জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

ঐতিহ্যের শিকড়ে গাঁথা সম্ভাবনার ভবিষ্যৎ

ফাহিম হাসনাত
প্রকাশ : ১৯ আগস্ট ২০২৫, ১১: ০৮
আপডেট : ১৯ আগস্ট ২০২৫, ১১: ২২

পুরান ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে ভিক্টোরিয়া পার্ক বা বাহাদুর শাহ পার্কের কোলাহল ছাপিয়ে লাল ইটের গায়ে লেগে আছে সময়ের সোনালি আঁচড়। এটি শুধু স্থাপত্য নয়, এটি এক জীবন্ত ইতিহাস, জ্ঞানের অহর্নিশ আলোকবর্তিকা—জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। দেড় শতাব্দীরও অধিককাল ধরে দাঁড়িয়ে থাকা এই বিদ্যাপীঠ শুধু শিক্ষার্থীই তৈরি করেনি, গড়ে তুলেছে জাতির বিবেক, সংগ্রামী চেতনা ও সম্ভাবনার ধারক-বাহক। ঐতিহ্য, সংগ্রাম আর অদম্য সম্ভাবনার এক অপূর্ব মেলবন্ধনেই এগিয়ে চলেছে এই প্রতিষ্ঠান।

বিজ্ঞাপন

শিকড়ের গভীরে : ইতিহাসের ধারক-বাহক

জগন্নাথের পথচলা শুরু ১৮৫৮ সালে, ঢাকা ব্রাহ্ম স্কুল হিসেবে। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে আধুনিক শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার এক মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে এর প্রতিষ্ঠা হয়। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি দ্রুতই জ্ঞানের পীঠস্থানে পরিণত হয়। ১৮৭২ সালে বালিয়াটির তৎকালীন প্রভাবশালী ও বিদ্যোৎসাহী জমিদার কিশোরীলাল রায় চৌধুরী তার বাবা জগন্নাথ রায় চৌধুরীর পুণ্য স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এর নামকরণ করেন জগন্নাথ স্কুল। এখান থেকেই শুরু হয় প্রতিষ্ঠানটির নতুন অগ্রযাত্রা, যা বাঙালি সমাজে জ্ঞানচর্চার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।

শিক্ষানুরাগী কিশোরীলালের হাত ধরে ১৮৮৪ সালে এটি একটি দ্বিতীয় শ্রেণির কলেজে এবং এর মাত্র দুই যুগ পর ১৯০৮ সালে প্রথম শ্রেণির কলেজে রূপান্তরিত হয়। সে সময়ে ঢাকা কলেজ ও জগন্নাথ কলেজ ছিল পূর্ববঙ্গের উচ্চশিক্ষার দুটি প্রধান স্তম্ভ। এই প্রতিষ্ঠান দুটিই ছিল বাঙালি মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্তের সন্তানদের জ্ঞানার্জনের প্রধানতম আশ্রয়, যা পূর্ববঙ্গের আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।

Rezaul-Karim_Jagannath-University

সংগ্রামের স্মারক : রক্তে লেখা অধ্যায়

জগন্নাথ শুধু পড়ালেখার স্থান নয়, এখানকার মাটি সিঞ্চিত হয়েছে সংগ্রামী সন্তানদের রক্তে। ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় পর্যন্ত প্রতিটি ঐতিহাসিক বাঁকে এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের ভূমিকা ছিল গৌরবোজ্জ্বল ও অনস্বীকার্য—

ভাষা আন্দোলন (১৯৫২) : ভাষা আন্দোলনের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ যখন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে, তখন জগন্নাথ কলেজের ছাত্ররা ছিলেন অগ্রভাগে। এই আন্দোলনের প্রথম শহীদ রফিক উদ্দিন আহমেদ। তিনি ছিলেন এই কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। তার আত্মত্যাগ এই আন্দোলনের এক অবিস্মরণীয় অংশ। ১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ছাত্র ধর্মঘটে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগে তৎকালীন সরকার কর্তৃক বহিষ্কৃত হন আবদুল মতিন, গাজীউল হক, অলি আহাদসহ অনেক সাহসী ছাত্রনেতা। এই প্রতিষ্ঠানের কলেজ গেটেই পুলিশের গুলিতে আহত হন ছাত্রনেতা কাজী গোলাম মাহবুব, যা ভাষা আন্দোলনের তীব্রতাকে আরো প্রকট করে তোলে।

Jaagannath-University-2

শিক্ষা আন্দোলন (১৯৬২) ও ছয় দফা (১৯৬৬) : সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন এবং বাঙালির মুক্তির সনদ হিসেবে পরিচিত ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলনে জগন্নাথের ছাত্র-শিক্ষকের বলিষ্ঠ ও স্বতঃস্ফূর্ত ভূমিকা ছিল। তাদের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর তৎকালীন স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে এক বলিষ্ঠ প্রতিরোধ গড়ে তোলে।

গণঅভ্যুত্থান (১৯৬৯) : ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে জগন্নাথ কলেজের ছাত্রদের অংশগ্রহণ ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, যা আইয়ুব শাহির পতনে সহায়ক হয়েছিল।

মুক্তিযুদ্ধ (১৯৭১) : এক ভয়াবহ ও গৌরবময় অধ্যায়। ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কলেজের ছাত্রাবাসে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায়। নিরীহ ছাত্র, শিক্ষক ও কর্মচারীদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়, যা ছিল মানবতাবিরোধী এক জঘন্য অপরাধ। প্রতিষ্ঠান প্রাঙ্গণে গণকবরের সন্ধান মেলে, যা আজও সেই নির্মমতার সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। মুক্তিযুদ্ধকালে পুরো ৯ মাস এই ক্যাম্পাস পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসরদের নির্যাতন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। অনেক ছাত্র-শিক্ষক সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন, অনেকে মুজিবনগর সরকারের কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন।

Jaagannath-University-3

পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় : এক নতুন যাত্রা

স্বাধীনতার পর জগন্নাথ কলেজ তার গৌরব ধরে রাখলেও একটি পূর্ণাঙ্গ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা লাভ ছিল সময়ের দাবি। এই দাবি আদায়ে ছাত্র-শিক্ষকদের রাজপথে নামতে হয়েছে বারবার, করতে হয়েছে দীর্ঘ ও রক্তক্ষয়ী আন্দোলন। অবশেষে সব চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ২০০৫ সালের ২০ অক্টোবর জাতীয় সংসদে ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০০৫’ পাস হয়। ২০০৫ সালের ২১ অক্টোবর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শুভ উদ্বোধন করেন। এর মাধ্যমে পূরণ হয় লাখো মানুষের এক দীর্ঘদিনের স্বপ্ন। অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম খান হন প্রথম উপাচার্য। এটি বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছিল, কারণ জগন্নাথই প্রথম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ২০০৫-০৬ শিক্ষাবর্ষ থেকে স্নাতক পর্যায়ে সেমিস্টার পদ্ধতি ও গ্রেডিং সিস্টেম চালু করে, যা পরে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ও অনুসরণ করে।

একাডেমিক উৎকর্ষ ও উদ্ভাবনী শক্তি

বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সাতটি অনুষদের (কলা, সামাজিক বিজ্ঞান, প্রাণ ও ধরিত্রী বিজ্ঞান, বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা, আইন ও চারুকলা অনুষদ) অধীনে ৩৮টি বিভাগ ও দুটি ইনস্টিটিউটে (শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউট) প্রায় ২২ হাজার শিক্ষার্থী জ্ঞান অর্জন করছেন। প্রায় ৭৫০ জন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকের মেধা ও শ্রমে সমৃদ্ধ এই বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে জ্ঞানচর্চার এক বিশাল কর্মযজ্ঞ।

গবেষণার উৎকর্ষ : জগন্নাথের গবেষণার সাফল্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। স্পেনের সিমাগো র‍্যাংকিংয়ে রসায়ন বিভাগ বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে গবেষণায় শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে। পদার্থবিজ্ঞান, প্রাণরসায়ন, ফার্মেসি ও গণিত বিভাগের গবেষণাও আন্তর্জাতিক মহলে প্রশংসিত। শিক্ষকদের নেতৃত্বে চলছে নানা উদ্ভাবনী কাজ। উদাহরণস্বরূপ, পরিত্যক্ত পলিথিন থেকে পরিবেশবান্ধব জ্বালানি তেল (পেট্রোল ও ডিজেল) উৎপাদন, সৌরশক্তির উন্নত ব্যবহার, দূষণ নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তি এবং স্থানীয় সম্পদ ব্যবহার করে ওষুধ উৎপাদনসহ বিভিন্ন গবেষণা দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা করোনাভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ে সফলতা অর্জন করেছেন, যা দেশের স্বাস্থ্য গবেষণায় এক গুরুত্বপূর্ণ অবদান।

প্রকাশনা ও আধুনিক পদ্ধতি : শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের গবেষণা প্রবন্ধ নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে দেশ-বিদেশের নামকরা জার্নালে (যেমন: Elsevier, Springer, IEEE প্রভৃতি), যা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার মানকে বৈশ্বিক পর্যায়ে তুলে ধরছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব জার্নালগুলোর মানও ক্রমেই উন্নত হচ্ছে। আধুনিক শিক্ষাদান পদ্ধতির ক্ষেত্রেও জগন্নাথ এগিয়ে। সেমিস্টার পদ্ধতির পাশাপাশি ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম, ডিজিটাল লাইব্রেরি সুবিধা এবং বিভিন্ন বিভাগে আধুনিক ল্যাব (যেমন: উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন HPLC, GC-MS, NMR, জিন এক্সপ্রেশন ল্যাব, ন্যানো টেকনোলজি ল্যাব) স্থাপন করা হয়েছে, যা শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে গবেষণার সুযোগ করে দিচ্ছে।

Jaagannath-University-4

ক্যাম্পাস জীবন : প্রাণের স্পন্দন

সীমিত পরিসরে গড়ে উঠলেও জগন্নাথ ক্যাম্পাস সর্বদাই প্রাণবন্ত ও মুখর থাকে শিক্ষার্থীদের পদচারণায়। কেন্দ্রীয় ক্যান্টিন, ঐতিহাসিক লাইব্রেরি, শান্ত চত্বর, শহীদ মিনার চত্বর—সর্বত্রই যেন জ্ঞানের সঙ্গে তারুণ্যের উচ্ছ্বাসের এক অপূর্ব মিলনমেলা। এখানে ক্রিয়াশীল রয়েছে অর্ধশতাধিক সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস ক্লাব, জবি সাংবাদিক সমিতি, জবি রিপোটার্স ইউনিটি, ডিবেটিং সোসাইটি, আবৃত্তি সংসদ, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, রোভার স্কাউট, রেড ক্রিসেন্ট, ফটোগ্রাফিক সোসাইটি, ক্যারিয়ার ক্লাব এবং বিভিন্ন বিভাগীয় ফোরাম শিক্ষার্থীদের মেধা, মনন ও নেতৃত্ব বিকাশে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে। নিয়মিত সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও বিতর্ক প্রতিযোগিতা আয়োজিত হয়, যা শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা ও নেতৃত্বের গুণাবলি বিকাশে সহায়ক।

