করোনার সময় আমরা নার্সরা মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ি

এন আই মানিক
প্রকাশ : ১৭ জুলাই ২০২৫, ১৭: ০২

নার্স বা সিস্টার আমাদের কোনো না কোনো পরিবারের সদস্য। তারাও বাবার আদরের সন্তান, মায়ের কলিজার টুকরো, কোনো এক ভাইয়ের প্রিয় বোন বা কারো সহধর্মিণী। তাদেরও আছে ব্যক্তিগত জীবন। কিন্তু সবকিছু চাপিয়ে এই নার্সরা দিন-রাত মানুষকে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। মানুষের সেবা করাকে পেশা হিসেবে নেওয়ার লক্ষ্যেই তারা আসেন নার্সিং পেশায়।

বিজ্ঞাপন

মাদারীপুরের মেয়ে ভানু ভক্ত ২০০৫ সালে নার্স হওয়ার প্রবল ইচ্ছা নিয়ে ঢাকায় আসেন। ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য হসপিটালে তিন বছরমেয়াদি কোর্স সম্পন্ন করে নার্সিং পেশায় যাত্রা শুরু করেন। কিডনি অ্যান্ড ইউরোলজি হসপিটালে সাত-আট বছর চাকরি করেন। এরপর ২০১৫ সাল থেকে গ্রিন রোডের ইউনিহেলথ স্পেশালাইজড হাসপাতালে কাজ করছেন। এই হসপিটালেই ভানুর ১০ বছরের কাজের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হলো।

এত পেশা থাকতে নার্সিং পেশায় কেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি কারো ওপর নির্ভরশীল হতে চাইনি। নিজেই কিছু করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেয়েছি।’ একজন ভালো নার্সের কী কী গুণাবলি থাকা উচিত? এমন প্রশ্নের জবাবে ভানু বলেন, ‘প্রথমত নার্সকে একজন ভালো লিডার হতে হবে। অবশ্যই বুদ্ধিমান হতে হবে, সতর্কভাবে কাজ করতে হবে। রোগীর ভালোভাবে যত্ন নিতে হবে এবং সহকর্মীদের প্রতি আন্তরিক হতে হবে।’

এই পেশা যেহেতু রোগীদের সেবা করার একটি পেশা, তাই নার্সদের ওপর মানসিক চাপ পড়াটা স্বাভাবিক। কখনো এমন পরিস্থিতিতে পড়েছেন, মানসিকভাবে খুব চাপে ছিলেন?

এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘২০২০ সালে যখন প্রথম করোনা শনাক্ত হয়, তখন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। কেউ কারো কাছে যেতে চাইত না, মৃত্যুপুরী একটা পরিবেশ। তখন আমরা নার্সরা মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে নিজেদের কথা না ভেবে রোগীদের সুস্থ করতে ঝাঁপিয়ে পড়ি। ওই সময়টায় মানসিকভাবে অনেক চাপে ছিলাম।’

নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানতে চাইলে ভানু বলেন, ‘ওই কোভিডের সময় হাসপাতাল থেকে রোগীর সেবা করে যখন বাসায় ফিরতাম, তখন বাড়িওয়ালা বাসায় ঢুকতে দিতেন না। করোনা রোগীর সেবা করি, তাই বাসা ছেড়ে দিতে বলতেন। তখন খুব কষ্ট লাগত, কারণ আমরা নার্সরা করোনা রোগীর সেবা করি বলেই আমাদের অবহেলা করা হতো।’

নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে খুব আক্ষেপ নিয়ে অভিজ্ঞ এই নার্স আরো বলেন, ‘হাসপাতাল থেকে যখন রোগীকে রিলিজ করা হয়, তখন রোগীর অভিভাবকরা মাঝেমধ্যে কোনো সমস্যা হলেই সেটার জন্য নার্সদের দোষারোপ করেন। বিল দিতে গিয়ে কোনো সমস্যা হলেও সেখানে তারা নার্সদের দায়ী করেন। অথচ আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকে রোগীকে সুস্থ করার। আমরা যদি ভালোভাবে রোগীর সেবা না করি, তাহলে এত এত রোগী সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে কীভাবে?’

সাধারণত কোনো রোগী সুস্থ না হলে এটা অভিভাবকরা মেনে নিতে পারেন না। তখন হয়তো তাদের মুখে বিভিন্ন অভিযোগ শোনা যায় ডাক্তার বা নার্স নিয়ে। তবে এটাও ভাবতে হবে, এই নার্সদের চেষ্টার কমতি থাকে না। তাদের পরিবারের একজন সদস্যের দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখতে হবে।

বর্তমান নার্সিং ব্যবস্থায় কী কী পরিবর্তন আনা দরকার, জানতে চাইলে ভানু বলেন, ‘আমাদের দেশে নার্সিং ব্যবস্থা বলতে গেলে খুবই নিম্নমানের। এত বছর পড়াশোনা করেও স্বল্প বেতনে চাকরি করতে হয়। আর সম্মানের কথা বলতে গেলে, সেকেন্ড ক্লাস অফিসার হয়েও আমরা প্রাপ্য সম্মানটুকু পাই না। কিছু পরিবর্তন খুব দরকার। নার্সিং শিক্ষা, কর্মপরিবেশ, বেতনকাঠামো এবং পেশাগত স্বীকৃতির দিকে নজর দিতে হবে।’

ভানু ভক্ত শুধু একজন অভিজ্ঞ নার্স নন। মা হিসেবেও সফল। তার একমাত্র ছেলে জয় চলতি বছর এসএসসিতে পাস করেছে। নার্সদের নাইট শিফটেও কাজ করতে হয়। সে ক্ষেত্রে নিজের সংসারের ওপর কোনো চাপ পড়ে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘চাপ তো একটু পড়েই। আমার একটা ছেলে। তাকে ভালোভাবে সময় দিতে পারি না। আমি ডিউটিতে এলে আমার স্বামীর কাছেই তাকে রেখে আসি। তার জন্য ভালো কোনো খাবার বানানোর সময় পাই না। পরিবারের সঙ্গে একটু সময় কাটানোর মতো সময় হয় না। অভিযোগ থাকে কত।’

ভানু যেহেতু একজন অভিজ্ঞ নার্স, সেহেতু নতুন যারা নার্সিং পেশায় এসেছেন বা যারা আসার জন্য নার্সিং কলেজে পড়াশোনা করছেন, তাদের প্রতি কী উপদেশ থাকবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সবাই আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কাজ করবেন। সহকর্মীদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকবেন। রোগীর যত্নে কোনো খামখেয়ালি করা যাবে না। অভিজ্ঞ নার্সদের পরামর্শ এবং শেখার সুযোগ গ্রহণ করবেন।’

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত