বসন্তকালের অসুখ-বিসুখ

অধ‍্যাপক ডা. শেখ আব্দুল ফাত্তাহ্
প্রকাশ : ০৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৩: ১৩

শীতকাল শেষ প্রায়, প্রকৃতিতে বসন্তের আগমনী বার্তা। নানান রঙের পুষ্পপত্রপল্লবে সুসজ্জিত হয়ে উঠছে চারদিক। পলাশ আর কৃষ্ণচূড়ার সৌন্দর্যের পাশাপাশি আবহাওয়ার আরো কিছু পরিবর্তন ঘটে এই সময়ে- দিন-রাতের তাপমাত্রা, বাতাসের আর্দ্রতা ঘন ঘন পরিবর্তন হতে থাকে। এর সাথে খাপ খাওয়াতে কিছুটা বেগ পেতে হয় আমাদের শরীরকে। ফলে নানারকম রোগব্যাধির আক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এমন কিছু বিষয় আমরা জানব।

বিজ্ঞাপন

সাধারণ উপসর্গ

সর্দিকাশি, নাক দিয়ে পানি ঝরা, চোখমুখ জ্বালাপোড়া করা, চোখ লাল হয়ে যাওয়া, মাথাব্যথা, শরীর ম‍্যাজম‍্যাজ করা ইত্যাদি কিছু সাধারণ উপসর্গ কমবেশি অনেকের মধ‍্যেই দেখা যায়। শুষ্ক আবহাওয়া, ধুলাবালি, বাতাসে ভেসে বেড়ানো ফুলের রেণু- এসব কারণে উপরোক্ত লক্ষণগুলো হয়ে থাকে।

সংক্রামক রোগ

শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ, চিকেন পক্স, হাম এই সময়ে বেশি বেশি হয়। শিশু, বয়স্ক ও অন‍্যান‍্য রোগে আক্রান্তদের মধ‍্যে এগুলোর ঝুঁকি বেশি থাকে। এ ছাড়া ডায়রিয়াসহ অন‍্যান‍্য সংক্রমণও বছরের অন‍্য সময়ের মতো এই সময়েও হতে পারে।

● শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ– সাধারণত ভাইরাসজনিত কারণে এটা হয়। সাধারণ উপসর্গের পাশাপাশি জ্বর, তীব্র কাশি, বুকে ব‍্যথা, হলুদ কফ এই রোগের লক্ষণ। তবে ভাইরাস সংক্রমণের পর কখনো কখনো ব‍্যাকটেরিয়াল ইনফেকশনজনিত জটিলতা, নিউমোনিয়া দেখা দিতে পারে। সেক্ষেত্রে লক্ষণভিত্তিক চিকিৎসার সঙ্গে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসার প্রয়োজন হয় এবং এ অবস্থায় অবশ্যই চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থেকে চিকিৎসা গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়য়।

● চিকেন পক্স বা জলবসন্ত– এই রোগের সঙ্গে আমরা কমবেশি পরিচিত। জ্বর, মাথাব্যথা, শরীর ব‍্যথার পাশাপাশি শরীরের বিভিন্ন স্থানে ফোস্কা উঠতে থাকে। ফোস্কা ফেটে গিয়ে বা হাত দিয়ে খোঁটাখুঁটি করলে ফোস্কায় পুঁজ জমতে পারে। তীব্রতা কম থাকলে লক্ষণভিত্তিক চিকিৎসা অধিকাংশ ক্ষেত্রে যথেষ্ট। তবে অনেক সময় নিউমোনিয়া, ব্রেন ইনফেকশনসহ অন‍্যান‍্য জটিলতাও হতে পারে। তাই চিকিৎসকের পরামর্শাধীন থাকা প্রয়োজন। ওষুধের পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণে তরলজাতীয় খাবার, মাছ-ডিম, তাজা ফলমূল, শাকসবজি গ্রহণ করা জরুরি। আমাদের দেশে জলবসন্তের রোগীকে মাছ-মাংস থেকে বিরত রাখার একটি প্রথা প্রচলিত আছে অনেক জায়গায়। নির্দিষ্ট কোনো খাবারে অ্যালার্জি না থাকলে সব ধরনের মাছ-মাংস পর্যাপ্ত পরিমাণে দেওয়া জরুরি‌। এটি ছোঁয়াচে রোগ, তাই রোগ চলাকালীন এবং ফোস্কা শুকিয়ে যাওয়ার পরও সপ্তাহখানেক রোগীকে অন‍্যদের থেকে আলাদা রাখতে হবে এবং তার থালা-বাটি-গ্লাস, কাপড় ইত‍্যাদি যেন অন‍্যরা ব‍্যবহার না করে সে বিষয়ে যত্নবান হতে হবে।

● হাম-মূলত শিশুদের রোগ হলেও বড়রাও আক্রান্ত হতে পারে। নিয়মিত টিকাদানের কারণে এই সংক্রমণ এখন অনেক কম দেখা যায়। সাধারণ লক্ষণাদির পাশাপাশি শরীরজুড়ে লাল লাল দানা, চোখ লাল, মুখে ঘা দেখা যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নির্দিষ্ট কোনো ওষুধের দরকার পড়ে না। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিউমোনিয়াসহ অন‍্যান‍্য জটিলতা দেখা দিতে পারে। পর্যাপ্ত তরল ও সুষম খাদ্যের পাশাপাশি জটিলতা এড়াতে আগেভাগেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

● ডায়রিয়া, টাইফয়েড, জন্ডিস- হঠাৎ গরম বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষের পানির তৃষ্ণা বেড়ে যায়। এ ছাড়া রাস্তায়-ফুটপাতে যত্রতত্র অস্বাস্থ্যকর শরবত, জুস ইত্যাদি পান করতে দেখা যায়। এর মাধ্যমে নানাবিধ পানিবাহিত রোগ যেমন- ডায়রিয়া, টাইফয়েড, জন্ডিস ইত‍্যাদি সংক্রমণের ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়। বমি বা ঘন ঘন পাতলা পায়খানা হলে বিলম্ব না করে পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবার স‍্যালাইন খেতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী টাইফয়েড চিকিৎসার সুনির্দিষ্ট ওষুধ খেতে হবে। জন্ডিস দেখা দিলে পূর্ণ বিশ্রাম নিতে হবে। সর্বোপরি এসব রোগ থেকে সুরক্ষা পেতে অস্বাস্থ্যকর খাবার ও পানীয় থেকে দূরে থাকতে হবে।

অ্যালার্জিজনিত রোগ

অ্যালার্জিজনিত রোগের প্রকোপ বিশেষ ভাবে বাড়তে পারে বসন্তের আবাহনে। বাতাসে ভেসে বেড়ানো বিভিন্ন ফুলের রেণু এই অ্যালার্জি বৃদ্ধির অন‍্যতম কারণ।

● অ্যাজমা, ব্রংকাইটিস, অ্যালার্জিক রাইনাইটিস-আগে থেকেই এসব রোগে আক্রান্তদের উপসর্গের তীব্রতা এ সময়ে বেড়ে যেতে পারে। অনেকে নতুনভাবেও আক্রান্ত হতে পারে। উপর্যুপরি হাঁচি, নাক দিয়ে অনর্গল পানি ঝরা, মাথাব্যথা, কাশি, হলুদ কফ, তীব্র শ্বাসকষ্ট ইত‍্যাদি লক্ষনের মাধ্যমে এসব রোগ প্রকাশ পায়। অনেককেই গুরুতর শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালের শরণাপন্ন হতে হয়। এ পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেতে আগেভাগেই ব‍্যবস্থাপত্র মোতাবেক ইনহেলার বা নাকের স্প্রে নেওয়া শুরু করতে হবে। একবার আক্রান্ত হয়ে গেলে তখন এসব ওষুধ আশানুরূপ কাজ করে না। কারণ এগুলো মূলত রোগ প্রতিরোধী ওষুধ। জ্বর, হলুদ কফ ইত‍্যাদি উপসর্গে অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োজন হয় এবং তা ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে খাওয়া শুরু করতে হবে।

