আমার দেশ জনপ্রিয় বাংলা নিউজ পেপার

হাদির ভাঙা পেনসিল

মুহাম্মদ কামাল হোসেন

হাদির ভাঙা পেনসিল

সকালটা ছিল অন্য দিনের চেয়ে একটু আলাদা। স্কুল প্রাঙ্গণে তখনো ঘণ্টা বাজেনি। কেউ মাঠে দৌড়াচ্ছে, কেউ গল্প করছে, কেউ আবার চুপচাপ বেঞ্চে বসে আছে। বাতাসে বই আর খাতার গন্ধ, দূরে পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। জানালার কাচ দিয়ে নরম রোদ ঢুকছিল ক্লাসরুমে। সব মিলিয়ে স্কুলটাকে আজ যেন একটু অন্যরকম লাগছিল।

এই সময়টায় রায়হান সাধারণত হাসিখুশি থাকে। কিন্তু আজ তার মনটা কেমন অস্থির। কেন এমন লাগছে, সে নিজেও ঠিক বুঝতে পারছিল না। মনে হচ্ছিল, আজকের দিনটা তাকে কিছু একটা শেখাবে, হয়তো একটু পরীক্ষা নেবে।

বিজ্ঞাপন

ক্লাস শুরু হওয়ার আগে জানালার পাশে বসে রায়হান চুপচাপ খাতার পাতা উল্টাচ্ছিল। হঠাৎ পেনসিলটা বের করতেই সে থমকে গেল। পেনসিলের মাথাটা ভাঙা। কাল রাতে পড়তে পড়তে পেনসিলটা মেঝেতে পড়ে গিয়েছিল। তখন সে বিষয়টায় গুরুত্ব দেয়নি। এখন বুঝতে পারছে, আজ এই ভাঙা পেনসিলই তার সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে।

রায়হান পেনসিলটা হাতে নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করল। লিখলে দাগ ঠিকমতো আসে না। পাশে বসা বন্ধুরা নিজেদের পেনসিল শান দিচ্ছে, কেউ কেউ নতুন রঙিন পেনসিল দেখাচ্ছে। রায়হান কিছু বলল না। সে শুধু নিজের ভাঙা পেনসিলটার দিকে তাকিয়ে রইল।

ঠিক তখন ক্লাসে ঢোকার সময় দেয়ালে টানানো একটি পোস্টারের দিকে তার চোখ পড়ল। পোস্টারে লেখা ছিল শহীদ শরীফ ওসমান হাদির একটি কথা। কথাটা সে আগেও শুনেছে। লেখা ছিল—‘সাহস মানে সবকিছু ঠিক থাকা নয়। সাহস মানে যা আছে তা দিয়েই সঠিক কাজ করা।’

রায়হান পোস্টারের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। ‘হাদি’ নামটা তার পরিচিত। বড়রা অনেক সময় তার কথা বলেন। তিনি সাহস আর ন্যায়ের কথা বলতেন। রায়হান গভীরভাবে কথাটার মানে ভাবল।

গণিত ক্লাস শুরু হলো। শিক্ষক বোর্ডে অঙ্ক লিখলেন। সবাই খাতায় লেখা শুরু করল। রায়হান ধীরে ধীরে লিখছিল। পেনসিলটা ভাঙা বলে লিখতে কষ্ট হচ্ছিল। ভুল হলে মুছতে সময় লাগছিল। তবু সে থামল না। সে মনে মনে বলল, চেষ্টা করতেই হবে।

একসময় পেছন থেকে কেউ ফিসফিস করে বলল, ‘এত ধীরে কেন?’

রায়হানের গলা শুকিয়ে গেল। সে মাথা নিচু করে লিখে যেতে লাগল।

শিক্ষক খাতা দেখতে এসে তার পাশে দাঁড়ালেন। কিছুক্ষণ চুপ করে দেখলেন। তারপর বললেন, অঙ্ক ঠিক আছে। একটু ধীরে হলেও তুমি মন দিয়ে করেছ।

এই কথায় রায়হানের বুক হালকা হয়ে গেল। সে আবার পোস্টারের কথাটা মনে করল। হাদির কথাটা যেন আজ তার জন্যই লেখা।

বিরতির সময় সবাই মাঠে গেল। রায়হান বেঞ্চে বসে ভাঙা পেনসিলটার দিকে তাকাল। সে ভাবল, ভাঙা হলেও এটা এখনো লিখছে। সে মনে মনে বলল, আমি পারব।

তার মনে হলো, এই পেনসিলটা শুধু ভাঙা নয়, এটা তাকে ধৈর্য আর সাহস শেখাচ্ছে। হাদির কথা যেন নীরবে তাকে পথ দেখাচ্ছিল।

বিরতির ঘণ্টা শেষ হলে সবাই আবার ক্লাসে ফিরল। রায়হান নিজের বেঞ্চে বসে ব্যাগ খুলল। ভাঙা পেনসিলটা সে যত্ন করে খাতার পাশে রাখল। এখন আর তার মন খারাপ লাগছিল না। মনে হচ্ছিল, এই পেনসিলটা আজ তাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে।

পরের ক্লাসে বাংলা পড়া ছিল। শিক্ষক বললেন, আজ সবাই একটি ছোটগল্প লিখবে। গল্পে থাকবে সততা আর সাহসের কথা। রায়হান একটু থমকে গেল। ‘সাহস’ শব্দটা শুনেই তার মনে সকালের সেই পোস্টারের কথা ভেসে উঠল।

রায়হান পেনসিল হাতে নিল। শুরুতে তার হাত একটু কাঁপছিল। তারপর সে লিখতে শুরু করল। সে লিখল একজন ছেলের কথা, যে ভাঙা পেনসিল নিয়েও হাল ছাড়ে না। লেখার মাঝখানে পেনসিলটা আবার একটু ভেঙে গেল। তবু রায়হান থামল না।

এক বন্ধু ফিসফিস করে বলল, ‘তোমার তো পেনসিল ভাঙা!’

রায়হান আস্তে বলল, ‘তবু লেখা যায়।’

কিছুক্ষণ পর এক ছোট মেয়ে এসে দাঁড়াল। সে বলল, ‘আমার পেনসিল ভেঙে গেছে। আমি শেষ লাইনটা লিখতে পারছি না।’ রায়হান নিজের ভাঙা পেনসিলটা এগিয়ে দিল। মেয়েটি খুশি হয়ে লিখে নিল।

লেখা শেষে শিক্ষক খাতা দেখলেন। বললেন, গল্পটা সুন্দর হয়েছে।

রায়হান হাসল। তার চোখে তখন ভাঙা পেনসিলটা আর ভাঙা মনে হচ্ছিল না।

স্কুল ছুটির পর বাড়ি ফিরে সে পেনসিলটা তুলে রাখল। সে জানত, নতুন পেনসিল আসবে। তবু এই ভাঙা পেনসিল তাকে মনে করিয়ে দেবে—‘সাহস শুরু হয় ছোট জায়গা থেকে। আর সেই সাহসের পথে হাঁটতে শিখিয়েছে হাদির কথা, হাদির আদর্শ।’

Google News Icon

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন