মাদরাসাছাত্র মোশারফ ফ্রিল্যান্সিংয়ে লাখপতি!

মুহাম্মদ শফিকুর রহমান
প্রকাশ : ২০ জানুয়ারি ২০২৫, ১৩: ২১

ভ্যানচালক বাবা ছয় সদস্যের পরিবার চালাতে হিমশিম খেতেন। এই পরিবারেই একজন মোশারফ হোসেন (ছাব্বির)। তিনি স্বপ্ন দেখতেন সফল ফ্রিল্যান্সার হওয়ার। মায়ের ধার করা টাকায় কেনা কম্পিউটার দিয়ে তার যাত্রা শুরু। এখন কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ডের বৈদ্দেরখীল গ্রামের মোশারফ ফ্রিল্যান্সিং করে মাসে আয় করেন লাখ টাকা বা তারও বেশি। মাদরাসা ছাত্র মোশারফের ফ্রিল্যান্সার হয়ে ওঠার গল্প জানাচ্ছেন মুহাম্মদ শফিকুর রহমান

বিজ্ঞাপন

অভাবের সংসার। অনেকগুলো ভাইবোন। বাবা ভ্যান চালিয়ে, মা অন্যের বাসায় টুকটাক কাজ করে যা আয় করতেন, তাতে টেনেটুনে কোনো রকম চলত। এরই মধ্যে মোশারফের মাথায় ফ্রিল্যান্সিংয়ের ভূত চাপে। ২০১৯ সালে তিনি ফেসবুক ও ইউটিউব থেকে ফ্রিল্যান্সিংয়ের কথা জানতে পারেন। ইউটিউবে ভিডিও দেখে একা একা চেষ্টা করতেন। এক্সপার্ট আইটি পার্ক ও কোডম্যান বিডি-সহ পাঁচটি প্রতিষ্ঠানে অনলাইনে কোর্স করেন। এই কোর্সগুলো তার চোখ খুলে দেয়। ফ্রিল্যান্সিংয়ের নানা বিষয়ে সব সময় সহযোগিতা পেয়েছেন তিনি কোডম্যান বিডির কর্ণধার মিনহাজুল আসিফ এবং এক্সপার্ট আইটি পার্কের মেন্টর ওমর ফারুকের কাছ থেকে। মাকে একদিন সাহস করে তিনি বলেই ফেলেন কম্পিউটার কিনে দেওয়ার কথা। অন্যের কাছ থেকে ৪০ হাজার টাকা ধার করে এনে মোশারফের হাতে তুলে দেন তার মা। তিনি শুধু বলেছিলেন, ‘বাবা তুই যা করবি তোর ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে করবি। আশা করি হতাশ করবি না ।’ মোশারফ অবশ্য বাবা-মা কাউকেই হতাশ করেননি।

২০২১ সালে মোশারফের ফ্রিল্যান্সিং করে আয়ের শুরু। গ্রামের মানুষ জানত না ফ্রিল্যান্সিং কী। অনেকে ভাবত এটা মনে হয় জুয়া। তারা নানা রকম কথা বলত। কিন্তু এসব তিনি পাত্তা দেননি। ‘আমি জানতাম ও বিশ্বাস করতাম, আমি যে পথে যাচ্ছি সেটা সঠিক পথ। আমি চেষ্টা করলে অবশ্যই পারব—এমন মনোবল নিয়ে লেগে ছিলাম, তাই আজ আমি সফল,’ বলেন মোশারফ। তবে সফল হওয়া মোটেও সহজ ছিল না। প্রত্যন্ত গ্রাম। ব্রডব্যান্ড লাইন ছিল না। মোবাইলের ডেটা ব্যবহার করতেন। দিনের বেলা স্পিড থাকত না তেমন। রাত ১২টা থেকে ভোর অবধি কাজ করতেন। এভাবে রাত জাগতে জাগতে অসুস্থ হয়ে পড়েন। আবার অনলাইনে যে কোর্সগুলো করেছেন, তার টাকাও মা অন্যদের কাছ থেকে ধার করে এনে দেন। মোশারফ বলেন, ‘এমন শত বাধা এলেও আমি থেমে যাইনি। রাতের পর রাত ঘুমাইনি। আবার দিনে পড়াশোনা করেছি। এই অক্লান্ত পরিশ্রম করায় আজ আমি সফল।’

মোশারফ মূলত একজন ডিজিটাল মার্কেটার। এসইও, গুগল এডস ও শপিফাই ফেসুবক নিয়ে তার কাজ মার্কেট প্লেস ও আউট অফ মার্কেট প্লেসে । বেশিরভাগ কাজ মাসিক চুক্তিতে করেন। মাসে তার আয় লাখ টাকার ওপরে। তবে কাজ কম-বেশির ওপর আয় নির্ভর করে বলে তিনি জানান। ফাইভারের লেভেল টু সেলার এবং আপওয়ার্কে টপ রেটেড তিনি। এ পর্যন্ত ৫২টি দেশের ৭০০+ ক্লায়েন্টের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি। উল্লেখযোগ্য দেশগুলো হলো আমেরিকা, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, সৌদি আরব ইত্যাদি ।

বাবা-মা ছাড়াও মোশারফের পরিবারে আছে দুই ভাই ও দুই বোন। কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ডের বৈদ্দেরখীল গ্রামে তাদের বাড়ি। তিনি চৌদ্দগ্রাম নজমিয়া কামিল মাদরাসায় ফাজিল প্রথম বর্ষে পড়াশোনা করছেন। দাখিল ও আলিম এই মাদরাসা থেকে সফলতার সঙ্গে পাশ করেন। বাবা আগে ভ্যান চালাতেন। মা সংসার সামলানোর পাশাপাশি মানুষের বাড়িতে টুকটাক কাজ করে দিতেন। মোশারফের মায়ের নাম হাসিনা বেগম ও বাবা খোরশেদ আলাম । ছেলের সফলতায় তারা দুজনই গর্ববোধ করেন। তার মা হাসিনা বেগম বলেন, ‘আমি জানতাম তুই পারবি । আজ তোর জন্য আমরা সমাজে বুক ফুলিয়ে হাঁটতে পারি, কারণ একসময় আমরা অত্যন্ত গরিব ছিলাম ।’

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিষয়:

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত