ই-ব্যাংকিংয়ের জন্মকথা

জুবাইর আল হাদী
প্রকাশ : ১৩ অক্টোবর ২০২৫, ১৬: ৩৮

একসময় আর্থিক ব্যবস্থাপনা মানেই ছিল মাইল পথ হেঁটে চেকবই হাতে নিয়ে ব্যাংকে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকা। তখন মানুষ নিজ হাতে আয়-ব্যয়ের হিসাব লিখে রাখত। চেক লিখত আর ব্যাংকের স্টেটমেন্টের জন্য অপেক্ষা করত ডাকপিয়নের পদধ্বনির। ব্যাংকে ফোন করা বা অফিসে হাজির হয়ে হিসাব মেলানো ছিল দৈনন্দিন কাজের অংশ। অনলাইন ব্যালান্স চেক করার ধারণা তখন কল্পনারও বাইরে। আজ পরিস্থিতি সম্পূর্ণ উল্টো।

কয়েকটি ক্লিক বা টাচেই অনায়াসে টাকার হিসাব দেখা যায়। বিল পরিশোধ করা যায়, এমনকি ঋণও নেওয়া যায়। কেউ কেউ তো এখন চেকের নামই শোনে নাডেবিট কার্ড, মোবাইল অ্যাপ, কিংবা অ্যাপল পে-ই হয়ে উঠেছে তাদের ব্যাংকিংয়ের মুখ। কিন্তু প্রশ্ন জাগে এই সুবিধার শুরুটা কোথায়? অনলাইন ব্যাংকিং আসলে কবে থেকে শুরু?

বিজ্ঞাপন

পঞ্চাশের দশকের শুরুতে ব্যাংকিংয়ের চেহারা ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। ১৯৫০ সালে ব্যাংক অব আমেরিকার কর্মীরা প্রতিটি চেক হাতে প্রক্রিয়াকরণ করতেন। গ্রাহকসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কাজের চাপ বাড়তে থাকায় ব্যাংকাররা বুঝতে পারেন এভাবে চলবে না, স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার প্রয়োজন। সেই ভাবনা থেকেই জন্ম নেয় ইলেকট্রনিক রেকর্ডিং মেশিন, অ্যাকাউন্টিং (ERMA)। ইঞ্জিনিয়াররা প্রথমবারের মতো চেকের ওপর চৌম্বকীয় কালি দিয়ে অ্যাকাউন্ট নম্বর মুদ্রণ করেন। যাতে মেশিন সহজেই তা স্ক্যান করতে পারে। ১৯৫৯ সালে প্রথম ERMA চালু হওয়ার পর ব্যাংক অব আমেরিকা বছরে প্রায় ৭৫০ মিলিয়ন চেক প্রক্রিয়াকরণ করতে থাকে। এই সাফল্য থেকেই আসে ব্যাংকের পরবর্তী উদ্ভাবনÑবিশ্বের প্রথম ক্রেডিট কার্ড।

পরে ১৯৮৩ সালে নিউ ইয়র্কের কেমিক্যাল ব্যাংক চালু করল ‘প্রোন্টো সিস্টেম’। যেটা ছিল একটি ব্যতিক্রমী হোম ব্যাংকিং উদ্যোগ। ফোন, কম্পিউটার ও টিভি সেট মিলিয়ে তৈরি এই সিস্টেমে গ্রাহকরা মডেম ব্যবহার করে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট দেখতে পারতেন। তহবিল স্থানান্তর ও বিল পরিশোধ করতে পারতেন। যদিও প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা ও খরচের কারণে এটি তেমন জনপ্রিয় হয়নি, তবে ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের সম্ভাবনা প্রথম দেখিয়ে দেয় এই প্রোন্টোই। একই সময় ব্যাংক অব আমেরিকা, সিটিব্যাংক, চেজ ম্যানহাটনসহ নিউ ইয়র্কের আরো কয়েকটি ব্যাংক নিজেদের হোম ব্যাংকিং সিস্টেম চালু করে।

ATM-এর আবির্ভাব

১৯৬০-এর দশকে আবির্ভূত হয় অটোমেটিক টেলার মেশিন (ATM) এটিএম, যা ব্যাংকিং ইতিহাসের এক বিপ্লব। প্রথমদিকে এটি শুধু জমা নেওয়া যেত। কিন্তু ইউরোপে ১৯৬৭ সালে চালু হওয়া আধুনিক এটিএম নগদ উত্তোলনের সুবিধা দেয়। সঙ্গে যুক্ত হয় নিরাপত্তার জন্য ব্যক্তিগত শনাক্তকরণ নম্বর (PIN Number)। ১৯৬৮ সালে নিউ ইয়র্কের কেমিক্যাল ব্যাংক প্রথম যুক্তরাষ্ট্রে এটিএম স্থাপন করে। এরপর আসে ডেবিট কার্ডের যুগÑচৌম্বকীয় স্ট্রাইপ থেকে শুরু করে সিলিকন চিপযুক্ত নিরাপদ কার্ডে পরিণত হয়। এখন ডিজিটাল ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের জন্য ৪০,০০০-এরও বেশি বিনামূল্যের এটিএম ব্যবহারের সুযোগ দেয়।

ইন্টারনেটের ছোঁয়া

নব্বইয়ের দশক ছিল অনলাইন বা ই-ব্যাংকিংয়ের প্রকৃত সূচনাকাল। স্ট্যানফোর্ড ফেডারেল ক্রেডিট ইউনিয়ন ১৯৯৪ সালে বিশ্বের প্রথম ইন্টারনেট ব্যাংকিং ওয়েবসাইট চালু করে। ১৯৯৭ সালে সেই প্ল্যাটফর্মেই বিল পরিশোধ করা যেত আর ২০০২ নাগাদ চালু হয় মোবাইল ব্যাংকিং। ১৯৯৫ সালে প্রেসিডেন্সিয়াল ব্যাংকও ইন্টারনেট ব্যাংকিং সেবা শুরু করে। ২০০০ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৮০% ব্যাংকেরই নিজস্ব ওয়েবসাইট ছিল। তখন থেকেই শুরু হয় ঘরে বসে ব্যাংকে লেনদেনের যুগ।

স্মার্টফোনে স্মার্ট ব্যাংকিং

দুই হাজার দশকের দিকে ইন্টারনেট যখন ঘরে ঘরে পৌঁছায়, তখন ব্যাংকগুলো ওয়েবসাইটে পূর্ণাঙ্গ সেবা দিতে শুরু করে। কিন্তু প্রকৃত বিপ্লব আসে স্মার্টফোনের আবির্ভাবে। কম্পিউটারের ওপর নির্ভর না করে আজ মানুষ হাতে ধরা ছোট্ট ফোন থেকেই লেনদেন সম্পন্ন করছে। এখন ব্যালান্স চেক করা থেকে বিনিয়োগ, এমনকি ঋণ পরিশোধ সবই কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার।

যে যুগে আমরা হাতে লেখা হিসাবের পাতায় দিন কাটাতাম আজ সেখান থেকে আমরা চলে এসেছি স্ক্রিনে। প্রযুক্তি শুধু ব্যাংকিং নয়, আমাদের পুরো আর্থিক ভাবনাকেই বদলে দিয়েছে। অনলাইন বা ই-ব্যাংকিং প্রমাণ করেছে, টাকা একসময় কাগজে বন্দি থাকলেও আজ তা সত্যিই আমাদের হাতের মুঠোয়।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত