প্রকৃতির এক বিস্ময় : পেলিকান পাখি

জাহিদ বিন হিকমত
প্রকাশ : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৬: ১২

পাখি প্রকৃতির অন্যতম সুন্দর সৃষ্টি। বিভিন্ন পাখির ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য আমাদের দারুণভাবে আকৃষ্ট করে। কিছু কিছু পাখি আছে তাদের দেহের গঠন দেখলে অভিভূত না হয়ে পারা যায় না। এমনই একটা পাখি পেলিকান।

বাংলায় যাকে আমরা বলি গগনবেড়। জলচর এই পাখির বিস্ময়ের শেষ নেই। বলতে গেলে পৃথিবীর এক অনন্য, রহস্যময় জলচর প্রাণী এই পেলিকান। চলুন দেখে আসি কী কী রহস্যের আবরণে আবৃত এই পেলিকান পাখি।

বিজ্ঞাপন

এই পাখির বিশেষত্ব হচ্ছে লম্বা ঠোঁট ও ঠোঁটের সঙ্গে সংযুক্ত গলার বিশাল নমনীয় চামড়ার থলি। পেলিকানের থলিকে বলা হয় ‘Gular Pouch’। বিশাল থলির সাহায্যে পেলিকান মাছ শিকার করে এবং পাকস্থলীর চেয়ে বেশি খাবার ধারণ করতে পারে থলিতে।

জলচর এই পাখিকে দূর থেকে দেখলে মনে হবে এক বিরাট পাখি তার ঠোঁটের সঙ্গে একটা থলে ঝুলিয়ে রেখেছে যেন খাবারের ঝুড়ি নিয়ে কোথাও যাচ্ছে! জানা যায় পাখির এই থলিতে প্রায় ১২ লিটার পানি ধরে এবং ৩০ পাউন্ড মাছ মজুত রাখা যায়। বলা হয়, পেলিকান পাখির থলি প্রসারিত করলে ছোট একটি শিশু অনায়াসে তার মধ্যে রাখা যেতে পারে। কী অদ্ভুত বিষয়! তবে শুধু বাহ্যিক চেহারাতেই নয়, পেলিকান পাখির মধ্যে লুকিয়ে আছে কিছু বিস্ময়কর রহস্য, যা এখনো বিজ্ঞানীদের ভাবিয়ে তোলে।

যেমন গলার নিচে ঝুলে থাকা থলে (gular pouch)। এটি শুধু মাছ ধরার থলে নয়, বরং অনেক বেশি কিছু। এই থলে শুধু পানিতে মাছ রাখতেই নয়, কখনো কখনো নিজেদের ঠান্ডা রাখতেও ব্যবহার করে। গরমের সময় এরা ঠোঁট নাড়িয়ে থলে দিয়ে বাতাস চলাচল করায়।

পেলিকানরা দলবদ্ধভাবে শিকার করে, এটা আমরা অনেকে জানি। কিন্তু যেটা রহস্য, তা হলো তারা কীভাবে নিখুঁত সমন্বয়ের মাধ্যমে একসঙ্গে মাছ তাড়ায়? এ ক্ষেত্রে কি তারা কোনো ভাষা ব্যবহার করে? নাকি চোখের ইশারায় হয় বোঝাপড়া? মাথা নষ্ট করার মতো মাস্টার প্ল্যান। পেলিকানের এই দলবদ্ধভাবে শিকারের কৌশলী ইঙ্গিত নিয়ে বিজ্ঞানীদের এখনো চলছে গবেষণা।

পেলিকান পাখি আট প্রজাতির হয়ে থাকে এবং তারা সবাই Pelecanus গণের অন্তর্গত। এই প্রজাতিগুলোর মধ্যে পার্থক্য তাদের বসবাসের অঞ্চল, ঠোঁটের রঙ, পালকের ধরন এবং আচরণগত বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে।

এর মধ্যে মাছ শিকারে অন্যান্য পেলিকানের তুলনায় Brown Pelican একটু ব্যতিক্রম। এরা উচ্চ আকাশ থেকে পানিতে ডাইভ করে মাছ ধরে, যা অন্য কোনো পেলিকান করে না। Brown Pelican প্রায় ১০-২০ মিটার অর্থাৎ ৩০-৬০ ফুট উঁচু থেকে সোজা পানিতে ডাইভ দেয় মাছ ধরতে। পানিতে পড়ার সময় তারা তাদের বড় ঠোঁট এবং নিচের গলার থলে (gular pouch) প্রসারিত করে, যাতে মাছ সহজে ধরা পড়ে। ডাইভ করার আগে তারা উপর থেকে জলে সাঁতার কাটতে থাকা মাছকে লক্ষ করে এবং দৃষ্টিশক্তি ব্যবহার করে সঠিক সময় ডাইভ দেয়। তাদের মাথার গঠন এমনভাবে তৈরি, যাতে পানিতে ডাইভ দেওয়ার সময় ঘাড় আর মাথা ভেঙে না যায়! প্রকৃতি যেন বিশেষভাবে ডিজাইন করেছে তাদের দেহগঠন।

এ তো গেল পেলিকানের মাছ শিকারের অধ্যায়। কিন্তু বিজ্ঞানীদের গবেষণায় আর একটা বিষয় পাখিপ্রেমিদের বেশ কৌতূহলী করে তুলেছে। বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, পেলিকানরা দীর্ঘপথ ওড়ার সময় কখনো কখনো মস্তিষ্কের একপাশ বন্ধ রেখে বিশ্রাম নেয়, ঠিক যেমনটা করে ডলফিন বা আলবাট্রস পাখি । তারা কীভাবে ঘুমিয়ে আবার দিকনির্দেশনা ধরে রাখে, তা নিয়ে এখনো গবেষণা চলছে। কিছু কিছু বিজ্ঞানী বলছেন, পাখিদের দিকনির্ণয়ের জন্য প্রাকৃতিক কম্পাস হিসেবে কাজ করে পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র। পাখিদের মস্তিষ্কে ম্যাগনেটাইট নামক একটি উপাদান থাকে, যা এই কাজে সহায়তা করে। এই চৌম্বক ক্ষেত্রটি পাখিদের পথ চিনতে এবং তাদের গন্তব্যে পৌঁছাতে সাহায্য করে।

পেলিকান মা পাখিকে ঘিরে রয়েছে আর এক বিস্ময়। পেলিকান মা সম্পর্কে একটি পুরোনো লোককথা বা ধর্মীয় প্রতীক রয়েছে, যেখানে বলা হয়, পেলিকান মা নিজের বুক ছিঁড়ে রক্ত দিয়ে বাচ্চাদের খাওয়ায়, যখন তারা খাদ্যসংকটে পড়ে। এই গল্পটি শত শত বছর ধরে ইউরোপের সাহিত্যে, ধর্মীয় শিল্পে ও প্রতীকীতে ব্যবহৃত হয়েছে। এমনকি মধ্যযুগে অনেক গির্জায় পেলিকান মায়ের ভাস্কর্য বসানো হতো। বাস্তব জীবনে পেলিকান মা আসলে নিজের বুক ছিঁড়ে রক্ত দেয় না। এটি একটি রূপক বা মিথ।

পেলিকান শুধু একটি পাখিই নয়, বরং প্রকৃতির অপূর্ব নকশা ও কৌশলের প্রতিফলন। এদের আচরণ, শিকার ধরার পদ্ধতি এবং গঠন-প্রকৃতি সত্যিই বিস্ময়কর। প্রকৃতির এই অনন্য সৃষ্টি আমাদের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের গুরুত্ব আরো গভীরভাবে অনুভব করায়।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত