বর্ষার যত ফুল

শিফা চৌধুরী
প্রকাশ : ১৯ আগস্ট ২০২৫, ১৩: ৫৫
আপডেট : ১৯ আগস্ট ২০২৫, ১৪: ০৮

বাংলাদেশে বর্ষাকাল এলেই প্রকৃতির এক অনন্য রূপ ফুটে ওঠে—চারদিকে যেন ফুলের উৎসব! যদিও আমরা অনেকেই ফুলগুলোর নাম জানি না, কিন্তু তাতে কী? চেনা বা না চেনার চেয়েও বড় ব্যাপার হলোÑচোখ জুড়ানো এই রঙিন সৌন্দর্য উপভোগ করা। বর্ষার শুরুতেই প্রকৃতির ক্যানভাসে ছড়িয়ে পড়ে ফুলের ছটা, সৌরভ আর মুগ্ধতা।

কদম : বর্ষার প্রতীক

বিজ্ঞাপন

বর্ষার আগমনে প্রথম যে ফুলটি মনে পড়ে, তা হলো কদম। বাংলাদেশের বর্ষার এক অনিবার্য স্মারক এই কদমফুল। সাহিত্যে, সংগীতে, এমনকি ধর্মীয় বিশ্বাসেও কদমের রয়েছে গভীর স্থান। কদমগাছ উচ্চতায় ৩০-৪০ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে আর এর গোলাকৃতি ফুলগুলো হয় হলদেটে-সাদার মিশেলে অপূর্ব। বর্ষার বৃষ্টিতে যখন কদমফুল ভিজে যায়, তখন তা যেন প্রকৃতির অশ্রুবর্ষণ। কবি লিখেছেন

‘তখন কেবল ভরিছে গগন মেঘে/ কদম-বোরক দুলিছে বাদল বাতাস লেগে।’

বৈজ্ঞানিক নাম Anthocephalus cadamba, এই ফুল ভারত, নেপাল, মিয়ানমার ও বাংলাদেশে প্রচুর দেখা যায়। পৌরাণিক কাহিনিতেও কদমের রয়েছে এক বিশেষ ভূমিকা—বলা হয় বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ প্রথম কদমগাছে উঠে বাঁশি বাজিয়ে রাধাকে আকৃষ্ট করেছিলেন।

শাপলা : আমাদের জাতীয় অহংকার

বাংলাদেশের জাতীয় ফুল শাপলা, যা জলজ পরিবেশে যেমন পুকুর-ডোবা, খাল-বিল কিংবা নদীতেও অনায়াসে ফোটে। Nymphaea lotus নামক এই ফুলের বিভিন্ন রঙ—সাদা, লাল, হলুদ, নীল—পানির বুকে এক অপার সৌন্দর্য ছড়িয়ে দেয়। সাদা শাপলা আমাদের জাতীয় প্রতীক, তবে এর ডাঁটা ও পাতা গ্রামের মানুষের কাছে খাদ্য ও অলংকার দুটোই। শাপলা শুধু প্রকৃতিকে নয়, আমাদের সংস্কৃতিকে করেছে সমৃদ্ধ।

দোলনচাঁপা : প্রজাপতির মতো সৌন্দর্য

সাদা, কোমল আর সৌরভময় দোলনচাঁপা বর্ষার অন্যতম আকর্ষণ। এর ইংরেজি নাম Butterfly Lily আর বৈজ্ঞানিক নাম Hedychium coronarium। এর বড় বড় দুটি পাপড়ি যেন প্রজাপতির ডানা—মনকাড়া রূপে ভরা।

দোপাটি : ছোঁয়া লাগলেই সাড়া দেয়

ছোটখাটো এই দোপাটি ফুলের সৌন্দর্য যেন লাজুক এক কিশোরীর মতো। গোলাপি, বেগুনি, লাল, আকাশি—বিভিন্ন রঙের এই ফুল বর্ষার সঙ্গে গ্রীষ্মকালেও ফোটে। ইংরেজিতে একে বলে Touch-me-not, বৈজ্ঞানিক নাম Impatiens balsamina।

কেয়া : সৌরভের রাজকন্যা

কদম চোখ জুড়ায় আর কেয়া মন ভরায় তার মাদক ঘ্রাণে। কবি নজরুল লিখেছেনÑ

‘রিমি ঝিম রিমি ঝিম ঐ নামিল দেয়া/ শুনি শিহরে কদম, বিদরে কেয়া।’

এর বৈজ্ঞানিক নাম Pandanus odoratissimus। শ্বেতবর্ণ ফুল ধানের ছড়ার মতো সাজানো থাকে আর তার গন্ধে বিমুগ্ধ হয় মানুষ তো বটেই, সাপ ও পোকামাকড় পর্যন্ত! কেয়া ফুল দিয়ে পারফিউমও তৈরি করা হয়।

চালতা : পত্রপুটে শুভ্রতার বিস্তার

দুধসাদা, বড় আকৃতির চালতা ফুল বর্ষাকালে পাতার সবুজ পটভূমিতে যেন আল্পনা আঁকে। বৈজ্ঞানিক নাম Dillenia indica। এর ঘন পাতার ভেতর থেকে উঁকি দেওয়া স্নিগ্ধ ফুল, শুভ্রতা ও সৌন্দর্যের অপূর্ব মিশেল।

কলাবতী : রঙিন বর্ষার প্রাণ

লাল, হলুদ ও কমলার মিশেলে তৈরি এক উজ্জ্বল রঙিন ফুল কলাবতী বা সর্বজয়া। Canna indica নামে পরিচিত এই ফুল বর্ষার রঙিন চিত্রকল্প। এদের সরু লম্বা গঠন, প্রাণবন্ত পাপড়ি আর গর্বিত দণ্ড প্রকৃতিকে সাজায় বর্ণিল আয়োজনে।

বর্ষার ফুল, হৃদয়ের রঙ

প্রতিটি বর্ষা আমাদের নিয়ে আসে এক অপূর্ব অনুভবের জগতে—আকাশ কাঁদে, মাটি হাসে আর ফুল ফোটে। কদম, শাপলা, কেয়া কিংবা দোলনচাঁপা—সবাই মিলেই যেন বাংলার বর্ষাকে করে তোলে জীবন্ত এক কবিতা। ঘরের জানালা দিয়ে বৃষ্টিভেজা ফুলের দিকে তাকিয়ে অথবা কারো চুলের খোঁপায় কদম দেখে মন বলে ওঠেÑ

‘আঁধারে ডুবিছে সবি/ কেবল হৃদয়ে হৃদি অনুভবি।’

এই ফুলগুলো শুধু চোখের আরাম নয়, আমাদের সংস্কৃতি, কাব্য এবং জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত