এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা আমরা তোমাদের ভুলব না…। বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য অগণিত মানুষ প্রাণ দিয়েছেন। রক্তনদী পার হয়ে আমরা পেয়েছি মহান বিজয়, মহামূল্য স্বাধীনতা। এ স্বাধীনতার জন্য যারা প্রাণ উৎসর্গ করেছেন, জাতি তাদের কাছে চিরকৃতজ্ঞ। নাম না জানা বীর শহীদদের পবিত্র সেই স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের লক্ষ্যে নির্মাণ করা হয়েছে জাতীয় স্মৃতিসৌধ। নান্দনিক সৌন্দর্যে উদ্ভাসিত অনিন্দ্যসুন্দর এ স্থাপনা আমাদের জাতীয় অহংকারের প্রতীক। শোষণ, অবিচার ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রতীক। স্বাধীনতার লাল সূর্যকে ছিনিয়ে আনার প্রতীক।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ ও ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে ফুলে ফুলে ভরে যায় জাতীয় স্মৃতিসৌধ। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে যারা দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়েছেন, আমরা তাদের স্মরণ করি। গভীর কৃতজ্ঞতা, শ্রদ্ধা, ভালোবাসায় আমরা বীর শহীদদের স্মৃতিচারণা করি। এ দুটি দিনে সর্বস্তরের মানুষের ঢল নামে জাতীয় স্মৃতিসৌধে।
রাজধানী ঢাকা থেকে ৩৫ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে এ স্মৃতিসৌধের অবস্থান। সাভার উপজেলায় ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে বাঁ-দিকে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে নির্মাণ করা হয়েছে জাতীয় স্মৃতিসৌধ কমপ্লেক্স। পুরো কমপ্লেক্সের আয়তন হচ্ছে ৩৪ হেক্টর, অর্থাৎ ৮৪ একর। একে ঘিরে রয়েছে আরো ১০ হেক্টর সবুজ ভূমি।
জাতীয় স্মৃতিসৌধ আমাদের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে আত্মদানকারী বীর শহীদদের শৌর্যের প্রতীক।
মূল সৌধটি নির্মাণ করা হয়েছে অসমান উচ্চতা ও স্বতন্ত্র ভিত্তির ওপর সাতটি ত্রিভুজাকৃতির দেয়াল দিয়ে। সবচেয়ে নিচু ভিত্তির ওপর সর্বোচ্চ স্তম্ভটি গঠিত। আবার সর্বোচ্চ ভিত্তির ওপর যে স্তম্ভটি রয়েছে, সেটি হচ্ছে সবচেয়ে কম উঁচু। স্মৃতিসৌধের যে কাঠামো, তার শীর্ষ বিন্দুটির উচ্চতা হলো দেড়শ ফুট। যে স্থপতির নকশার ভিত্তিতে এই সৌধ নির্মিত হয়েছে, তার নাম মইনুল হোসেন। ৫৭ জন প্রতিযোগীর নকশা থেকে তার নকশাটি নির্বাচন করা হয়। এই নকশার জন্য জাতীয় একটি প্রতিযোগিতা হয়েছিল ১৯৭৮ সালে।
স্তম্ভটির সামনে রয়েছে কয়েকটি গণকবর। আরো আছে একটি জলাশয়। স্তম্ভের প্রতিফলন ঘটে এই জলাশয়ে। বাইরের রাস্তা থেকে মূল সৌধ কিছুটা দূরত্বে অবস্থিত। এ পথে রয়েছে উঁচু-নিচু জায়গা ও পেভমেন্ট। পার হতে হয় একটি কৃত্রিম লেকের ওপর তৈরি করা সেতু। দীর্ঘকাল ধরে চলা স্বাধীনতা-সংগ্রাম যে সফল হয়েছে, এই বাঁকগুলো হচ্ছে সেসবের স্মারক। এই সৌধে রয়েছে সাত জোড়া দেয়াল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের দীর্ঘ পথযাত্রার সাতটি পর্যায়ের প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত এই সাতটি স্তম্ভ। ১৯৫২, ১৯৫৪, ১৯৫৬, ১৯৬২, ২৯৬৬, ১৯৬৯ এবং ১৯৭১Ñএ সাতটি গুরুত্বপূর্ণ সালের ঘটনাবলির স্মারক এই সাতটি দেয়াল।
জাতীয় স্মৃতিসৌধ প্রকল্প নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হয়েছে তিনটি পর্যায়ে। প্রথমপর্যায়ের কাজ শুরু হয়েছিল স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে। এ পর্যায়ে ছিল ভূমি সংগ্রহ ও রাস্তা তৈরির কাজ। এতে খরচ হয়েছিল সে সময়ের হিসাবে ২৬ লাখ টাকা। প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজটিতে অনেকটা সময় লাগে। ১৯৭৪ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত। নির্মাণের দ্বিতীয় স্তরে ছিল গণকবর, হেলিপ্যাড, পার্কিংয়ের জায়গা, পেভমেন্ট তৈরির কাজ। এ পর্যায়ে নির্মাণব্যয় ছিল ৩ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। তারপর হয় তৃতীয় পর্ব। এ পর্যায়ে ব্যয় হয়েছে ৮৪৮ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। তৃতীয়পর্যায়ে করা হয় কৃত্রিম হ্রদ, পাশের সবুজ অঙ্গন, ক্যাফেটেরিয়া ও হাউজিং। মূল স্তম্ভটিও নির্মিত হয় এই সমাপনী পর্বে। নির্মাণকাজ তদারক ও তত্ত্বাবধান করেছে বাংলাদেশ সরকারের গণপূর্ত বিভাগ।

