত্রীদের অপ্রয়োজনীয় লেখালিখি আর আঁকিবুকির কারণে ভীষণ অপরিচ্ছন্ন হয়েছিল, সেগুলোকে রঙ করা হয়েছে। একটি পরিচ্ছন্ন ক্যাম্পাস ও পরিচ্ছন্ন কক্ষের মোটিভেশন দেওয়া হয়েছে ছাত্রছাত্রীদের। এ মুহূর্তে রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ভিজিট করলে আপনি কোথাও এক টুকরো অপ্রয়োজনীয় কাগজ পড়ে থাকতে দেখবেন না। পরিচ্ছন্নতা আর নান্দনিকতা যে একটি শিল্পে পরিণত হয়েছে, রাবিপ্রবি ক্যাম্পাসে প্রবেশ করলেই তা লক্ষ করবেন। উন্নয়ন কাজের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল প্রবেশপথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমরা ২৫ মে শুরু করে জুন মাসে যে ব্রিজটি তৈরি করেছি, তা এককথায় রাঙ্গামাটির ঝুলন্ত ব্রিজকে ম্লান করে দিয়েছে। শৈল্পিকতার এ অবয়ব আমাদের দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তবতায় বেশ খানিকটা বেমানান উদাহরণ তৈরি করে চলেছে।

নতুন স্থাপনার মধ্যে আরো চলমান রয়েছে প্রশাসনিক ভবন-২-এর ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ কাজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব পরিবহন পুল নির্মাণ, সাবস্টেশন নির্মাণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল গেট নির্মাণ, অ্যাক্সেস রোডসহ আরো বেশ কিছু কাজ। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে এসব কাজ পূর্ণতা পেলে রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় যে একটি নতুন উচ্চতা অর্জন করতে যাচ্ছে, তা বলা যায় নিঃসন্দেহে। আমরা এরই মধ্যে আমাদের জন্য স্লোগান ঠিক করেছি, ‘মাই ক্যাম্পাস মাই প্রাইড।’ সময়োপযোগী নতুন বিভাগ, পর্যাপ্ত শিক্ষক, আর স্থাপনার সংকট কাটানো গেলে দুই হাজার ছাত্রজনতার শাহাদাত আর শত সহস্র মানুষের পঙ্গুত্বের বিনিময়ে অর্জিত ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশে পার্বত্য এলাকার একমাত্র পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দক্ষতা, যোগ্যতা ও সততার সম্মিলন আর ছাত্রছাত্রীদের সহযোগিতায় পাহাড়ের উচ্চতা আর লেকের বিস্তীর্ণ জলরাশির বিশালতা নিয়ে এ অঞ্চলের মানুষের জীবনমানের উন্নয়নে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলবে, সে প্রত্যাশা আমাদের সবার।

পাহাড়ি সংস্কৃতির সঙ্গে জীবনের যোগসূত্র তৈরিতে রাবিপ্রবি

জ্ঞান উৎপাদন ও জ্ঞান বিতরণের পাশাপাশি পাহাড়ের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবন ও সংস্কৃতির সঙ্গে সমতলের অন্যান্য শিক্ষার্থীর সম্প্রীতির বন্ধন তৈরি, জীবনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ, সমাজ-সংস্কৃতির সঙ্গে জীবনঘনিষ্ঠ উপযোগ তৈরিতে পাহাড়ের নানা গোষ্ঠী যেমন চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যাসহ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের নানা বিচিত্র সংস্কৃতি, ভাষা ও ঐতিহ্যকে বেঁধে রাখতে শুরু করা হয়েছে রাবিপ্রবি ক্যারিয়ার ক্লাব, রাবিপ্রবি ডিবেটিং ক্লাব, রাবিপ্রবি সাংবাদিক সমিতি, রাবিপ্রবি রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, রাবিপ্রবি বিএনসিসি, রাবিপ্রবি ফটোগ্রাফি ক্লাব, রাবিপ্রবি ট্যুরিজম ক্লাব। ‘রাবিপ্রবি সেন্টার ফর ইনোভেশন অ্যান্ড অন্ট্রাপ্রেনারশিপ’-এর যাত্রা শুরু হয়েছে এবং বাংলাদেশের খ্যাতনামা অন্ট্রাপ্রেনারশিপ মোটিভেটরদের যুক্ত করা হয়েছে এর সঙ্গে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা প্রকল্পগুলোয় পাহাড়ের পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য ও স্থানীয় সমস্যাগুলোর সমাধান, পাহাড়ি কৃষির উন্নয়ন, বনজ চিকিৎসার আধুনিকায়ন, পর্যটন ও পরিবেশ সংরক্ষণকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে।

শিক্ষার্থীদের ভাবনাগুলোকে মূল্যবান করে তোলার চেষ্টায় রাবিপ্রবি

সেশনজট-মুক্ত ও আবাসন সংকটহীন ক্যাম্পাস, পুষ্টিকর খাবার, পর্যাপ্ত ল্যাব সুবিধা এবং উচ্চতর ডিগ্রিধারী মানবিক শিক্ষক, ক্যাম্পাসে পর্যাপ্ত বসার জায়গা, নিয়মিত জবফেয়ার আয়োজন, সহশিক্ষা-কার্যক্রমে সহযোগিতা বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান, একটি নৈতিক ক্যাম্পাস—ছাত্রছাত্রীদের এসব চাওয়া এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেগুলার এজেন্ডার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় পাহাড়ের গল্পের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি শুধু একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, বরং পাহাড়ি জীবনের প্রতিচ্ছবি, সংস্কৃতির ধারক ও ভবিষ্যতের পথপ্রদর্শক। রাবিপ্রবি যেন পাহাড়ের হৃৎস্পন্দন, যা প্রতিটি শিক্ষার্থীর স্বপ্নে, প্রতিটি গবেষণায় আর প্রতিটি উৎসবে জীবন্ত হয়ে ওঠে। এই গল্প চলবে, পাহাড়ের সঙ্গে, রাবিপ্রবির হাত ধরে। সুসম্পন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়ন আর সব অংশীজনের সহযোগিতা এ গল্পকে আরো সমৃদ্ধ করবে। মেঘ-পাহাড়-লেকবেষ্টিত প্রাকৃতিক দৃষ্টিনন্দন ক্যাম্পাস সত্যি সত্যিই হয়ে উঠবে দেশি-বিদেশি শিক্ষার্থী-গবেষকদের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু। রাবিপ্রবি হয়ে উঠুক—‘মাই ক্যাম্পাস মাই প্রাইড।’

উপাচার্য, রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত