আধুনিক তুর্কি সংস্কৃতির নতুন বিন্যাসে নাজিপ ফজল

মাহমুদুল হাসান সুনান
প্রকাশ : ০৫ জুলাই ২০২৫, ১৩: ৪৮

১৮শ শতাব্দীর পর থেকেই পৃথিবীতে একটি ইউনিভার্সাল রেভল্যুশন হয়েছে। অর্থাৎ ফরাসি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর আনাচেকানাচে সিস্টেমেটিক বদলি এসেছে। আরব মহাসাগর থেকে ভারত মহাসাগরও বাদ যায়নি নয়া পৃথিবীর ছায়া থেকে। কিন্তু ইউরোপজুড়ে যখন রেনেসাঁ, পৃথিবীজুড়ে তখন শোষণ।

পুঁজিবাদ বা পুঁজিতন্ত্রের উত্থান পৃথিবীকে নয়া বন্দোবস্তের দিকে নিয়ে গেছে। এভাবে বহু বছর চলতে থাকলে এককালে এসে মানুষের মনস্তত্ত্ব থুবড়ে পড়ে। পুঁজিবাদ হয়ে উঠে ধর্ম। ধর্মকে আটকিয়ে ফেলে গোত্র। তখনো ইউরোপজুড়ে জ্ঞানের আলো ঝড়ের গতিতে ছুটছে, শুরুর দিকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুঁজিবাদী ভাবুকের দেখা মিললেও পরক্ষণেই স্বয়ং ইউরোপেই উত্থান ঘটে সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদবিরোধী ভাবুক, কবি ও দার্শনিকদের।

তুর্কিরা আদি আমল থেকেই ইউরোপের পাড়াপড়শি। কামালিজমের শুরুর দিকে প্রতিবেশী থেকে নুন আনার নাম করে আত্মপরিচয়হীন হয়ে উঠলেও পরক্ষণেই দেখা মিলে রিফর্ম তুর্কি ভাবুকদের, যারা সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের আখড়ায় থেকেও আলোর মশাল জ্বালিয়েছেন নতুন রিফর্মের দিকে। এমন এক দার্শনিক নাজিপ ফজল কিসাকুরেক (১৯০৪-১৯৮৩)।

কবি ও ঔপন্যাসিক হিসেবেই লোকে জানে। তবে তিনি একাধারে ছিলেন ভাবুক ও রিফর্মার। জন্মেছেন উনিশ শতকের একেবারে শুরুর দিকে। আগাগোড়া ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র কায়দা থেকে বেরিয়ে সকল প্রকার দল-মত ও পথকে কবুল করে নেওয়া বর্তমান তুর্কি রাষ্ট্রের বুদ্ধিবৃত্তিক কাউন্টারের অন্যতম ব্যক্তি। তুর্কি দেশটি তখন পুঁজিবাদের আখড়া। ধর্মীয়-বিধর্মীয় কোন প্রতিষ্ঠানই পুঁজিবাদকে ছাড়িয়ে উঠতে পারছে না। পৃথিবীর একদিকে পুঁজিবাদ অন্যদিকে রিফর্ম হারাকাত।

তুর্কি কবি নাজিম হিকমত তখন সদ্য সোভিয়েত সফর করে দেশে ফিরেছেন। সাংবাদিকদের এক ইন্টারভিউতে তাকে তৎকালীন তুর্কি কবি ও লেখকদের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান নাজিপ ফজল কিসাকুরেকের কথা। অথচ এই নাজিপ ফজলকে অনেকে চেনেন ইসলামিস্ট হিসেবে। মজার বিষয় ইসলামিস্টরা দাবি করেন না ফজল তাদের, আর কামালবাদীরা দাবি করেন নাজিপ ফজল আমাদের। এমনকি অবাক করার বিষয়, তুরস্কের বর্তমান প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এই নাজিপ ফজলের হাতেখড়ি।

প্রশ্ন আসে, কীভাবে ধর্মবিরোধী কামালিস্টরা কিংবা সোভিয়েতপন্থি মার্কিস্ট কবি নাজিম হিকমতের পছন্দের ব্যক্তি হলেন নাজিপ ফজল কিসাকুরেক। এখানেই নাজিপ ফজলের আধুনিক তুর্কি সমাজের রিফর্ম টুইস্ট।

নাজিপ ফজল দুনিয়ার সহস্র মতবাদকে একটি সুতোয় বেঁধেছেন। এরপর এজমালি সুতোগুলি রঙিন করে এঁকেছেন, যেই সুতোয় বাঁধা ছিল পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ। ধর্মমত কিংবা যেকোনো ভিন্নমতকে তিনি ছাপিয়ে মূল শত্রুকে ঘায়েল করার পদ্ধতি তৈরি করেছেন তুর্কি ভাবুকদের মাঝে। সে কারণেই সেক্যুলার পাড়া কিংবা মার্ক্স ধারার নাজিম হিকমতের পছন্দের ব্যক্তি হয়ে উঠেছিলেন মুসলিম ভাবুক নাজিপ ফজল। মার্কস নিয়ে নাজিপ ফজলের বহু গ্রন্থ ও কবিতা রয়েছে। একই সঙ্গে রয়েছে আল্লামা ইকবাল নিয়েও প্রবন্ধ-নিবন্ধ।

এদিকে প্যারিস ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষাকালে নাজিপ ফজল ছিলেন ফরাসি দার্শনিক হেনরি বার্গসনের উত্তরসূরি। আজকের তুরস্ক যাকে নিজ দেশের মুসলিম রিফর্মার মনে করে, তিনি ছিলেন পশ্চিমা বিশ্ব চষে বেড়ানো ভাবুক। ডান-বাম তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং এজমালি জায়গা চিহ্নিত করাই মূল বিষয়। মূল শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করতেই প্রয়োজন রিফর্মের। যেখানে দেখা যায়, ডান-বাম সবাই পছন্দ করেন নাজিপ ফজলকে। অবশ্য রিফর্মের আগ অবধি তিনিও বহু বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হয়েছেন। তবে আজ এই নতুন তুরস্কে, যেখানে সব দল-মত নির্বিশেষে দেশটি রিফর্ম করেছে নতুন রূপে, সেখানে নাজিপ ফজলীয় রিফর্ম-ধারা আজও বহমান।

তুরস্কের যেকোনো শ্রেণি-পেশা কিংবা লোকাল নাগরিকরা একাধারে মার্ক্স পাঠ করেন, আবার সেই একই ব্যক্তি পাঠ করেন ইমামে রব্বানীর ইলমে হাল। ‘যেন পাঠের কোনো সীমানা নেই, সীমানা কেবল মতবাদের।’ মতবাদ একদিকে আর রাষ্ট্র ও জন-আকাঙ্ক্ষা আরেকদিকে। এই সূত্র ধরেই যুগ যুগ ধরে উসমানি সালতানাত টিকে ছিল তুরস্কে। আবারও ভিন্ন মত ও ভিন্ন আদর্শ নিয়ে বেড়ে ওঠার এই চর্চা তৈরি হয়েছে দেশটিতে।

এই চর্চার পথই উন্মুক্ত করেছেন নাজিপ ফজল কিসাকুরেক। আজকের তুরস্কে এমন ব্যক্তি অহরহ। তুরস্কের জাতীয় রিফর্ম আমাদের নতুন বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে ইহুদি হুনুদি নিয়ে ৬০০ বছর সংসার করেছে তুরস্ক, সেখানে একই কেবলার অনুসারীদের নিয়ে আমরা মাত্র ৫০টি বছর যাপন করতেই হিমশিম খাচ্ছি। আমাদের জন্য নাজিপ ফজল তার কবিতায় গান মুক্তির গান, তারই একটি কবিতা থেকে—

দরজা খোলো

খবর আছে,

ওপারেরও ওপার থেকে...

ঠোঁটে ঠোঁটে বাজে একই গান

যেন মুক্তির সুর থেকে এই তালবাহান

আমরা এসেছি—

যে জানে, জানুক

নয়া ভাবুকরা

আসতে থাকুক...

এই সুর

প্রাণ থেকে প্রাণে ছড়িয়ে পড়ুক

মানুষেরা জড়ো হোক,

চিরন্তন সেই ত্রাসের হাত থেকে

নতুন প্রজন্মের রিফর্মের দিকে...

(মুক্তির সুর/নাজিপ ফজল, ভাবানুবাদ : সুনান খান)

নাজিপ ফজল বা তার সমব্যক্তিরা তুরস্কের ইতিহাসকে নতুন করে লিখেছেন, যেখানে তারা ধর্মীয় জ্ঞান-তাত্ত্বিক এমনকি সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনব্যবস্থার ভেতর থেকে হিংসাত্মক অবস্থান মুছে ফেলেছেন। কোনো দল-মত কিংবা আদর্শের হিংসাকেই তারা জায়গা দেননি নতুন রিফর্মের ভেতর। মূল শত্রুকে চিহ্নিত করেছেন, খুবই সূক্ষ্মভাবে।

নাজিপ ফজলের পর আরো বহু ভাবুক ও চিন্তক এসেছেন একই সিলসিলা ধরে, যাদের অধিকাংশই নিজ নিজ সাহিত্যকর্ম ও নয়া ফিলোসফিকাল রিফর্মের মধ্য দিয়ে তাদের জীবদ্দশাতেই তুরস্কের পাঠ্যপুস্তকে জায়গা করে নিয়েছেন। এমন একজন তুর্কি সাহিত্যিক ও দার্শনিক সেজয়ী কারাকোচ। ঐতিহ্য প্রকাশিত ‘এক গুচ্ছ তুর্কি কবিতা’ বইতে তার পরিচিতি ও বেশ কিছু কবিতা স্থান পেয়েছে। নাজিপ ফজলের মতো তিনিও জীবদ্দশাতেই জায়গা করে নিয়েছিলেন তুরস্কের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাঠ্যবইতে।

নাজিপ ফজল কিসাকুরেক কবি হলেও তুরস্কে তার পরিচিতি ভাবুক ও দার্শনিক হিসেবেই। ফলত তুর্কিরা তাকে ‘ওস্তাদ’ নাজিপ ফজল বলেই সম্বোধন করে থাকে। কেননা সাংস্কৃতিক অঙ্গন ছাড়াও অ্যাকাডেমিকলি রাষ্ট্র ও সমাজের প্রায় সব বিভাগেই তার পদচারণ রয়েছে। আধুনিক তুর্কি সমাজে ধর্মতাত্ত্বিক বিশ্লেষণেও তার রয়েছে অবর্ণনীয় পদচারণ।

আধুনিক তুর্কি সমাজের ডান-বাম সেক্যুলার কিংবা মুসলিম মতবাদহীন সর্বাধিক জনপ্রিয় ওস্তাদ নাজিপ ফজলের সিরাত গ্রন্থ ‘মরুভূমিতে এলেন মোহাম্মদ’ বইটি। সিরাতের গতানুগতিক ধারার বাইরে এসে মক্কা বিজয় ও মদিনার সমাজতান্ত্রিক বিশ্লেষণে রোমান হরফের তুর্কি ভাষায় এটিই প্রথম আধুনিক সিরাত গ্রন্থ।

আর্ট কালচার ও সাহিত্যের বিচারে বইটি সর্বাধিক জনপ্রিয়, যা পরবর্তী সময়ে তুরস্কের ধর্ম মন্ত্রণালয় (দিয়ানত দীন ইসলামিক ফাউন্ডেশন) কর্তৃক সংরক্ষিত করা হয়। এসবের পেছনে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত টুল হচ্ছে মানতেক শাস্ত্র। ওস্তাদ নাজিপ ফজল ও তার সিলসিলার আধুনিক রিফর্মার ভাবুকরা মানতেক শাস্ত্রকে সর্বাধিক প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। তাদের চিন্তায় ইসলামের ট্র্যাডিশনকে ইনক্লুড করে আধুনিক ধারার সঙ্গে সমন্বয় স্পষ্ট। ইবনে আরাবি থেকে শুরু করে ইমামে রব্বানি সিরহিন্দি, এমনকি আমাদের ভারত উপমহাদেশের প্রখ্যাত চিন্তক ও হাদিস বিশারদ শাহ অলিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী অবধি তার লেখায় উঠে আসে।

যেকোনো নতুন চিন্তার মাঝেও যে সিলসিলাগত ইসলামি চিন্তার ট্র্যাডিশন ধরে রাখা যায়, তারই বাস্তবতা তুলে আনেন ওস্তাদ নাজিপ ফজল। ফলে যেকোনো শ্রেণি মতবাদ কিংবা ভিন্ন চিন্তার মানুষও তার পছন্দের সিলসিলা খুঁজে পান নাজিপ ফজলের লেখায়।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত