হাসান রোবায়েত
সেদিন দুপুরের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। রুমে অমাবস্যার মতো ফুটে আছে কালো মর্মর আর বুদবুদ করছে অন্ধকার। আমার পাশেই সজীবের বিছানা, ইউসুফের ভাইয়েরা যেমন কুয়ার গভীরে তাকিয়ে দেখতে চেয়েছিল মৃত্যুর নিকটস্থ হাহাকার, সেভাবেই হাঁ করে খুলে রাখা আমার শেলফের দিকে চেয়ে থাকি। ফ্যানের বাতাসে একটা কপাট নড়ছে, তাও কৃতদাসের মতো অসহায়।
সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। এখন ঘরটাতে দাউদাউ করছে নিঃশ্বাস। হঠাৎ একটা আশ্চর্য প্রশ্নের মুখে পড়ে যাই। দেখি, সিসার অক্ষর খুঁটে খুঁটে প্রেসের কর্মীরা যেমন বাক্য সাজায়, সেভাবেই আমার শূন্যতায় তৈরি হচ্ছে প্রশ্নটি, কালগোখরার মতো ফণা বাঁকিয়ে হিস হিস করছে কোথাও। মানুষ তার স্মৃতি জমানোর প্রথম দিন থেকেই বারবার পেছনে ফিরে যেতে যায়—যেন সেখানেই তার সংকেতময় হাওয়া প্রতিদিন দোলা দিচ্ছে পাতায়, যেন সে এক নদীর দেশ, যা তাকে পৌঁছে দেবে সুখ-দুঃখের পাড়ে, আমূল মর্মতায়। বারবার মনে করতে চাই—ঠিক কখন নবীজিকে প্রথম অনুভব করতে পারি আমি?
বন্ধ জানালার ওপাশে কে দাঁড়িয়ে আছে তার সমস্ত বৈভবসহ সে খবর কীভাবে পাওয়া যায়! কত কত নীরব সন্দেহ ঘিরে রাখে প্রতিবেশ অথচ উত্তর মেলে না। আমারও অবস্থা হয়েছে তেমন। তবুও খুঁজতে থাকি কবে কখন নবীজির নাম শুনেছিলাম। যেটুকু মনে পড়ে—ধরমপুরের মধ্য পাড়ায় যে দিঘি তক্ষকের ডাকের মতো ঘন সেখানে প্রায়ই হাঁস খুঁজতে যাই আমি।
হাঁসগুলো সুযোগ পেলেই বাড়ি ফেরে না, রাত্রে দিঘির পাড়েই ডিম দেয়, সকালে যে-ই দেখতে পায় হঠাৎ সৌভাগ্যের দ্বিধায় ডিমগুলো লুকিয়ে হজম করে ফেলে। সেদিন রাতেও আমাদের হাঁসগুলো বাড়ি ফেরে না। মা সকাল সকাল আমাকে পুকুর পাড়ে যেতে বলে, কিন্তু ভুলে যাই আমি। তখন দুপুর প্রায় হয়ে এসেছে, সূর্য তার গোল গোল অশ্বের পিঠে চড়ে পিতরাজের গাছের মাথা বরাবর নেমে এসেছে। কাউকে না পেয়ে একলাই পুকুরের দিকে যাই। দেখি, হাঁস তো দূরের কথা পানির উপর তাদের বিলীয়মান ঢেউও পাড়ে ক্ষয়ে গেছে অনেক আগেই। পিতরাজের ফোকরে একটা পাখি ঢুকতেই চিঁচিঁ আওয়াজ করতে শুরু করেছে কয়েকটা ভাতশালিকের ছানা। ফরফর করতে থাকে আমার লোভ। গাছে উঠে হাত ঢুকিয়ে খোড়লে—কী ভ্যাপসা গরম যেন বাতাসও সেদ্ধ হয়ে আছে এখানে। রঙ্গন ফুলের নলের মতো নতুন পালক উঠেছে বাচ্চাগুলোর। হাতের তালুর মধ্যে দুটা বাচ্চা নিয়ে নেমে আসি। পরিবারের অন্য পাখিটা তখন ড্রাগনের মতো তেড়ে আসছে আর কাঁদছে। এমন সময় সেই আশ্চর্য ফকির যে আমাকে জোড় কবরের ওখানে দূরের গ্রামের গল্প করেছিল, সে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি ভয় পেয়ে যাই। পিতরাজের একটা ডাল খামচে ধরে রাখি। কয়েকটা লাল পিঁপড়া মুখে ডিম নিয়ে চলে যাচ্ছে বাসার দিকে।
আমাকে উদ্দেশ করে ফকির বলতে থাকে—‘বাচ্চাগুলোক ওগোরে ঘরোতি (ঘরে) থোও, নিচে আনলে না খায়া মরে যাবি ওরা, আর ওগোরে বাপ-মাও মন্নি দিবি, তারপর মাটিত নামো, নবী মোহাম্মাদ (সা.)-এর একটা কিস্তে শুনাই।’ গল্প শোনার লোভেই বাচ্চাগুলো রেখে নেমে আসি আমি। সে আমাকে নবীজির কথা বলতে থাকে—‘একদিন তার এক সাথি পাখির একটা বাচ্চা নিয়ে তার কাছে আচ্চিল, বাচ্চাডার পিছে পিছে মাও পাখিডাও উড়ে আচ্চে, ক্যাংকা কান্দিচ্চিলো পাখিডা। নবী তার সাথীক কোলেন (বললেন), তুমি যে পাখিডার বাচ্চাক নিয়ে আচ্চো, দ্যাকো তো ওর মাও ক্যাংকা ডাক পারিচ্চে, বাচ্চাগুলের জন্যে তো তার ফাপর (মন কেমন করা) লাগিচ্চে। যাও যেটি থেকে বাচ্চাগুলোক নিয়ে আচ্চো সেটি থুয়ে আসো আবার। দয়াল নবীর এই কতা শুনে বাচ্চাগুলোক তার বাসাত থুয়ে আসে সেই সাথিডা তারপর বুজবের পায়, মায়ের মমতা কী জিনিস।’
নবীজির এমন গল্প পরে স্কুলের বইতে পড়েছিলাম। কেমন মায়া মায়া সে গল্প। মক্তবের হুজুরও নবীজির কথা বলেছিলেন, কিন্তু সেভাবে মনেই রাখতে পারিনি। হয়তো অনেক দিনই শুক্রবারে খুতবায় মসজিদের ইমাম নবীজির হাদিস বলেছেন, তার জীবনী বলেছেন, কিন্তু মন দিয়ে শুনতেই পারিনি সেসব। ছোটদের মসজিদের মূল ঘরে ঢুকতেই দিত না, বারান্দায় বসতে বলত সবাই। বাইরে থেকে আর মন লাগত না খুতবায়। আমি বরং মার কাছ থেকেই নবীজির কথা শুনেছি অনেক।
তারপর ফকিরকে বলি, ‘আচ্চা, আপনি হামাগেরে নবীর আর কিস্তে জানেন না?’ সে বলে, ‘জানি। দয়াল নবীর কত কতা, কত নসিহত, কত কষ্ট করছিলেন আল্লার হুকুম তামিল করার জন্য, তার কি শ্যাষ আছে, বাবা!’ আমি বলি, ‘তালে আরো শোনান না!’ তারপর সেই ফকির হাঁটতে হাঁটতে দুপুর পেরোতে থাকে। বুনোগুল্ম আর পাতায় পাতায় তখন রোদের শিরা ভেসে উঠছে, দিঘির মধ্যখানে কঞ্চির উপর একটা রুপালি-সবুজ মাছরাঙা অপেক্ষা করছে অতল পানির থেকে কখন ভেসে উঠবে মাছ। জমিতে সার নিয়ে যাচ্ছে এ পাড়ার কেউ কেউ, তাদের লুঙ্গিতে কাদা আর ঘাসের মায়াকাজল।
আরেকটু এগুলেই কলমিফুলের ঘ্রাণ, সেখানে একটা বটগাছ, সিমেন্টের চক্রাকার ঘের, ছায়া আর পাতার শনশন শব্দ ঝরে পড়ছে। ওখানে বসলো সে, আমাকেও বসতে বললো। একটু সামনেই কলতলা, ছোট ছোট ছেলেমেয়ে কলের হ্যান্ডেলে ঝুলে ঝুলে লোটায় পানি ভরছে আর অখণ্ড আনন্দে গায়ে ঢেলে দিচ্ছে। কথা বলা শুরু করল সেই আশ্চর্য ফকির—‘শোনো, আরব দ্যাশের টাউনের মানষেরা তকোন ছোলপোলের সাস্তো ভালোর জন্যে আর মুখের ভাষা ভালো কোরবের জন্যে গ্রামোত পাটাচ্চিলো, হামাগেরে নবীকও তাই মা হালিমার কাচে দিছিলো তার দাদা। যকোনো থেকে নবী মা হালিমার কোলোত যান সেই থেকেই তার সংসারোত আয়-উন্নতি শুরু হয়, তাগেরে উট আর গাদাও বলশালী হয়া যায়, আগে যে উটের দুধই হচ্চিলো না তার একন ম্যালা দুধ হয়। ইংকে বরকত দিছিলো আল্লা হামাগের নবীক।’ এইসব কথা বলার সময় কী উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল ফকিরকে, যেন সে বনী সা’দ ইবনে বকর গোত্রের সেই দুধমাতার আনন্দ দেখতে পাচ্ছিল চাক্ষুষ। এরপর নবীজির বক্ষ চিরে জিব্রিল আমিন কী কী করলেন, সেসব বললো ফকির। তখন সুবিল থেকে ঠান্ডা বাতাস যেন এপারের বটগাছটিতে মাখিয়ে দিচ্ছে মায়াঞ্জন।
তায়েফের দশ দিন, নবীজির ওপর সেখানকার দুর্বৃত্তদের অকথ্য ব্যবহার, নবীজির পায়ের রক্তে জুতা ভিজে যাওয়ার ঘটনা আর তায়েফবাসীকে ক্ষমা করার কথা বলে সে। বিদ্রুপ আর ঘৃণায় সারা শরীর রি-রি করে আমার। যে মানুষ পাখির চোখের মায়ায় দেখতে পান গোধূলির অয়নপথ, তাকে কী করে আঘাত করতে পারে তায়েফের বর্বরেরা! তাদের চেরা জিভ যেন লকলক করে ওঠে দূরের দিগন্তে, কেবল হিস-হিস শব্দ শুনতে পাই বাতাসের চারধারে।
হেরা পর্বতে নবীজির ধ্যানের কথা বলে সে। কীভাবে দিনের পর দিন বিবি খাদিজা (রা.) তার পাশে চৈত্রের ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন, জিব্রাইল (আ.) কোরআনের সুসংবাদ নিয়ে এলে কেমন বিচলিত হয়ে পড়েন নবীজি, সেসবও বলে সে। একটা দুপুর গড়িয়ে তখন বিকালের আলোছায়ায় প্রবেশ করছে ধীরে ধীরে। সারা ধরমপুর যেন হিজলফুলের রেণুতে ছেয়ে আছে। সোহাগদের অর্জুন গাছে হয়তো ফিঙ্গে পাখিটাও ফিরে এসেছে সূর্যের অশোক মেখে। বাড়ি ফিরে আসি আমি।
নবীজির কথা শোনার পর কেমন যেন ঘোর লেগে যায়। একটা আনোখা নদীর হাওয়ায় যেন দিন দিন ভেসে যাচ্ছি আমি। সেখানে মৌরিফুলের খেত ছোট ছোট মাছেদের সঙ্গে কথা বলে। ভেড়াগুলো গুল্মের বন পার হয়ে চলে যায় ইয়াসরিবের মাঠে—মরুঘূর্ণির পাশেও তারা চিরকাল হরিণবাঁকের দেখা পায়। এমন উন্মীল হাওয়ায় আমার মনে পড়ে—আমাদের চালতাগাঙের বনে যে ছোট্ট টিলা মেঘের আড়ালে ঘুম যায়, সেখানে বাবলাগাছের নিচে শনের অন্ধকার, মোনামুনির জঙ্গল—ওখানে যদি নবীজির মতো একলা বসে থাকি আমি তবে কি তার দেখা পাব? মা বলেছিল, স্বপ্নে নবীজিকে দেখা যায়। তবে কি গড়ের যে ঢাল খিলানের বক্রতার মতো চিরস্থির, যদি আমিও সেখানে ধ্যানের প্রতীক্ষায় বসে থাকি, তবে কি নবীজির প্রিয় মুখ ভেসে উঠবে অয়নপথের পাড়ে?
তন্দ্রা কেটে যায়। নবীজিকে প্রথম ভালোবাসার দিনগুলো ভেসে যেতে থাকে তার সমস্ত প্রার্থনায়। তখন মাদরাসার এই ঘরের প্রতিটি বায়ুকণায় প্রতিধ্বনিত হতে থাকে—“ইন্নাল্লাহা ওয়া মালাইকাতাহু ইউসাল্লুনা আলান্নাবী। ইয়া আইয়্যুহাল্লাজিনা আমানু সাল্লু আলাইহি ওয়া সাল্লিমু তাসলিমা। ইন্নাল্লাহা ওয়া মালাইকাতাহু ইউসাল্লুনা আলান্নাবী। ইয়া আইয়্যুহাল্লাজিনা আমানু সাল্লু আলাইহি ওয়া সাল্লিমু তাসলিমা। ইন্নাল্লাহা ওয়া মালাইকাতাহু ইউসাল্লুনা আলান্নাবী। ইয়া আইয়্যুহাল্লাজিনা আমানু সাল্লু আলাইহি ওয়া সাল্লিমু তাসলিমা। ইন্নাল্লাহা ওয়া মালাইকাতাহু ইউসাল্লুনা আলান্নাবী। ইয়া আইয়্যুহাল্লাজিনা আমানু সাল্লু আলাইহি ওয়া সাল্লিমু তাসলিমা।”
সেদিন দুপুরের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। রুমে অমাবস্যার মতো ফুটে আছে কালো মর্মর আর বুদবুদ করছে অন্ধকার। আমার পাশেই সজীবের বিছানা, ইউসুফের ভাইয়েরা যেমন কুয়ার গভীরে তাকিয়ে দেখতে চেয়েছিল মৃত্যুর নিকটস্থ হাহাকার, সেভাবেই হাঁ করে খুলে রাখা আমার শেলফের দিকে চেয়ে থাকি। ফ্যানের বাতাসে একটা কপাট নড়ছে, তাও কৃতদাসের মতো অসহায়।
সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। এখন ঘরটাতে দাউদাউ করছে নিঃশ্বাস। হঠাৎ একটা আশ্চর্য প্রশ্নের মুখে পড়ে যাই। দেখি, সিসার অক্ষর খুঁটে খুঁটে প্রেসের কর্মীরা যেমন বাক্য সাজায়, সেভাবেই আমার শূন্যতায় তৈরি হচ্ছে প্রশ্নটি, কালগোখরার মতো ফণা বাঁকিয়ে হিস হিস করছে কোথাও। মানুষ তার স্মৃতি জমানোর প্রথম দিন থেকেই বারবার পেছনে ফিরে যেতে যায়—যেন সেখানেই তার সংকেতময় হাওয়া প্রতিদিন দোলা দিচ্ছে পাতায়, যেন সে এক নদীর দেশ, যা তাকে পৌঁছে দেবে সুখ-দুঃখের পাড়ে, আমূল মর্মতায়। বারবার মনে করতে চাই—ঠিক কখন নবীজিকে প্রথম অনুভব করতে পারি আমি?
বন্ধ জানালার ওপাশে কে দাঁড়িয়ে আছে তার সমস্ত বৈভবসহ সে খবর কীভাবে পাওয়া যায়! কত কত নীরব সন্দেহ ঘিরে রাখে প্রতিবেশ অথচ উত্তর মেলে না। আমারও অবস্থা হয়েছে তেমন। তবুও খুঁজতে থাকি কবে কখন নবীজির নাম শুনেছিলাম। যেটুকু মনে পড়ে—ধরমপুরের মধ্য পাড়ায় যে দিঘি তক্ষকের ডাকের মতো ঘন সেখানে প্রায়ই হাঁস খুঁজতে যাই আমি।
হাঁসগুলো সুযোগ পেলেই বাড়ি ফেরে না, রাত্রে দিঘির পাড়েই ডিম দেয়, সকালে যে-ই দেখতে পায় হঠাৎ সৌভাগ্যের দ্বিধায় ডিমগুলো লুকিয়ে হজম করে ফেলে। সেদিন রাতেও আমাদের হাঁসগুলো বাড়ি ফেরে না। মা সকাল সকাল আমাকে পুকুর পাড়ে যেতে বলে, কিন্তু ভুলে যাই আমি। তখন দুপুর প্রায় হয়ে এসেছে, সূর্য তার গোল গোল অশ্বের পিঠে চড়ে পিতরাজের গাছের মাথা বরাবর নেমে এসেছে। কাউকে না পেয়ে একলাই পুকুরের দিকে যাই। দেখি, হাঁস তো দূরের কথা পানির উপর তাদের বিলীয়মান ঢেউও পাড়ে ক্ষয়ে গেছে অনেক আগেই। পিতরাজের ফোকরে একটা পাখি ঢুকতেই চিঁচিঁ আওয়াজ করতে শুরু করেছে কয়েকটা ভাতশালিকের ছানা। ফরফর করতে থাকে আমার লোভ। গাছে উঠে হাত ঢুকিয়ে খোড়লে—কী ভ্যাপসা গরম যেন বাতাসও সেদ্ধ হয়ে আছে এখানে। রঙ্গন ফুলের নলের মতো নতুন পালক উঠেছে বাচ্চাগুলোর। হাতের তালুর মধ্যে দুটা বাচ্চা নিয়ে নেমে আসি। পরিবারের অন্য পাখিটা তখন ড্রাগনের মতো তেড়ে আসছে আর কাঁদছে। এমন সময় সেই আশ্চর্য ফকির যে আমাকে জোড় কবরের ওখানে দূরের গ্রামের গল্প করেছিল, সে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি ভয় পেয়ে যাই। পিতরাজের একটা ডাল খামচে ধরে রাখি। কয়েকটা লাল পিঁপড়া মুখে ডিম নিয়ে চলে যাচ্ছে বাসার দিকে।
আমাকে উদ্দেশ করে ফকির বলতে থাকে—‘বাচ্চাগুলোক ওগোরে ঘরোতি (ঘরে) থোও, নিচে আনলে না খায়া মরে যাবি ওরা, আর ওগোরে বাপ-মাও মন্নি দিবি, তারপর মাটিত নামো, নবী মোহাম্মাদ (সা.)-এর একটা কিস্তে শুনাই।’ গল্প শোনার লোভেই বাচ্চাগুলো রেখে নেমে আসি আমি। সে আমাকে নবীজির কথা বলতে থাকে—‘একদিন তার এক সাথি পাখির একটা বাচ্চা নিয়ে তার কাছে আচ্চিল, বাচ্চাডার পিছে পিছে মাও পাখিডাও উড়ে আচ্চে, ক্যাংকা কান্দিচ্চিলো পাখিডা। নবী তার সাথীক কোলেন (বললেন), তুমি যে পাখিডার বাচ্চাক নিয়ে আচ্চো, দ্যাকো তো ওর মাও ক্যাংকা ডাক পারিচ্চে, বাচ্চাগুলের জন্যে তো তার ফাপর (মন কেমন করা) লাগিচ্চে। যাও যেটি থেকে বাচ্চাগুলোক নিয়ে আচ্চো সেটি থুয়ে আসো আবার। দয়াল নবীর এই কতা শুনে বাচ্চাগুলোক তার বাসাত থুয়ে আসে সেই সাথিডা তারপর বুজবের পায়, মায়ের মমতা কী জিনিস।’
নবীজির এমন গল্প পরে স্কুলের বইতে পড়েছিলাম। কেমন মায়া মায়া সে গল্প। মক্তবের হুজুরও নবীজির কথা বলেছিলেন, কিন্তু সেভাবে মনেই রাখতে পারিনি। হয়তো অনেক দিনই শুক্রবারে খুতবায় মসজিদের ইমাম নবীজির হাদিস বলেছেন, তার জীবনী বলেছেন, কিন্তু মন দিয়ে শুনতেই পারিনি সেসব। ছোটদের মসজিদের মূল ঘরে ঢুকতেই দিত না, বারান্দায় বসতে বলত সবাই। বাইরে থেকে আর মন লাগত না খুতবায়। আমি বরং মার কাছ থেকেই নবীজির কথা শুনেছি অনেক।
তারপর ফকিরকে বলি, ‘আচ্চা, আপনি হামাগেরে নবীর আর কিস্তে জানেন না?’ সে বলে, ‘জানি। দয়াল নবীর কত কতা, কত নসিহত, কত কষ্ট করছিলেন আল্লার হুকুম তামিল করার জন্য, তার কি শ্যাষ আছে, বাবা!’ আমি বলি, ‘তালে আরো শোনান না!’ তারপর সেই ফকির হাঁটতে হাঁটতে দুপুর পেরোতে থাকে। বুনোগুল্ম আর পাতায় পাতায় তখন রোদের শিরা ভেসে উঠছে, দিঘির মধ্যখানে কঞ্চির উপর একটা রুপালি-সবুজ মাছরাঙা অপেক্ষা করছে অতল পানির থেকে কখন ভেসে উঠবে মাছ। জমিতে সার নিয়ে যাচ্ছে এ পাড়ার কেউ কেউ, তাদের লুঙ্গিতে কাদা আর ঘাসের মায়াকাজল।
আরেকটু এগুলেই কলমিফুলের ঘ্রাণ, সেখানে একটা বটগাছ, সিমেন্টের চক্রাকার ঘের, ছায়া আর পাতার শনশন শব্দ ঝরে পড়ছে। ওখানে বসলো সে, আমাকেও বসতে বললো। একটু সামনেই কলতলা, ছোট ছোট ছেলেমেয়ে কলের হ্যান্ডেলে ঝুলে ঝুলে লোটায় পানি ভরছে আর অখণ্ড আনন্দে গায়ে ঢেলে দিচ্ছে। কথা বলা শুরু করল সেই আশ্চর্য ফকির—‘শোনো, আরব দ্যাশের টাউনের মানষেরা তকোন ছোলপোলের সাস্তো ভালোর জন্যে আর মুখের ভাষা ভালো কোরবের জন্যে গ্রামোত পাটাচ্চিলো, হামাগেরে নবীকও তাই মা হালিমার কাচে দিছিলো তার দাদা। যকোনো থেকে নবী মা হালিমার কোলোত যান সেই থেকেই তার সংসারোত আয়-উন্নতি শুরু হয়, তাগেরে উট আর গাদাও বলশালী হয়া যায়, আগে যে উটের দুধই হচ্চিলো না তার একন ম্যালা দুধ হয়। ইংকে বরকত দিছিলো আল্লা হামাগের নবীক।’ এইসব কথা বলার সময় কী উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল ফকিরকে, যেন সে বনী সা’দ ইবনে বকর গোত্রের সেই দুধমাতার আনন্দ দেখতে পাচ্ছিল চাক্ষুষ। এরপর নবীজির বক্ষ চিরে জিব্রিল আমিন কী কী করলেন, সেসব বললো ফকির। তখন সুবিল থেকে ঠান্ডা বাতাস যেন এপারের বটগাছটিতে মাখিয়ে দিচ্ছে মায়াঞ্জন।
তায়েফের দশ দিন, নবীজির ওপর সেখানকার দুর্বৃত্তদের অকথ্য ব্যবহার, নবীজির পায়ের রক্তে জুতা ভিজে যাওয়ার ঘটনা আর তায়েফবাসীকে ক্ষমা করার কথা বলে সে। বিদ্রুপ আর ঘৃণায় সারা শরীর রি-রি করে আমার। যে মানুষ পাখির চোখের মায়ায় দেখতে পান গোধূলির অয়নপথ, তাকে কী করে আঘাত করতে পারে তায়েফের বর্বরেরা! তাদের চেরা জিভ যেন লকলক করে ওঠে দূরের দিগন্তে, কেবল হিস-হিস শব্দ শুনতে পাই বাতাসের চারধারে।
হেরা পর্বতে নবীজির ধ্যানের কথা বলে সে। কীভাবে দিনের পর দিন বিবি খাদিজা (রা.) তার পাশে চৈত্রের ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন, জিব্রাইল (আ.) কোরআনের সুসংবাদ নিয়ে এলে কেমন বিচলিত হয়ে পড়েন নবীজি, সেসবও বলে সে। একটা দুপুর গড়িয়ে তখন বিকালের আলোছায়ায় প্রবেশ করছে ধীরে ধীরে। সারা ধরমপুর যেন হিজলফুলের রেণুতে ছেয়ে আছে। সোহাগদের অর্জুন গাছে হয়তো ফিঙ্গে পাখিটাও ফিরে এসেছে সূর্যের অশোক মেখে। বাড়ি ফিরে আসি আমি।
নবীজির কথা শোনার পর কেমন যেন ঘোর লেগে যায়। একটা আনোখা নদীর হাওয়ায় যেন দিন দিন ভেসে যাচ্ছি আমি। সেখানে মৌরিফুলের খেত ছোট ছোট মাছেদের সঙ্গে কথা বলে। ভেড়াগুলো গুল্মের বন পার হয়ে চলে যায় ইয়াসরিবের মাঠে—মরুঘূর্ণির পাশেও তারা চিরকাল হরিণবাঁকের দেখা পায়। এমন উন্মীল হাওয়ায় আমার মনে পড়ে—আমাদের চালতাগাঙের বনে যে ছোট্ট টিলা মেঘের আড়ালে ঘুম যায়, সেখানে বাবলাগাছের নিচে শনের অন্ধকার, মোনামুনির জঙ্গল—ওখানে যদি নবীজির মতো একলা বসে থাকি আমি তবে কি তার দেখা পাব? মা বলেছিল, স্বপ্নে নবীজিকে দেখা যায়। তবে কি গড়ের যে ঢাল খিলানের বক্রতার মতো চিরস্থির, যদি আমিও সেখানে ধ্যানের প্রতীক্ষায় বসে থাকি, তবে কি নবীজির প্রিয় মুখ ভেসে উঠবে অয়নপথের পাড়ে?
তন্দ্রা কেটে যায়। নবীজিকে প্রথম ভালোবাসার দিনগুলো ভেসে যেতে থাকে তার সমস্ত প্রার্থনায়। তখন মাদরাসার এই ঘরের প্রতিটি বায়ুকণায় প্রতিধ্বনিত হতে থাকে—“ইন্নাল্লাহা ওয়া মালাইকাতাহু ইউসাল্লুনা আলান্নাবী। ইয়া আইয়্যুহাল্লাজিনা আমানু সাল্লু আলাইহি ওয়া সাল্লিমু তাসলিমা। ইন্নাল্লাহা ওয়া মালাইকাতাহু ইউসাল্লুনা আলান্নাবী। ইয়া আইয়্যুহাল্লাজিনা আমানু সাল্লু আলাইহি ওয়া সাল্লিমু তাসলিমা। ইন্নাল্লাহা ওয়া মালাইকাতাহু ইউসাল্লুনা আলান্নাবী। ইয়া আইয়্যুহাল্লাজিনা আমানু সাল্লু আলাইহি ওয়া সাল্লিমু তাসলিমা। ইন্নাল্লাহা ওয়া মালাইকাতাহু ইউসাল্লুনা আলান্নাবী। ইয়া আইয়্যুহাল্লাজিনা আমানু সাল্লু আলাইহি ওয়া সাল্লিমু তাসলিমা।”
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. রইছ উদ্দীন বলেছেন, ছাত্রদল নেতা ও পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী জোবায়েদ হোসাইন হত্যাকাণ্ডে প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে—কেউ যেন আইনের ফাঁক দিয়ে কেউ বেরিয়ে না যায়।
৫ মিনিট আগেঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী রিয়াদ হাসানের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বোরকা ও পর্দাশীল নারীদের নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করার অভিযোগ উঠেছে। এই মন্তব্যের নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রীসংস্থা।
১ ঘণ্টা আগেসমাবেশে জোবায়েদের সহপাঠী সজল খান বলেন, “পুলিশ এখনো বর্ষার পরিবারের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করেনি। শুধু বর্ষা ও মাহির নয়, এই ঘটনায় বর্ষার পরিবারও জড়িত। গতকাল আদালতে আমাদের সঙ্গে পুলিশের আচরণ ছিল অমানবিক। আমাদের এক বান্ধবী ভিডিও করতে গেলে তার ফোন কেড়ে নেওয়া হয়। আমরা পুলিশের এই আচরণের তীব্র নিন্দা জানাই।”
১ ঘণ্টা আগেসামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ আইনের মামলায় বুয়েটের ২১তম ব্যাচের শিক্ষার্থী শ্রীশান্ত রায়কে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে মামলার তদন্ত কর্মকর্তার উপস্থিতিতে জামিনের বিষয়ে অধিকতর শুনানির জন্য আগামীকাল বৃহস্পতিবার দিন ধার্য করেন বিচার
১ ঘণ্টা আগে