এখানে গণতন্ত্রচর্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে সক্রিয় রয়েছে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন। তারা ছাত্র অধিকার আদায়, শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং জাতীয় ইস্যুতে সোচ্চার ভূমিকা পালন করে। ক্যাম্পাসে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া আর্থিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও টিউশনি করে কিংবা পার্ট টাইম কাজ করে পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া শিক্ষার্থীদের অদম্য ইচ্ছাশক্তির অসংখ্য মানবিক গল্প ছড়িয়ে আছে ক্যাম্পাসজুড়ে, যা অনুপ্রেরণার এক দারুণ উৎস।

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার : বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার শুধু ভাষাশহীদদের স্মরণে নির্মিত একটি স্থাপত্য নয়, বরং এটি একটি প্রতীক—স্বাধীনচেতা মানসিকতা, প্রতিবাদী চেতনা ও সাংস্কৃতিক চর্চার প্রতীক। একুশে ফেব্রুয়ারিতে এখানে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, কবিতা আবৃত্তি ও সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় মেতে ওঠেন শিক্ষার্থীরা। অনেক সময় এখানে মানববন্ধন, প্রতিবাদ কর্মসূচি ও মৌন অবস্থানও অনুষ্ঠিত হয়।

শান্ত চত্বর : ক্যাম্পাসজুড়ে ব্যস্ততা আর কোলাহলের মাঝে শিক্ষার্থীদের স্বস্তির নীড় ‘শান্ত চত্বর’। বড় বড় গাছের ছায়ায় ঘেরা এ চত্বর শিক্ষার্থীদের গল্প, আড্ডা, প্রেম কিংবা একাকী সময় কাটানোর প্রিয় স্থান। অনেকেই এখানে বসে কবিতা লেখেন, গিটার বাজান বা শ্রেণিকক্ষের বাইরে পড়াশোনাও করেন। শান্ত চত্বর যেন এক অনানুষ্ঠানিক মুক্তাঙ্গন।

রফিক ভবন : রফিক ভবন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবনগুলোর অন্যতম, যেখানে বিভিন্ন বিভাগ ও প্রশাসনিক দপ্তরের কার্যক্রম চলে। এটি একটি বহুতল ভবন, যা মূলত ক্লাসরুম, শিক্ষক কক্ষ ও অফিস স্পেস হিসেবে ব্যবহার করা হয়। রফিক ভবনের নিচতলার বারান্দা ও সিঁড়ি শিক্ষার্থীদের আড্ডার অন্যতম স্পট। ক্লাস বিরতির সময় এখানে দেখা যায় প্রাণবন্ত পরিবেশ।

ক্যান্টিন : বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ক্যান্টিন শিক্ষার্থীদের খাদ্য ও পানীয় চাহিদা পূরণের প্রাণকেন্দ্র। সুলভ মূল্যে নাস্তা, দুপুরের খাবার ও নানা ধরনের হালকা খাবার পাওয়া যায় এখানে। তবে ক্যান্টিনের খাবারের মান, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং বসার জায়গার স্বল্পতা নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাঝেমধ্যেই অসন্তোষ দেখা দেয়। তবুও বন্ধুদের সঙ্গে এক কাপ চা আর আলোচনার জন্য এটি অন্যতম প্রিয় জায়গা।

Jaagannath-University-5

কেরানীগঞ্জের নতুন দিগন্ত

সাফল্যের নানা পালকের পাশাপাশি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে মোকাবিলা করতে হচ্ছে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ। এর মধ্যে প্রধানতম হলো স্থান সংকট ও আবাসন সংকট। পুরান ঢাকার হৃৎপিণ্ডে অবস্থিত হওয়ায় ক্যাম্পাসের ভৌত সম্প্রসারণ প্রায় অসম্ভব। ক্লাসরুম, ল্যাব, শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অফিসের জন্য তীব্র সংকট বিদ্যমান। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর দীর্ঘ সময় ধরে শিক্ষার্থীদের জন্য কোনো আবাসিক হল ছিল না। সম্প্রতি ছাত্রীদের জন্য ‘বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল’ নির্মিত ও চালু হলেও ছাত্রদের জন্য পর্যাপ্ত হলের অভাব প্রকট।

অনেক শিক্ষার্থীকেই দূর-দূরান্ত থেকে আসতে হয়, যা তাদের পড়ালেখা ও ক্যাম্পাসজীবনে অংশগ্রহণে বাধা সৃষ্টি করে। অপ্রতুল পরিবহন ব্যবস্থা, পুরান ঢাকার চিরাচরিত যানজট, খেলার মাঠের সংকট, পর্যাপ্ত গ্রন্থাগার না থাকা এবং আধুনিক অডিটোরিয়ামের অভাব শিক্ষার্থীদের ভোগান্তির অন্যতম কারণ।

তবে এসব সংকট ছাপিয়ে আশার প্রদীপ হয়ে এসেছে কেরানীগঞ্জের পাগলায় নির্মাণাধীন নতুন ও আধুনিক ক্যাম্পাস। প্রায় ২০০ একর জায়গাজুড়ে এই ক্যাম্পাস নির্মিত হচ্ছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে। এই মেগা প্রকল্পে থাকছে প্রশস্ত একাডেমিক ভবন ও গবেষণাগার, যা আধুনিক জ্ঞানচর্চার সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করবে।

ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য থাকবে পৃথক ও অত্যাধুনিক আবাসিক হল কমপ্লেক্স, যা আবাসন সংকট সমাধানে সহায়ক হবে। কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার ও ডিজিটাল লার্নিং সেন্টারে শিক্ষার্থীরা অবারিত জ্ঞান অর্জনের সুযোগ পাবেন। আধুনিক অডিটোরিয়াম ও সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স সাংস্কৃতিক কার্যক্রম ও অনুষ্ঠানের জন্য আদর্শ স্থান হবে। অলিম্পিক মানের ক্রীড়া কমপ্লেক্স শিক্ষার্থীদের খেলাধুলা ও শারীরিক বিকাশে সহায়তা করবে। শিক্ষক-কর্মকর্তাদের আবাসিক এলাকা, মেডিকেল সেন্টার ও শপিং জোন ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরীণ জীবনযাত্রাকে সহজ করবে।

এই নতুন ক্যাম্পাস নির্মাণ সম্পন্ন হলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান, আবাসন ও অবকাঠামোগত সব সমস্যার মৌলিক সমাধান হবে। এটি হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী মাইলফলক, যা একে দেশের শীর্ষস্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এরই মধ্যে নতুন ক্যাম্পাসের কিছু ভবনে কিছু বিভাগের কার্যক্রম স্থানান্তরিত হয়েছে, যা ভবিষ্যতের একটি উজ্জ্বল ইঙ্গিত।

সম্ভাবনার দিগন্তে অভিযাত্রা

সীমাবদ্ধতা ও সংকটকে সঙ্গী করেও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় তার স্বকীয় মহিমায় ভাস্বর। এখানকার শিক্ষার্থীরা নানা প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে নিজেদের যোগ্য করে তুলছে, যার প্রমাণ মেলে বিসিএসসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় তাদের ঈর্ষণীয় সাফল্যে। ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংগ্রামের এক দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আজ এক অপার সম্ভাবনার নাম। কেরানীগঞ্জের নতুন ক্যাম্পাস এই সম্ভাবনাকে দেবে অবারিত মহিরুহ। সবার প্রত্যাশা, আগামী দিনে সব সংকট কাটিয়ে এই বিদ্যাপীঠ শুধু বাংলাদেশেই নয়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও একটি প্রথম সারির গবেষণা ও জ্ঞানচর্চা কেন্দ্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবে। পুরান ঢাকার সেই লাল ইটের স্থাপত্য থেকে যাত্রা শুরু করে পেরিয়ে আসা পথগুলো, আর সামনে উন্মোচিত নতুন দিগন্ত—সব মিলিয়েই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতির এক অমলিন ধ্রুবতারা।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত