অদৃশ্য মায়াজালের বাহারি পসরা

আল মাসুম হোসেন
প্রকাশ : ২০ মে ২০২৫, ১২: ৩৫

কুমিল্লা শহর থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে কোটবাড়ীর সালমানপুরে ছোট-বড় লালমাটির পাহাড়ের কোলে অবস্থিত কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় (কুবি), যেখানে প্রকৃতির রঙতুলির আঁচড়ে ছবি এঁকেছেন স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা।

প্রতিটি ঋতুই এখানে মেলে ধরে তার নিজস্ব সৌন্দর্য, ছড়ায় মুগ্ধতা এবং তৈরি করে মোহনীয় আবেশ। বৈশাখ মাসে গ্রীষ্মের আগমনীতে এখানকার পরিবেশ যেন বেশিই সক্রিয় তার রূপে শিক্ষার্থী ও দর্শনার্থীদের মন ভোলাতে।

বিজ্ঞাপন

বসন্ত শেষে বৈশাখের আগমনে তাপমাত্রা বেড়ে যখন গরমে অতিষ্ঠ জনজীবন, সেখানে প্রকৃতির খামখেয়ালিপনায় কুবিতে তখন ফুল ও ফলের গন্ধ। প্রকৃতি এ সময় বিভিন্ন রঙের বাহারি পসরা সাজিয়ে সৃষ্টি করে অদৃশ্য মায়াজাল। এই মায়াজাল ছিন্ন করে, তার সাধ্য আছে কার?

গ্রীষ্মকালে যেকোনো সময়ে ক্যাম্পাসে পা রাখতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের নামখচিত ফটকের সামনেই অভ্যর্থনা জানায় গোলাপি-সাদা রঙের ক্যাসিয়া জাভানিকা। এই ফুলের বাংলা নাম হলো সোনাইল, নামকরণ করেন অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা। এই ফুল উন্নতি ও সৌভাগ্যের প্রতীক। অভ্যর্থনা শেষে চোখে পড়ে বাঙালির চেতনার প্রতীকী লালরঙা কৃষ্ণচূড়া ফুল। কৃষ্ণচূড়া গাছের লাল রক্তিম ফুল প্রকৃতির সব রঙকে ফিকে করে দেয়। সকালে গাছের নিচে কৃষ্ণচূড়ার ঝরে পড়া রক্তলাল পাপড়ি যেন লাল গালিচায় সংবর্ধনা দেয় বিশ্ববিদ্যালয় অনুরাগীদের। ক্যাম্পাসের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ, কলা ও মানবিক অনুষদ, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ ও বিজ্ঞান অনুষদসহ কেন্দ্রীয় ক্যাফেটেরিয়া থেকে শহীদ মিনারের পুরো সড়ক কৃষ্ণচূড়া ফুলের দ্যুতিময়তা নজর কাড়ে গ্রীষ্ম ঋতুতে।

মুক্তমঞ্চ থেকে ক্যাফেটেরিয়া পর্যন্ত রোডটি যেন বেগুনি জারুল ফুলের পসরা। প্রচণ্ড রোদে এর ছায়া পথিকের জন্য বেগুনি সবুজ ছাতার ব্যবস্থা করে। তবে কুবিকে কৃষ্ণচূড়ার রাজ্য বলে আখ্যায়িত করলে ভুল হয় না। ক্যাফেটেরিয়া থেকে শহীদ মিনারের রাস্তা পুরোটাই কৃষ্ণচূড়া ফুলে সুসজ্জিত থাকে। এ সময় মনে হয় তরুণীর চুলের কেশে লাল ফিতে বাঁধা, যা সর্বদা দোদুল্যমান। তাই তো শিক্ষার্থীরা ভালোবেসে নাম দিয়েছে কৃষ্ণচূড়া রোড। এ ছাড়া থোকা থোকা সোনালু ফুলের মাল্য খুঁজে পাওয়া যায় অনেক জায়গায়। এ সময় ক্যাম্পাসের যেদিকে তাকানো যায় চারদিকে হলুদ, সাদা, বেগুনি, লাল ইত্যাদি বাহারি রঙের ফুল মন ছুঁয়ে যায়।

প্রতি ঋতুতেই অনেক রকমের ফুল ফোটে, কিন্তু গ্রীষ্ম এলেই প্রকৃতি দুহাত ভরে ঢেলে দেয় তার রূপ ও সৌন্দর্য। কৃষ্ণচূড়া গাছের রক্তরাঙা ছায়া, জারুলের বেগুনি দীপ্তমূর্তি, ঝাঁকড়া চুলের মতো সোনালুর ঝাড়, সোনাইলের গোলাপি আভা ও শিমুলের সাদা শুভ্রতা মিলেমিশে তৈরি করে চিত্রশিল্পীর তুলির আঁচড়ে তৈরি প্রাকৃতিক ক্যানভাস।

বসন্তের পরে গ্রীষ্ম মানেই কৃষ্ণচূড়ার ঋতু, এটাই কুবির সবচেয়ে রঙিন সময়। কৃষ্ণচূড়ার নিচে দাঁড়িয়ে বন্ধুদের সঙ্গে ছবি তোলা, আড্ডা দেওয়া, গানের আসর কিংবা একাকী বসে কবিতা লেখা—এসব যেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহমান ঐতিহ্যের অংশ হয়ে উঠেছে। তা ছাড়া গ্রীষ্মকালে পাকা কাঁঠাল ও আমের গন্ধে মো-মো করে এখানকার চারদিকের পরিবেশ।

ফার্মেসি বিভাগে অধ্যয়নরত ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ইয়াবিদ আল ইজাজ বলেন, ‘প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও আধুনিক শিক্ষার অপূর্ব সমন্বয় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। সবুজে ঘেরা পাহাড়ি টিলার কোলে গড়ে ওঠা এ বিশ্ববিদ্যালয়ের চারপাশে বিস্তৃত বৃক্ষরাজি, ছায়াময় পথ ও মনোমুগ্ধকর কৃষ্ণচূড়া রোড যেন প্রকৃতির এক অনন্য উপহার। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে ক্যাম্পাসে বেগুনি লাল ফুলের ডালে পাখির কিচিরমিচির, শীতল হাওয়া, খোলা আকাশের নিচে পড়াশোনার পরিবেশ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মনকে প্রশান্ত করে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি একাডেমিক ভবন, গ্রন্থাগার, প্রশাসনিক দপ্তর ও ছাত্রী-ছাত্রাবাসের চারপাশের জারুল কৃষ্ণচূড়া, সোনালু ফুল সৌন্দর্যবোধ ও গঠনশৈলীর পরিচায়ক। সন্ধ্যায় ক্যাম্পাসে ল্যাম্পপোস্টের আলোর ফুল থেকে বিকিরিত আভা গড়ে তোলে মোহময় পরিবেশ। শান্ত, নিরিবিলি ও মনোরম এ ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরা যেন প্রকৃতির মাঝে জ্ঞান অন্বেষণের এক আদর্শ পরিবেশে বেড়ে ওঠে। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু শিক্ষায় নয়, সৌন্দর্যেও অনন্য।’

বাংলা বিভাগে অধ্যয়নরত ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী নাদিয়া আফরিন শোভা বলেন, ‘ভোরের আলো ছুঁয়ে গেলে ফুলেরা যেন প্রথম কথা বলে। সকালে মৃদু হাওয়ায় ভেজা পাপড়িগুলো কাঁপে বাতাসের আদরে। জিনিয়া, গাঁদা, গোলাপ ও কৃষ্ণচূড়া যেন ক্যাম্পাসকে নতুন রূপ উপহার দিয়েছে। পাহাড়তলি রোড থেকে কৃষ্ণচূড়া রোডের দিকে তাকালেই মনে হয় যেন কোনো এক ফুলের রাজ্যে হারিয়ে গেছি। মৃদু বাতাসে ফুলের গন্ধ যেন চারদিক মুগ্ধ করে রেখেছে। সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে লাল কৃষ্ণচূড়া ফুল যেন কথা বলে। পিএ চত্বরে মন খারাপের কোনো এক দুপুরে একাকী হাঁটলে মনে হয় ফুটে থাকা জারুল ফুল যেন সঙ্গী হয়ে উঠেছে। ক্লাসের শেষে পড়ন্ত বিকালে ক্লান্ত মুখে যখন ফুলের দিকে তাকাই তখন ফুল যেন বলে ওঠে—‘তুমি যতটা ক্লান্ত হও না কেন, সৌন্দর্য এখনো বেঁচে আছে ঠিক তোমার চারপাশে।’

শিক্ষার্থী, ফার্মেসি বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত