আজকের দিনে ভিডিও নির্মাণ আর আগের মতো সময়সাপেক্ষ কাজ নয়। প্রযুক্তি বদলে দিয়েছে ভিডিও তৈরির ধরন। আগে একটি ভিডিও বানাতে ক্যামেরা সেটআপ, আলো, শুটিং, কাটিং, এডিটিং, মিউজিক ও সাবটাইটেল। প্রতিটি ধাপে লেগে যেত অনেক সময়, পরিশ্রম ও দক্ষতা। এখন সেই জায়গায় এসেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা AI Video Editing. মাত্র পাঁচ থেকে দশ মিনিটেই সম্পূর্ণ ভিডিও তৈরি করে দিচ্ছে স্মার্ট সফটওয়্যার। সামান্য কিছু ফুটেজ, টেক্সট বা ছবি আপলোড করলেই AI নিজে বুঝে নেয় ভিডিওর ধরন। কোথায় কাট দিতে হবে, কোথায় ট্রানজিশন মানাবে, কোন ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ব্যবহার করা উচিত বা কোন ফন্ট চোখে আরামদায়ক লাগবে। আগে একটি ভিডিও এডিট করতে যেখানে লাগত দু-তিন ঘণ্টা অথবা আরো বেশি। এখন সেই কাজ হচ্ছে কয়েক মিনিটেই।
বিশ্বে বর্তমানে কনটেন্ট নির্মাতাদের মধ্যে AI ভিডিও এডিটিং ব্যবহারের হার দ্রুত বাড়ছে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২৫ সালের জরিপে প্রায় ৮৬ শতাংশ কনটেন্ট ক্রিয়েটর কোনো না কোনোভাবে AI ব্যবহার করছেন। তাদের মধ্যে ৭৬ শতাংশ বলেছেন, ভিডিও তৈরির সময় কমেছে এবং ভিউয়ারশিপ বেড়েছে। বিশ্লেষকদের ধারণা, AI-ভিত্তিক ভিডিও মার্কেট আগামী কয়েক বছরে ১২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। ইউটিউব, ফেসবুক, টিকটক, ইনস্টাগ্রামÑসব জায়গাতেই কনটেন্টের প্রতিযোগিতা যখন বাড়ছে। তখন দ্রুত মানসম্মত ভিডিও বানানোই হচ্ছে সাফল্যের চাবিকাঠি। এই জায়গায় AI-ই দিয়েছে সবচেয়ে বড় সুবিধা।
বাংলাদেশের বাস্তবতায় এই পরিবর্তন আরো গুরুত্বপূর্ণ। দেশে সাত কোটিরও বেশি স্মার্টফোন ব্যবহারকারী। প্রতিদিন সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড হয় লক্ষাধিক ভিডিও। ভ্রমণ, রান্না, শিক্ষা, নিউজ ও পণ্য বিক্রি। সব ক্ষেত্রেই ভিডিও এখন প্রধান মাধ্যম। আগে যারা ভিডিও বানানোর অভিজ্ঞতা ছাড়া কনটেন্ট তৈরি করতে পারতেন না। আজ তারা শুধু মোবাইল ফোন আর কয়েকটি AI অ্যাপ দিয়েই পেশাদার মানের ভিডিও তৈরি করতে পারছেন। অনেক তরুণ এখন ঘরে বসেই আয় করছেন, ব্যবসা এগিয়ে নিচ্ছেন, আবার কেউ কেউ পূর্ণ সময়ের কনটেন্ট নির্মাতা হয়ে উঠেছেন।
AI-এর সবচেয়ে শক্তিশালী দিক হলো স্বয়ংক্রিয়তা। কোনো ফুটেজে অপ্রয়োজনীয় অংশ থাকলে তা নিজেই বাদ দেয়। আলো কম থাকলে উজ্জ্বলতা বাড়ায়। শব্দের ব্যাকগ্রাউন্ড নয়েজ কমিয়ে দেয়। এমনকি ভয়েসওভারও তৈরি করে দিতে পারে মানুষের মতো স্বরভঙ্গিতে। থাম্বনেইল ডিজাইন করাও এখন আর ঝামেলা নয়। AI ভিডিও দেখে নিজেই আকর্ষণীয় একটি থাম্বনেইল তৈরি করে দেয়। ফলে দর্শক ভিডিওতে ক্লিক করার সম্ভাবনা বাড়ে। যারা প্রতিদিন এক বা একাধিক ভিডিও আপলোড করেন। তাদের জন্য এটি সত্যিকারের গেমচেঞ্জার।
তবে প্রযুক্তির যেমন সুবিধা আছে, তেমনি কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। AI সবসময় ভিডিওর আবেগ বুঝতে পারে না। অনেক সময় ভিডিও খুব টেমপ্লেট ধরনে বা যান্ত্রিক হয়ে যায়। ব্যক্তিগত স্পর্শ, সৃজনশীল চিন্তা, গল্প বলার মানসিকতা। এসব এখনো মানুষের হাতে সবচেয়ে ভালো হয়ে থাকে। তাই AI হবে সহকারী, পরিচালক নয়। মৌলিকত্ব ধরে রাখতে হলে নির্মাতাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে কীভাবে ভিডিওটিকে ভিন্ন ও আকর্ষণীয় করা যায়। কপিরাইট, লাইসেন্স ও গ্রাফিকস ব্যবহারে সতর্কতাও জরুরি।
রাত জেগে শেষ মুহূর্তে ভিডিও বানানোর সেই যুগ শেষ হয়ে যাচ্ছে। এখন যে নির্মাতা কয়েক মিনিটেই ভিডিও বানিয়ে দিচ্ছেন। তার কৃতিত্ব শুধু প্রযুক্তির নয়Ñসৃজনশীলতারও। AI Video Editing কনটেন্ট নির্মাণের বিশ্বকে বদলে দিয়েছে। যারা আগে ভাবতেন ভিডিও বানানো কঠিন। সময়সাপেক্ষ বা ব্যয়বহুল। এখন তারাও সহজেই শুরু করতে পারছেন। শুধু একটি আইডিয়া থাকলেই সুযোগ তৈরি হয়। বাকি কাজ করে দেয় প্রযুক্তি। ভবিষ্যতে হয়তো আমরা ভিডিও বানাতে বলব : ‘আমি যা বলতে চাই, সেটি ৩০ সেকেন্ডে একটি ভিডিও করে দাও’Ñআর AI মুহূর্তেই তা তৈরি করে দেবে। সেই ভবিষ্যৎ আসতে খুব বেশি সময় লাগবে না। তবে মনে রাখা জরুরিÑপ্রযুক্তি যত উন্নত হবে, মানুষের গল্প, আবেগ ও ব্যক্তিত্ব তত মূল্যবান হয়ে উঠবে। AI সাহায্য করবে, ভিডিওর প্রাণ দেবে মানুষই।

