পিয়ালপুর গ্রাম। গ্রামের শেষ মাথায় একটা দোচালা কাঁচা ঘর। সেখানে থাকেন রওশন আরা বেগম। গ্রামের মানুষ তাকে ‘শহীদ জননী’ নামেই চেনে। বয়স প্রায় ৮০ ছুঁইছুঁই। হাঁটতে-চলতে কষ্ট হয়, তবুও তার মুখের হাসি কখনো ম্লান হতে দেখেনি কেউ।
রওশন আরার একমাত্র ছেলের নাম জামাল। জামালের বাবা গত হয়েছেন অনেক দিন হলো। জামাল মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে দেশের জন্য যুদ্ধ করেছে। সেই সময় মার্চের উত্তাল সময়ে জামাল দেশ বাঁচাতে বই ফেলে ছুটে আসে গ্রামে। মায়ের সঙ্গে দেখা করে জামাল বলেছিল, ‘তুমি তো এক মা, দেশও আরেক মা। সেই দেশ-মা আজ আমাদের ডাকছে। তবে তুমি ভয় পেয়ো না, মা। তোমার জন্য একটা নতুন সকাল আনতে যাচ্ছি। তুমি শুধু আমাদের জন্য দোয়া করো।’ রওশন আরা তখন ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে চোখে এক ঝলক আলো নিয়ে বলেছিলেন, ‘যা বাবা। দেশের কাজ সবার আগে, আমি পরে।’ কিন্তু জামাল রণাঙ্গন থেকে আর ফেরেনি।
যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে সেক্টর কমান্ডার একদিন খবর পাঠিয়েছিলেনÑ‘একটি গুরুত্বপূর্ণ অভিযানের সময় দেশের জন্য লড়াই করতে করতে জামাল শহীদ হয়েছে। আমাদের দুর্ভাগ্য তার লাশও আমরা খুঁজে পাইনি। ক্যাম্পে তার ছোট্ট ব্যাগ হাতড়ে কেবল একটা চিঠি পাওয়া গেছে। এ চিঠি সেই যুদ্ধের আগের দিন সে লিখেছিল, যা ছিল মায়ের প্রতি তার শেষ বার্তা।’ চিঠিটা রওশন আরা এখনো যক্ষের ধনের মতো কাঠের একটা পুরোনো বাক্সে রেখে দিয়েছেন। সেটা মাঝে মাঝে তিনি খুলে পড়েন, আর অশ্রুবন্যায় ভাসেন। চিঠি পড়া শেষে বাক্সটা আবার বন্ধ করে রাখেন।
আজ ১৬ ডিসেম্বর। মহান বিজয় দিবস। পিয়ালপুর গ্রামের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা পতাকা হাতে বিজয় মিছিল করছে। তাদের কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে মহান মুক্তিযুদ্ধের গর্বভরা স্লোগান। মাইকে উচ্চ শব্দে বাজছে দেশের গানÑ‘জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো...’
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সামিউল হক ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে গর্বিত মা রওশন আরার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেলেন। তারপর সবার উদ্দেশে তিনি বললেন, ‘আজ আমরা শহীদমাতা রওশন আরা খালার পায়ে হাত দিয়ে শ্রদ্ধা জানাব। তিনি আমাদের বিজয়ের প্রতীক।’ বিজয় মিছিলের শব্দ শুনে রওশন আরা ঘর থেকে বেরিয়ে দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন। ছেলেমেয়েরা শহীদমাতা রওশন আরার হাতে সকালের তোলা তাজা ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাল। কেউ কেউ তার হাতে চুমু খেলো। এতে তিনি যেন কিছুটা লজ্জা পেলেন, আবার গর্বেও চোখ ভিজে উঠল তার।
এ সময় চটপটে মেয়ে তানিয়া জিজ্ঞেস করল, ‘খালা, আপনার ছেলে জামাল ভাই কি খুব সাহসী ছিল?’ রওশন আরার মুখটা যেন হঠাৎ আলোয় ভরে উঠল। তিনি বললেন, ‘সাহসী তো ছিলই মা, সাহসী না হলে কেউ নিশ্চিত মৃত্যুমুখে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে? তবে তার থেকেও বেশি ছিল দেশের প্রতি ভালোবাসা। জামাল প্রায়ই বলত—শোনো মা, মাটি যদি ডাকে, সে ডাক কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারব না। আর কোনো কিছুর বিনিময়েই দেশকে কারো পায়ের নিচে থাকতে দেব না।’ রওশন আরা একটু দম নিলেন। তারপর বললেন, ‘আমি জামালের এই সাহসিকতা নিয়েই বেঁচে থাকি।’ ছেলেমেয়েরা মুগ্ধ হয়ে চুপচাপ শুনে যাচ্ছিল শহীদমাতা রওশন আরার কথা। এ সময় সামিউল স্যার বললেন, ‘খালা, আপনি আমাদের অনুপ্রেরণা। আপনার মতো মা, যারা দেশের জন্য নিজ সন্তানকে যুদ্ধের ময়দানে এগিয়ে দিয়েছেন। তারাই তো এদেশের প্রকৃত বীর।’ রওশন আরা মৃদু হাসলেন। তারপর বললেন, ‘আমি কোনো বীর নই, বাবা। আমার ছেলে জামাল ছিল বীর। মহান আল্লাহ ওকে ভালো রাখুন। আর তোমাদের জন্য আমার একটাই কথাÑতোমরা ভালো মানুষ হও। এই দেশকে ভালোবাসো। জামালরা তো দেশটাকে তোমাদের হাতে তুলে দিয়ে গেছে, তাই না?’
রওশন আরার কথা শেষ হলে তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বিজয় মিছিল আবার শুরু হলো। রওশন আরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখতে থাকলেনÑসবুজের ওপর লাল রঙের পতাকাটা বাতাসে পতপত করে দুলছে। ওই পতাকার মাঝে যেন জামালের হাসিমুখ ঝলমল করছে। তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘যতদিন এই পতাকা উড়বে, এই পতাকার ভেতর নিশ্চয়ই আমার জামালও বেঁচে থাকবে।’

