মোবাইল ব্যাটারি বিস্ফোরণ কেন হয়?

আরিফ বিন নজরুল
প্রকাশ : ২৭ অক্টোবর ২০২৫, ১৯: ২৮
আপডেট : ২৭ অক্টোবর ২০২৫, ১৯: ২৯

আজকের পৃথিবীতে মোবাইল ফোন যেন আমাদের জীবনের অঙ্গ। সকালে ঘুম থেকে ওঠা থেকে শুরু করে রাতে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত ফোনই এখন যোগাযোগ, বিনোদন, অফিস, ব্যাংকিং—সবকিছুর সঙ্গী। কিন্তু এই অপরিহার্য ডিভাইসটি হঠাৎ একদিন আপনার হাতেই বিস্ফোরিত হতে পারে। ভাবতেই ভয় লাগে! দুর্ভাগ্যবশত এমন ঘটনা বাস্তবেও ঘটছে। সংবাদে প্রায়ই দেখা যায়, চার্জে থাকা অবস্থায় ফোন হঠাৎ বিস্ফোরিত হয়ে আগুন লেগেছে। কেউ আহত হয়েছেন বা ঘরে অগ্নিকাণ্ড হয়েছে। প্রশ্ন হলো, কেন এমন বিপজ্জনক ঘটনা ঘটে? আর কীভাবে আমরা এ থেকে নিরাপদ থাকতে পারি?

প্রথমেই জানতে হবে, আধুনিক স্মার্টফোনে ব্যবহৃত লিথিয়াম-আয়ন (Li-ion) ব্যাটারিগুলো অনেক শক্তিশালী হলেও ভেতরে রয়েছে অত্যন্ত সংবেদনশীল রাসায়নিক উপাদান। এই ব্যাটারিতে বিদ্যুৎ সঞ্চিত থাকে দুটি ধাতব পাতের মাঝে তরল ইলেকট্রোলাইটের মাধ্যমে। কোনো কারণে ভেতরের তাপমাত্রা বেড়ে গেলে বা শর্ট সার্কিট হলে এই রাসায়নিক বিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ হারায়, যাকে বিজ্ঞানীরা বলেন, ‘থার্মাল রানওয়ে’। তখন ব্যাটারি নিজের মধ্যেই দ্রুত তাপ উৎপন্ন করতে শুরু করে এবং শেষ পর্যন্ত বিস্ফোরণ বা আগুনে রূপ নেয়।

বিজ্ঞাপন

সবচেয়ে সাধারণ কারণ হলো নিম্নমানের বা নকল ব্যাটারি ও চার্জার ব্যবহার। অনেকেই মনে করেন, ‘সব চার্জার এক।’ কিন্তু বাস্তবে প্রতিটি ফোনের জন্য নির্দিষ্ট ভোল্টেজ ও কারেন্ট প্রয়োজন হয়। নকল চার্জার বা সস্তা কেব্‌লে সেই মান বজায় না থাকলে ব্যাটারি অতিরিক্ত গরম হয়ে যায়। একইভাবে ব্যাটারি পুরোনো হয়ে গেলে বা ফোন কোথাও পড়ে গিয়ে ভেতরে আঘাত পেলে এর অভ্যন্তরীণ সেল ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা সময়ের সঙ্গে বিপজ্জনক আকার নেয়।

এছাড়া অনেকেই ফোন চার্জে রেখে ঘুমান বা রোদে রেখে যান। এটিও বিপদের বড় উৎস। চার্জিংয়ের সময় ফোনের ভেতর তাপ তৈরি হয়, আর বাইরে গরম পরিবেশ থাকলে সেটি বের হতে পারে না। ফলে ব্যাটারির ভেতরে চাপ জমে, গ্যাস তৈরি হয় এবং ফুলে ওঠে। অনেক সময় ফোনের ব্যাক কভার হঠাৎ উঁচু হয়ে যাওয়া বা স্ক্রিন ফুলে ওঠা এই বিপদের পূর্বলক্ষণ।

আরেকটি কম পরিচিত কারণ হলো সফটওয়্যারজনিত ত্রুটি। অনেক সময় ফোনের চার্জ কন্ট্রোলার বা ব্যাটারি ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমে (BMS) বাগ থাকলে সেটি চার্জিং বন্ধের সংকেত দিতে ব্যর্থ হয়। ফলে ব্যাটারি ‘ওভারচার্জ’ হয়ে অতিরিক্ত উত্তপ্ত হয়। এজন্যই ফোনের সফটওয়্যার ও ফার্মওয়্যার আপডেট রাখা খুব জরুরি, কারণ নির্মাতারা এসব সমস্যা ঠিক করতে নিয়মিত আপডেট দেয়।

ফোন থেকে যদি অস্বাভাবিক গরম বের হয়, কভার ফুলে ওঠে বা গন্ধ আসে, তাহলে অবিলম্বে চার্জার খুলে ফেলুন এবং ডিভাইস বন্ধ করুন। ব্যাটারি বা ফোন ঠান্ডা না হওয়া পর্যন্ত স্পর্শ করবেন না। যদি ধোঁয়া উঠতে থাকে, তাহলে ফোনটিকে খোলা জায়গায় রেখে দিন এবং কখনোই পানি ঢালবেন না। লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারিতে পানি দিলে রাসায়নিক বিক্রিয়া আরো বাড়তে পারে, যা বিস্ফোরণের ঝুঁকি বাড়ায়।

ঝুঁকি এড়াতে কয়েকটি সহজ নিয়ম মানলেই যথেষ্ট। প্রথমত, অরিজিনাল চার্জার ও কেব্‌ল ব্যবহার করুন—ফোনের ব্র্যান্ড বা মানসম্মত বিকল্প ছাড়া অন্য কিছু নয়। দ্বিতীয়ত, রাতভর চার্জে রেখে দেওয়ার অভ্যাস বাদ দিন। তৃতীয়ত, ফোন চার্জ করার সময় ভারী কভার খুলে দিন, যাতে তাপ বের হতে পারে। চতুর্থত, রোদে বা গাড়ির ড্যাশবোর্ডে ফোন রাখবেন না। পঞ্চমত, ব্যাটারি ফুলে গেলে কখনো চাপ দেবেন না; দ্রুত সার্ভিস সেন্টারে নিয়ে যান। এবং ষষ্ঠত, নিয়মিত ব্যাটারির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করুন। অনেক স্মার্টফোনেই এখন ব্যাটারি হেলথ চেক অপশন থাকে।

ফোনের ব্যাটারি ফাটলে বা বিস্ফোরিত হলে প্রথমে শান্ত থাকুন। আশেপাশের মানুষকে দূরে সরিয়ে দিন। আগুন বড় হলে ফায়ার সার্ভিসে কল করুন। ব্যাটারি পুড়ে যাওয়ার পর সেটিকে কখনই হাত দেবেন না—এতে থাকা রাসায়নিক পদার্থ ত্বকে জ্বালাপোড়া সৃষ্টি করতে পারে। ক্ষতিগ্রস্ত ডিভাইসটি নিরাপদভাবে ফেলে দিতে হলে স্থানীয় ই-ওয়েস্ট কালেকশন পয়েন্ট বা ব্র্যান্ডের সার্ভিস সেন্টারে জমা দিন।

সবশেষে বলা যায়, মোবাইল ফোন এখন আর শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়, এটি একপ্রকার ক্ষুদ্র বিদ্যুৎঘর। তাই ব্যবহারেও প্রয়োজন জ্ঞান ও সচেতনতা। অনেক সময় আমরা একটু সস্তা চার্জার কিনে বা অযত্নে ফোন রেখে নিজের অজান্তেই আগুনের সঙ্গে খেলা করি। অথচ কিছু সচেতন ব্যবহার, যেমন অরিজিনাল চার্জার ব্যবহার, অতিরিক্ত গরম এড়ানো, সময়মতো ব্যাটারি বদলানো—এই ছোট অভ্যাসগুলোই আমাদের বড় বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারে। মোবাইল আমাদের সঙ্গী, কিন্তু দায়িত্বশীল ব্যবহারই পারে সেই সঙ্গীকে নিরাপদ রাখতে। প্রযুক্তি যতই উন্নত হোক, নিরাপত্তা সচেতনতার বিকল্প নেই। মনে রাখবেন, একটি সামান্য ব্যাটারি—অবহেলায় সেটিই একদিন আগুন হয়ে ফিরে আসতে পারে।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত