নতুন রূপে আন্তর্জাতিক ইসলামি বইমেলা
মাহমুদুল হাসান আশিক
আন্তর্জাতিক ইসলামি বইমেলার এবারের আসর যেন অন্যরকম এক ইতিহাস প্রদর্শনী। আগের মতো কেবল কোরআন-হাদিসের ব্যাখ্যা, তাফসির কিংবা ধর্মীয় সাহিত্য নয়; এবারের মেলায় উঠে এসেছে দেড় দশকের রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, গুম-খুন ও দমন-পীড়নের দলিলভিত্তিক অসংখ্য বই।
স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পতনের পর প্রকাশিত এসব বই পাঠকদের সামনে উন্মোচন করছে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাসের এক অন্ধকার অধ্যায়। জুলাই বিপ্লবে ছাত্র-জনতার আন্দোলন, নির্যাতন, গোপন কারাগারের ভয়ংকর অভিজ্ঞতা এবং তথাকথিত ‘জঙ্গি’ নাটকের আড়ালের বাস্তবতা উঠে এসেছে বইগুলোর পাতায় পাতায়।
জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ ও পূর্ব চত্বরে আয়োজিত আন্তর্জাতিক ইসলামি বইমেলায় প্রবেশ করলেই চোখে পড়ে লাল, কালো আর ধূসর প্রচ্ছদের বইগুলো; যেগুলোর নামেই লুকিয়ে আছে ইতিহাসের কান্না, বন্দিত্বের দীর্ঘশ্বাস, স্বজন হারানোর বেদনা আর আন্দোলনের শপথ। এসব বইয়ের পাতায় পাতায় উঠে এসেছে এমন এক অধ্যায়ের চিত্র, যা আড়াল করে রেখেছিল ফ্যাসিবাদী শক্তি।
জুলাই গণঅভ্যুত্থান : রক্তাক্ত বাস্তবতার সাহিত্য
মেলায় সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি কেড়েছে ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান’ বিষয়ক বইগুলো। শিব্বীর আহমেদ শাওনের ‘রক্তে ভেজা জুলাই’, মোহাম্মদ জহির খানের ‘জুলাই আমার রক্তে’ এবং মো. মোস্তফা জামানের ‘রক্তে ভেজা বাংলাদেশ : পানি লাগবে পানি’ বইগুলো পাঠকদের ফিরিয়ে নিচ্ছে অগ্নিগর্ভ সময়ের ভেতরে।
জুলাই বিপ্লবে যাত্রাবাড়ীতে মাদরাসা শিক্ষার্থী ও জনতার অবদান নিয়ে আজিজ হাকিমের লেখা ‘কাজলা ওভার ব্রিজ’ বইটি মাদরাসা শিক্ষার্থীদের নজর কেড়েছে। লেখক ও সাংবাদিক আলফাজ আনামের ‘আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে হাসিনার পতন ও পলায়ন’ বইটিও রয়েছে পাঠক মহলের আলোচনায়। ইংরেজি ভাষায় লেখা ‘ইকোস অব জুলাই’ ও ‘দ্য র্যালি অব ফ্লাওয়ার্স অ্যান্ড বার্ডস’ বই দুটিও আন্তর্জাতিক পাঠকের সামনে উন্মুক্ত করেছে বাংলাদেশের এক অজানা অধ্যায়ের।
গোপন কারাগার থেকে সত্য উন্মোচন
বইমেলায় বেশি আলোচনায় এসেছে প্রামাণ্য দলিলভিত্তিক বইগুলো। এখানে গোপন করা ইতিহাস যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। লুকিয়ে রাখা সত্যগুলোকে প্রকাশ করে দেয় ‘আয়নাঘর’। ইয়াদ আল কুনাইবীর বইটি যেমন বন্দিজীবন ও গোপন কারাগারের ভেতরের ভীতিকর বাস্তবতা তুলে ধরে, তেমনি বিষয়টিকে আরো গভীরভাবে উন্মোচন করেছে ব্রিগেডিয়ার আমান আযমীর ‘আয়নাঘরের সাক্ষী’ ও ‘বিভীষিকাময় আয়নাঘর : ফ্যাসিবাদের গোপন কারাগারে ২৯০৮ দিন’ এবং ব্যারিস্টার মীর আহমদ বিন কাসেমের (আরমান) ‘আয়নাঘরের সাক্ষী’ বই দুটি। এগুলো শুধু আত্মকথা নয়; বরং রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের এক ভয়ংকর চিত্র। এছাড়া শেখ সোহাইবের ‘আওয়ামী বর্বরতার অন্ধকার বন্দীশালা’সহ এ-জাতীয় বইগুলো মিলিয়ে যেন এক সমষ্টিগত ট্রমার ইতিহাস গড়ে তুলেছে। বইগুলোর পাতায় পাতায় বর্ণিত হয়েছে গুম করে জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতন এবং অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া মানুষের কণ্ঠস্বর। মনযুর আহমাদের ‘পঁচাত্তর থেকে শাপলা’ বইটি ১৯৭৫ থেকে শুরু করে ২০১৩ সালের শাপলা হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত সময়ের রাজনৈতিক ঘটনার বিশ্লেষণ করেছে। রকীবুল হকের ‘আওয়ামী শাসনে আলেম নিপীড়ন’ বইটি ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের ওপর দমননীতি ও নির্যাতনের দলিল প্রকাশ করেছে পাঠকের সামনে।
‘জঙ্গি নাটকের দলিল’ ও রাষ্ট্রীয় দমনচিত্র
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবহার করে বিরোধী মত দমন এবং ধর্মভীরু মানুষকে ঘায়েল করতে নিরীহ মানুষকে জঙ্গি তকমা দিয়ে চালানো ‘ঈগলহান্ট’, ‘সানডেভিল’ ও ‘জাহাজবাড়ী’ নামক অভিযানসহ বিভিন্ন জঙ্গি নাটকের দলিলভিত্তিক বইগুলোও পাঠকের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে। বইগুলোর মধ্যে রয়েছে লেখক ও সাংবাদিক আবু সুফিয়ানের লেখা ‘ডার্ক ডকট্রিন’ ও ‘ক্রসফায়ারের নীলনকশা’। বইগুলো বিচারবহির্ভূত হত্যা ও রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সন্ত্রাসকে তুলে ধরা এক রক্তাক্ত দলিল।
শিশু-কিশোরদের বইয়েও প্রতিবাদের বার্তা
শিশুদের জন্য প্রকাশিত ‘গল্পে আঁকা জুলাই বিপ্লব’ ও মোহাম্মদ ফাহাদ ইবনে ইলিয়াসের ‘ফুল পাখিদের মিছিল’ বইয়ে সাহস ও স্বাধীনতার পাঠ দেওয়া হয়েছে সহজ ভাষায়। কিশোরদের জন্য ইবরাহীম জামিলের ‘ফুল পাখি ও বারুদ’ ও সৈয়দ রুখসানা জামান সানুর ‘জুলাই জেনোসাইড ২০২৪’ বইগুলো নতুন প্রজন্মকে রাজনৈতিক সচেতনতা ও প্রতিরোধের ভাবনা শেখাচ্ছে।
ম্যাগাজিনে নতুন ধারার সাংবাদিকতা
প্রিন্ট ম্যাগাজিনগুলোয়ও নতুন রাজনৈতিক চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছে। ‘বিহান’, ‘ষোলো’, ‘বাঙলানামা’ ও ‘কালান্তর’-এর বিশেষ সংখ্যাগুলোয় উঠে এসেছে জুলাই বিপ্লব, কোটা আন্দোলন ও তরুণদের রাজনৈতিক জাগরণ। ‘চিরায়ত’ পত্রিকার ‘শাপলা নামা’ সংখ্যায় উঠে এসেছে শাহবাগ ও শাপলা চত্বরের নির্মম ইতিহাস। এক অর্থে এসব ম্যাগাজিন বইমেলার প্রাণকেন্দ্রে নতুন ধারার সাংবাদিকতা তৈরি করছে।
ইতিহাসের দলিল
অন্যদিকে, রাজনৈতিক বাস্তবতা ও শেখ হাসিনার শাসনব্যবস্থার বৃহত্তর বিশ্লেষণ উঠে এসেছে আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের ‘হাসিনার ফ্যাসিবাদ : নির্বাসন থেকে দেখা’, মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ‘ফাঁসির সেল থেকে দেখা বাংলাদেশ’ এবং বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের ‘আওয়ামী সন্ত্রাসের শিকার ১ম ও ২য় খণ্ড’ বইগুলোয়। পাঠকদের মতে, এগুলো রাজনৈতিক প্রচার নয়; বরং ইতিহাসের সত্য দলিল।
স্টলে গিয়ে বইগুলো হাতে নিলে বোঝা যায়, এটি শুধু ইসলামি সাহিত্য উৎসব নয়; এটি যেন এক ধরনের ঐতিহাসিক নথি প্রদর্শনী। এখানে বই মানে শুধু গল্প নয়; বরং সাক্ষ্য, যন্ত্রণার স্মৃতি এবং হারানো কণ্ঠের পুনরুত্থান।
শেষ বিকালে তরুণ পাঠক নাফিসুল ইসলাম বললেন, বইগুলো পড়লে বোঝা যায়, ইতিহাস শুধু বিজয়ীদের হাতে লেখা নয়; বরং ভুক্তভোগীদেরও নিজের ভাষা আছে। তার কথার সঙ্গে মিলিয়ে বলা যায়, এই মেলার বইগুলো সেই হারানো কণ্ঠগুলোকেই ফিরিয়ে আনছে।
অপর এক পাঠক রনি আহমেদ বলেন, এসব বই কোনো কাল্পনিক রচনা নয়; বরং প্রত্যক্ষদর্শী, ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবারের সাক্ষ্যভিত্তিক দলিল।
লেখক ও সাংবাদিক আবু সুফিয়ান বলেন, জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর সাংবাদিকরা নির্ভয়ে সত্য প্রকাশ করতে পারছেন। দীর্ঘদিনের দমন-পীড়ন, নিপীড়ন ও রাষ্ট্রীয় জুলুমের পর্দা উন্মোচন হচ্ছে। এগুলো আমাদের সময়ের প্রতিবেদন ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আর্কাইভ। বইগুলো আজ বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসের নীরব সাক্ষ্য হয়ে উঠছে।
‘আওয়ামী শাসনে আলেম নিপীড়ন’ বইয়ের লেখক রকীবুল হক বলেন, পতিত আওয়ামী শাসনামলে বিরোধী মতের পাশাপাশি চরম জুলুম-নিপীড়নের শিকার হন আলেমরা। কিন্তু পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, নির্যাতিতরা যেমন তাদের ওপর নির্যাতনের কথা প্রকাশ করতে সাহস পেতেন না, তেমনি গণমাধ্যমগুলোও এসব প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেত। জুলাই বিপ্লবে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের পতনের পর মুখ খুলতে থাকেন ভুক্তভোগীরা। তাদের কথা পত্রিকার পাশাপাশি বইয়ের পাতায় স্থান করে নিচ্ছে।
সন্দীপন প্রকাশনীর প্রকাশক রোকন উদ্দিন বললেন, ‘শিশুদের ইতিহাস শেখানো মানে শুধু অতীত জানানো নয়, তাদের চেতনা গঠনের সূচনা।’
‘আয়নাঘরের সাক্ষী’ বইয়ের লেখক ও গুম থেকে ফেরা ব্যারিস্টার মীর আহমদ বিন কাসেম (ব্যারিস্টার আরমান) বলেন, ফ্যাসিবাদ কত নিষ্ঠুর ছিল তা আগামী ও তরুণ প্রজন্মকে জানানো অত্যন্ত জরুরি। শত শত গুমের শিকার যারা আর ফেরেনি, তাদের পক্ষে কথা বলেছি যেন তাদের সঙ্গে কী হয়েছে এর ধারণা জাতি পায়। নতুন প্রজন্মে ফ্যাসিবাদবিরোধী মনোভাব নির্মাণ হবে এসব বইয়ের মাধ্যমে। ভবিষ্যতে যাই হোক না কেন, ফ্যাসিবাদী আচরণ শুরু করলেই যেন প্রতিহত করতে পারে, সেজন্য সচেতনতা তৈরি করতে আমৃত্যু কথা বলে যাব।
আন্তর্জাতিক ইসলামি বইমেলায় এবারের বইগুলো নিছক ধর্মীয় ভাবধারার নয়; এগুলো সময়ের প্রতিবাদ, ইতিহাসের দলিল এবং নিপীড়নের বিরুদ্ধে লেখার সাহসের প্রতীক বলে মনে করছেন লেখক, প্রকাশক ও পাঠকরা। প্রতিটি বইয়ের পাতায় যেন লুকিয়ে আছে বন্দির আর্তনাদ, মায়ের শোক এবং তরুণের হারানো স্বপ্নের গল্প। আর সেই শব্দগুলো একযোগে বলছেÑনিপীড়ন যতই গভীর হোক, সত্যের কণ্ঠকে চিরদিন দমিয়ে রাখা যায় না। এ মেলায় তাই বই নয়, কথা বলছে সময়। বইয়ের পাতায় পাতায় ফুটে উঠছে নিপীড়নের চিত্র, যা একই সঙ্গে এক জাতির বেদনা, প্রতিরোধ ও আত্মত্যাগের ইতিহাস।
আন্তর্জাতিক ইসলামি বইমেলার এবারের আসর যেন অন্যরকম এক ইতিহাস প্রদর্শনী। আগের মতো কেবল কোরআন-হাদিসের ব্যাখ্যা, তাফসির কিংবা ধর্মীয় সাহিত্য নয়; এবারের মেলায় উঠে এসেছে দেড় দশকের রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, গুম-খুন ও দমন-পীড়নের দলিলভিত্তিক অসংখ্য বই।
স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পতনের পর প্রকাশিত এসব বই পাঠকদের সামনে উন্মোচন করছে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাসের এক অন্ধকার অধ্যায়। জুলাই বিপ্লবে ছাত্র-জনতার আন্দোলন, নির্যাতন, গোপন কারাগারের ভয়ংকর অভিজ্ঞতা এবং তথাকথিত ‘জঙ্গি’ নাটকের আড়ালের বাস্তবতা উঠে এসেছে বইগুলোর পাতায় পাতায়।
জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ ও পূর্ব চত্বরে আয়োজিত আন্তর্জাতিক ইসলামি বইমেলায় প্রবেশ করলেই চোখে পড়ে লাল, কালো আর ধূসর প্রচ্ছদের বইগুলো; যেগুলোর নামেই লুকিয়ে আছে ইতিহাসের কান্না, বন্দিত্বের দীর্ঘশ্বাস, স্বজন হারানোর বেদনা আর আন্দোলনের শপথ। এসব বইয়ের পাতায় পাতায় উঠে এসেছে এমন এক অধ্যায়ের চিত্র, যা আড়াল করে রেখেছিল ফ্যাসিবাদী শক্তি।
জুলাই গণঅভ্যুত্থান : রক্তাক্ত বাস্তবতার সাহিত্য
মেলায় সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি কেড়েছে ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান’ বিষয়ক বইগুলো। শিব্বীর আহমেদ শাওনের ‘রক্তে ভেজা জুলাই’, মোহাম্মদ জহির খানের ‘জুলাই আমার রক্তে’ এবং মো. মোস্তফা জামানের ‘রক্তে ভেজা বাংলাদেশ : পানি লাগবে পানি’ বইগুলো পাঠকদের ফিরিয়ে নিচ্ছে অগ্নিগর্ভ সময়ের ভেতরে।
জুলাই বিপ্লবে যাত্রাবাড়ীতে মাদরাসা শিক্ষার্থী ও জনতার অবদান নিয়ে আজিজ হাকিমের লেখা ‘কাজলা ওভার ব্রিজ’ বইটি মাদরাসা শিক্ষার্থীদের নজর কেড়েছে। লেখক ও সাংবাদিক আলফাজ আনামের ‘আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে হাসিনার পতন ও পলায়ন’ বইটিও রয়েছে পাঠক মহলের আলোচনায়। ইংরেজি ভাষায় লেখা ‘ইকোস অব জুলাই’ ও ‘দ্য র্যালি অব ফ্লাওয়ার্স অ্যান্ড বার্ডস’ বই দুটিও আন্তর্জাতিক পাঠকের সামনে উন্মুক্ত করেছে বাংলাদেশের এক অজানা অধ্যায়ের।
গোপন কারাগার থেকে সত্য উন্মোচন
বইমেলায় বেশি আলোচনায় এসেছে প্রামাণ্য দলিলভিত্তিক বইগুলো। এখানে গোপন করা ইতিহাস যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। লুকিয়ে রাখা সত্যগুলোকে প্রকাশ করে দেয় ‘আয়নাঘর’। ইয়াদ আল কুনাইবীর বইটি যেমন বন্দিজীবন ও গোপন কারাগারের ভেতরের ভীতিকর বাস্তবতা তুলে ধরে, তেমনি বিষয়টিকে আরো গভীরভাবে উন্মোচন করেছে ব্রিগেডিয়ার আমান আযমীর ‘আয়নাঘরের সাক্ষী’ ও ‘বিভীষিকাময় আয়নাঘর : ফ্যাসিবাদের গোপন কারাগারে ২৯০৮ দিন’ এবং ব্যারিস্টার মীর আহমদ বিন কাসেমের (আরমান) ‘আয়নাঘরের সাক্ষী’ বই দুটি। এগুলো শুধু আত্মকথা নয়; বরং রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের এক ভয়ংকর চিত্র। এছাড়া শেখ সোহাইবের ‘আওয়ামী বর্বরতার অন্ধকার বন্দীশালা’সহ এ-জাতীয় বইগুলো মিলিয়ে যেন এক সমষ্টিগত ট্রমার ইতিহাস গড়ে তুলেছে। বইগুলোর পাতায় পাতায় বর্ণিত হয়েছে গুম করে জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতন এবং অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া মানুষের কণ্ঠস্বর। মনযুর আহমাদের ‘পঁচাত্তর থেকে শাপলা’ বইটি ১৯৭৫ থেকে শুরু করে ২০১৩ সালের শাপলা হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত সময়ের রাজনৈতিক ঘটনার বিশ্লেষণ করেছে। রকীবুল হকের ‘আওয়ামী শাসনে আলেম নিপীড়ন’ বইটি ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের ওপর দমননীতি ও নির্যাতনের দলিল প্রকাশ করেছে পাঠকের সামনে।
‘জঙ্গি নাটকের দলিল’ ও রাষ্ট্রীয় দমনচিত্র
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবহার করে বিরোধী মত দমন এবং ধর্মভীরু মানুষকে ঘায়েল করতে নিরীহ মানুষকে জঙ্গি তকমা দিয়ে চালানো ‘ঈগলহান্ট’, ‘সানডেভিল’ ও ‘জাহাজবাড়ী’ নামক অভিযানসহ বিভিন্ন জঙ্গি নাটকের দলিলভিত্তিক বইগুলোও পাঠকের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে। বইগুলোর মধ্যে রয়েছে লেখক ও সাংবাদিক আবু সুফিয়ানের লেখা ‘ডার্ক ডকট্রিন’ ও ‘ক্রসফায়ারের নীলনকশা’। বইগুলো বিচারবহির্ভূত হত্যা ও রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সন্ত্রাসকে তুলে ধরা এক রক্তাক্ত দলিল।
শিশু-কিশোরদের বইয়েও প্রতিবাদের বার্তা
শিশুদের জন্য প্রকাশিত ‘গল্পে আঁকা জুলাই বিপ্লব’ ও মোহাম্মদ ফাহাদ ইবনে ইলিয়াসের ‘ফুল পাখিদের মিছিল’ বইয়ে সাহস ও স্বাধীনতার পাঠ দেওয়া হয়েছে সহজ ভাষায়। কিশোরদের জন্য ইবরাহীম জামিলের ‘ফুল পাখি ও বারুদ’ ও সৈয়দ রুখসানা জামান সানুর ‘জুলাই জেনোসাইড ২০২৪’ বইগুলো নতুন প্রজন্মকে রাজনৈতিক সচেতনতা ও প্রতিরোধের ভাবনা শেখাচ্ছে।
ম্যাগাজিনে নতুন ধারার সাংবাদিকতা
প্রিন্ট ম্যাগাজিনগুলোয়ও নতুন রাজনৈতিক চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছে। ‘বিহান’, ‘ষোলো’, ‘বাঙলানামা’ ও ‘কালান্তর’-এর বিশেষ সংখ্যাগুলোয় উঠে এসেছে জুলাই বিপ্লব, কোটা আন্দোলন ও তরুণদের রাজনৈতিক জাগরণ। ‘চিরায়ত’ পত্রিকার ‘শাপলা নামা’ সংখ্যায় উঠে এসেছে শাহবাগ ও শাপলা চত্বরের নির্মম ইতিহাস। এক অর্থে এসব ম্যাগাজিন বইমেলার প্রাণকেন্দ্রে নতুন ধারার সাংবাদিকতা তৈরি করছে।
ইতিহাসের দলিল
অন্যদিকে, রাজনৈতিক বাস্তবতা ও শেখ হাসিনার শাসনব্যবস্থার বৃহত্তর বিশ্লেষণ উঠে এসেছে আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের ‘হাসিনার ফ্যাসিবাদ : নির্বাসন থেকে দেখা’, মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ‘ফাঁসির সেল থেকে দেখা বাংলাদেশ’ এবং বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের ‘আওয়ামী সন্ত্রাসের শিকার ১ম ও ২য় খণ্ড’ বইগুলোয়। পাঠকদের মতে, এগুলো রাজনৈতিক প্রচার নয়; বরং ইতিহাসের সত্য দলিল।
স্টলে গিয়ে বইগুলো হাতে নিলে বোঝা যায়, এটি শুধু ইসলামি সাহিত্য উৎসব নয়; এটি যেন এক ধরনের ঐতিহাসিক নথি প্রদর্শনী। এখানে বই মানে শুধু গল্প নয়; বরং সাক্ষ্য, যন্ত্রণার স্মৃতি এবং হারানো কণ্ঠের পুনরুত্থান।
শেষ বিকালে তরুণ পাঠক নাফিসুল ইসলাম বললেন, বইগুলো পড়লে বোঝা যায়, ইতিহাস শুধু বিজয়ীদের হাতে লেখা নয়; বরং ভুক্তভোগীদেরও নিজের ভাষা আছে। তার কথার সঙ্গে মিলিয়ে বলা যায়, এই মেলার বইগুলো সেই হারানো কণ্ঠগুলোকেই ফিরিয়ে আনছে।
অপর এক পাঠক রনি আহমেদ বলেন, এসব বই কোনো কাল্পনিক রচনা নয়; বরং প্রত্যক্ষদর্শী, ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবারের সাক্ষ্যভিত্তিক দলিল।
লেখক ও সাংবাদিক আবু সুফিয়ান বলেন, জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর সাংবাদিকরা নির্ভয়ে সত্য প্রকাশ করতে পারছেন। দীর্ঘদিনের দমন-পীড়ন, নিপীড়ন ও রাষ্ট্রীয় জুলুমের পর্দা উন্মোচন হচ্ছে। এগুলো আমাদের সময়ের প্রতিবেদন ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আর্কাইভ। বইগুলো আজ বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসের নীরব সাক্ষ্য হয়ে উঠছে।
‘আওয়ামী শাসনে আলেম নিপীড়ন’ বইয়ের লেখক রকীবুল হক বলেন, পতিত আওয়ামী শাসনামলে বিরোধী মতের পাশাপাশি চরম জুলুম-নিপীড়নের শিকার হন আলেমরা। কিন্তু পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, নির্যাতিতরা যেমন তাদের ওপর নির্যাতনের কথা প্রকাশ করতে সাহস পেতেন না, তেমনি গণমাধ্যমগুলোও এসব প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেত। জুলাই বিপ্লবে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের পতনের পর মুখ খুলতে থাকেন ভুক্তভোগীরা। তাদের কথা পত্রিকার পাশাপাশি বইয়ের পাতায় স্থান করে নিচ্ছে।
সন্দীপন প্রকাশনীর প্রকাশক রোকন উদ্দিন বললেন, ‘শিশুদের ইতিহাস শেখানো মানে শুধু অতীত জানানো নয়, তাদের চেতনা গঠনের সূচনা।’
‘আয়নাঘরের সাক্ষী’ বইয়ের লেখক ও গুম থেকে ফেরা ব্যারিস্টার মীর আহমদ বিন কাসেম (ব্যারিস্টার আরমান) বলেন, ফ্যাসিবাদ কত নিষ্ঠুর ছিল তা আগামী ও তরুণ প্রজন্মকে জানানো অত্যন্ত জরুরি। শত শত গুমের শিকার যারা আর ফেরেনি, তাদের পক্ষে কথা বলেছি যেন তাদের সঙ্গে কী হয়েছে এর ধারণা জাতি পায়। নতুন প্রজন্মে ফ্যাসিবাদবিরোধী মনোভাব নির্মাণ হবে এসব বইয়ের মাধ্যমে। ভবিষ্যতে যাই হোক না কেন, ফ্যাসিবাদী আচরণ শুরু করলেই যেন প্রতিহত করতে পারে, সেজন্য সচেতনতা তৈরি করতে আমৃত্যু কথা বলে যাব।
আন্তর্জাতিক ইসলামি বইমেলায় এবারের বইগুলো নিছক ধর্মীয় ভাবধারার নয়; এগুলো সময়ের প্রতিবাদ, ইতিহাসের দলিল এবং নিপীড়নের বিরুদ্ধে লেখার সাহসের প্রতীক বলে মনে করছেন লেখক, প্রকাশক ও পাঠকরা। প্রতিটি বইয়ের পাতায় যেন লুকিয়ে আছে বন্দির আর্তনাদ, মায়ের শোক এবং তরুণের হারানো স্বপ্নের গল্প। আর সেই শব্দগুলো একযোগে বলছেÑনিপীড়ন যতই গভীর হোক, সত্যের কণ্ঠকে চিরদিন দমিয়ে রাখা যায় না। এ মেলায় তাই বই নয়, কথা বলছে সময়। বইয়ের পাতায় পাতায় ফুটে উঠছে নিপীড়নের চিত্র, যা একই সঙ্গে এক জাতির বেদনা, প্রতিরোধ ও আত্মত্যাগের ইতিহাস।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষার্থী ও ছাত্রদল নেতা জোবায়েদ হোসাইন হত্যাকাণ্ডের পর স্থগিত হওয়া বিশ্ববিদ্যালয় দিবস আগামী ২৭ অক্টোবর পালিত হবে। বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সভায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. রেজাউল করিম।
৫ ঘণ্টা আগে১৮৪৬ সালের ১৬ অক্টোবর চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী দিন। বোস্টনের ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতালে প্রথমবারের মতো এক রোগীর শরীরে ব্যথাহীন অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হয়। দাঁতের চিকিৎসক ডা. উইলিয়াম মর্টন রোগী গিলবার্ট অ্যাবটের মুখে ইথার গ্যাস শ্বাসের মাধ্যমে প্রয়োগ করেন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই রোগী
৫ ঘণ্টা আগেকরোনা ভ্যাকসিনের দীর্ঘমেয়াদি জটিলতা নিয়ে বাংলাদেশের মানুষদের মধ্যে রয়েছে নানা ভুল ধারণা এবং অন্ধবিশ্বাস। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্ক্যাবিসসহ কিছু সংক্রামক চর্মরোগ মহামারির আকার ধারণ করেছে। বেশির ভাগ মানুষ বিশ্বাস করে, করোনা ভ্যাকসিন গ্রহণ করার ফলে তাদের বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগ হচ্ছে। আবার
৫ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। আবহাওয়া পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন রোগবালাই আবির্ভাব হয়। বাংলাদেশে হেমন্তকালের শেষের দিকে শীতকাল খুব কাছাকাছি চলে আসে। ঋতু পরিবর্তনের এ সময় তাপমাত্রার ওঠানামা ও শুষ্ক বাতাসের কারণে সর্দি-কাশি, জ্বরসহ অন্যান্য রোগব্যাধি দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। শিশুদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা
৬ ঘণ্টা আগে