● শরীর চুলকানো, আর্টিকেরিয়া, চোখ লাল হয়ে যাওয়া- অ্যালার্জিজনিত কারণে এসব উপসর্গও এ সময়ে বাড়তে পারে। শরীরের বিভিন্ন স্থানে চুলকানো, লাল হয়ে ফুলে যাওয়া, নাক-চোখেও এমন উপসর্গ হতে পারে‌। হালকা সমস্যা হলে সাধারণ অ্যান্টিহিস্টামিনজাতীয় ওষুধ গ্রহণ করা যথেষ্ট। তবে কখনো কখনো অ্যালার্জির সমস্যা তীব্র হতে পারে, সঙ্গে শ্বাসকষ্ট দেখা দিতে পারে। এটি একটি জরুরি অবস্থা এবং অনতিবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। প্রয়োজনে হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সাহায্য নিতে হবে।‌

সতর্কতা ও করণীয়

  • যেহেতু তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার ওঠানামা অনেক উপসর্গের জন‍্য দায়ী, তাই পোশাক-আশাক নির্বাচন করতে হবে আবহাওয়া উপযোগী, রাতে কাঁথা বা কম্বল ব‍্যবহারের ক্ষেত্রেও এ সতর্কতা মেনে চলতে হবে।
  • অ্যালার্জি থেকে সুরক্ষা পেতে মাস্ক, সানগ্লাস ব‍্যবহার করতে হবে। যাদের অ্যালার্জি আছে, সরাসরি ফুলের ঘ্রাণ নেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। অ্যালার্জিজাতীয় খাবার পরিহার করতে হবে।
  • সংক্রামক রোগে আক্রান্তদের সংস্পর্শ থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকতে হবে। জনবহুল স্থান ও যানবাহনে মাস্ক ব‍্যবহার করতে হবে। ঘন ঘন হাত ধুতে হবে এবং হাত না ধুয়ে নাক-চোখ-মুখ স্পর্শ করা যাবে না।
  • পানিবাহিত রোগ থেকে সুরক্ষার জন‍্য যত্রতত্র অস্বাস্থ্যকর খাবার, শরবত, জুস ইত্যাদি খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
  • সর্দিকাশিতে আক্রান্ত হলে তরলজাতীয় খাবার বেশি খেতে হবে। উষ্ণ পানির গড়গড়া ও গরম পানির ভাপ নিতে হবে। নিরাময় না হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
  • অ্যালার্জিজনিত চুলকানি, শ্বাসকষ্ট বেশি হলে দেরি না করে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
  • প্রতি ঋতুর নির্দিষ্ট কিছু ফলমূল ও শাকসবজি আছে, যেগুলো ওই ঋতুর বিশেষ বিশেষ স্বাস্থ্য সমস্যা প্রতিরোধে প্রকৃতির নিজস্ব উপহার। পর্যাপ্ত টাটকা ফলমূল ও শাকসবজি নির্বাচনের সময় নির্দিষ্ট ঋতুর বিশেষ ফলমূল-সবজি খাদ‍্যতালিকায় রাখার চেষ্টা করতে হবে।
  • আমরা যেন ভুলে না যাই- যেকোনো রোগের ক্ষেত্রেই ‘প্রতিকার অপেক্ষা প্রতিরোধ উত্তম’।

লেখক : মেডিসিন ও বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ

অধ‍্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, মেডিসিন

গ্রীনলাইফ মেডিকেল কলেজ, গ্রীন রোড, ঢাকা।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত