ড. আব্দুর রহিম
ভাষার যে স্তরটিকে বাংলা ভাষা বলা হয়, তার উদ্ভব হয়েছিল সপ্তম শতক থেকে দশম শতকের মধ্যে। স্যার জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ারসন ভারতীয় আর্য ভাষাগুলোর সম্বন্ধ নির্দেশ করতে গিয়ে বাংলাকে নব্য ভারতীয় আর্য ভাষার প্রাচ্য শাখাভুক্ত করেছিলেন। প্রাচ্য শাখার অন্য ভাষাগুলো আসামি, উড়িয়া ও বিহারি (মৈথিলি, মাগধি, ভোজপুরি)। সে হিসেবে বাংলা, আসামি, উড়িয়া ও বিহারি ভাষা সহোদরস্থানীয়। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতামতও প্রায় এরকম। তিনি প্রাচ্য শাখার অন্তর্গত ভাষাকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করেছেন – বিহারি ও ওড্র-বঙ্গ-কামরূপী। ওড্র-বঙ্গ-কামরূপী থেকে উড়িয়া ও বঙ্গ-কামরূপী এবং বঙ্গ-কামরূপী থেকে বাংলা ও আসামি। ফলে বাংলা ও আসামির সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ এবং উড়িয়া ও বিহারির সঙ্গেও বাংলার সম্পর্ক নিরূপিত।
বাংলা সাহিত্যের আদি লিখিত নিদর্শন চর্যাপদ। চর্যাপদের ভাষা বিশ্লেষণ করে যারা এর দাবিদার তারা হিন্দি, বাংলা, উড়িয়া, বিহারি ও অসমিয়া ভাষাভাষী। ড. সুনীতিকুমার তার ‘The Origin and Development of the Bengali Language’ গ্রন্থে চর্যার ভাষাকে বাংলা বলে আখ্যায়িত করেছেন। তবে তাতে শৌরসেনী অপভ্রংশের প্রভাব রয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ চর্যার ভাষাকে আখ্যায়িত করেছেন ‘বঙ্গ-কামরূপী’ ভাষা হিসেবে। উড়িয়া ও মৈথিলির দাবিকেও অগ্রাহ্য করেননি। বিহারের বিখ্যাত পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন বাংলার পাশাপাশি হিন্দি বা মৈথিলির কথাও উল্লেখ করেছেন। অসমিয়া পণ্ডিত বাণীকান্ত কাকতী চর্যার ভাষাকে বলেছেন অসমিয়া বা আসামি। মিথিলার পণ্ডিত ড. জয়কান্ত মিশ্র দাবি করেছেন মিথিলার ভাষা বলে । ড. মায়াধর মানসিংহ অধিকাংশ চর্যাকারকে উড়িয়ার কবি বলেছেন। ড. হরেকৃষ্ণ মাহতাব উড়িয়া বলে দাবি করেছেন।
মূলত বাংলা, বিহারি, উড়িয়া ও আসামি- এই চারটি ভাষা যে সহোদরস্থানীয়, তা চর্যাপদের ভাষা বিশ্লেষণ করলে অনুমিত হয়। চর্যার রচনাকালে এই চারটি ভাষা পরস্পর ঘনিষ্ঠ ছিল, ছিল একই প্রাকৃত ভাষার আঞ্চলিক রূপভেদ কিংবা উপভাষা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘ভাষাবিচ্ছেদ’ প্রবন্ধে বলেছেন, “বাংলাভাষার সহিত আসামি ও উড়িষ্যার যে-প্রভেদ, সে-প্রভেদসূত্রে পরস্পর ভিন্ন হইবার কোনো কারণ দেখা যায় না। উক্ত দুই ভাষা চট্টগ্রামের ভাষা অপেক্ষা বাংলা হইতে স্বতন্ত্র নহে। বীরভূমের কথিত ভাষার সহিত ঢাকার কথিত ভাষার যে-প্রভেদ, বাংলার সহিত আসামির প্রভেদ তাহা অপেক্ষা খুব বেশি নহে।”
কিন্তু ব্রিটিশের ভেদনীতি, divide & rule, ভারতবর্ষের ভাষাগুলোকে পৃথক করেছে। অথচ স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড ও ওয়েলসের স্থানীয় ভাষা ইংরেজি মান ভাষা থেকে একেবারে স্বতন্ত্র হওয়া সত্ত্বেও মান ইংরেজি ভাষার একচ্ছত্র আধিপত্য ব্রিটিশ দ্বীপে বলবৎ হয়েছে। ভাষার ঐক্যে ব্রিটিশরা উন্নতি লাভ করলেও বাংলা-বিহার-উড়িয়া-আসাম তা করতে পারেনি।
ড. আহমদ শরীফ বলেছেন, “ভাষাবিদ বিদ্বানেরাও বলেছেন, তেরো শতক অবধি বাংলা-উড়িয়া-আসামিতে কোনো ভেদ ছিল না এবং ষোলো শতক অবধি বাংলা-আসামি অভিন্ন ছিল। কাজেই বারো-তেরো শতকে যদি বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা-আসাম কোনো একচ্ছত্র শাসনে থাকত এবং এখানকার যেকোনো অঞ্চলের ভাষা যদি প্রশাসনিক তথা দরবারি লেখ্য ভাষারূপে (শৌরসেনীর বদলে) ব্যবহৃত হতো, তাহলে আজ ওই বিরাট দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে একভাষী একটি জাতিসত্তা (Nationality) গড়ে উঠত। তাতে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও আর্থিক ক্ষেত্রে অভিন্ন স্বার্থবশে একটি বলিষ্ঠ ও স্বয়ম্ভর রাষ্ট্রিক জাতি গড়ে উঠতে পারত।... আজও লেখ্য বাংলা-উড়িয়া-আসামিতে প্রভেদ সামান্য। আজও এই তিন ভাষা ও সাহিত্যকে অভিন্ন করে দেখা সম্ভব।”
ড. আহমদ শরীফের এ কথার গুরুত্ব যতদিন আমরা অনুধাবন করতে না পারব ততদিন বিভাজনের রাজনীতি আমাদের পঙ্গু ও বলহীন করে তুলবে। ভাষার বিভেদ যেভাবে আমাদের বলহীন করে তোলে, তেমনি ভাষার একতা আমাদের শক্তিশালী করে তোলে। একটি শক্তিশালী ও সম্প্রসারণশীল রাষ্ট্র গঠন করতে হলে ভাষিক একতা জরুরি।
মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী বলেছিলেন, “আসাম আমার, পশ্চিমবঙ্গ আমার, ত্রিপুরাও আমার। এগুলো ভারতের কবল থেকে ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মানচিত্র পূর্ণতা পাবে না।” এসব অঞ্চলের মানুষ যতদিন নিজেদের স্বার্থ, সমৃদ্ধি এবং ভাষিক একতা-সংহতি উপলব্ধি করতে না পারবে, ততদিন ভাসানীর এই বক্তব্য বোধগম্য হবে না। পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, বিহার, উড়িষ্যা ও ত্রিপুরা ভারতের সীমানায়। কিন্তু ভাষা তো সীমানা মানে না। রাষ্ট্র চাইলেই মানুষের মুখের ভাষা পরিবর্তন করতে পারে না।
ভারতে হিন্দি ও ইংরেজির চাপে বাংলা ভাষা অবরুদ্ধ, তার গতি সংকুচিত, ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন। দেশভাগের পর বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চার ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকেই শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা ভাষার পথ রুদ্ধ হবে কি না, তাও ভেবেছিলেন কেউ কেউ। জীবনানন্দ দাশ ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ভবিষ্যৎ’ প্রবন্ধে বলেছিলেন, “পূর্ব পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা নিয়ে কিছুকাল থেকে আলোড়ন চলছে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সমস্ত লোকই বরাবর বাংলা ভাষা ব্যবহার করে আসছে। শিক্ষিতেরা ইংরেজি জানেন। কিন্তু ইংরেজি যত মহৎই হোক, বিদেশি ভাষা। রাষ্ট্রের ভাষা দেশি হওয়া দরকার। বাংলা পূর্ব পাকিস্তানের দেশজ ভাষা; এ ভাষার যে স্বরূপ মুখে ও সাহিত্যে পূর্ব বাংলা এতদিন বসে গড়ে তুলেছে, তা বিশেষভাবে সেখানকার মুসলিমদের মুখে ও মননে গড়া জিনিস।”
ভাষা আন্দোলন থেকে যে স্বাধীকার চেতনা পূর্ব বাংলার মানুষের ভেতর জাগ্রত হয়েছিল, তা থেকে এসেছে স্বাধীনতা। ১৯৭২ সালে বাংলা বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা হলেও সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রয়োগ এখনো সম্ভব হয়নি। সহিত্যচর্চায় বাংলা ভাষার ব্যাপক ব্যবহার হলেও শিক্ষাক্ষেত্রে এবং প্রশাসনে বাংলা ভাষা চর্চার পরিস্থিতি নাজুক। স্বাধীনতার এত বছর পরও শিক্ষার সব ক্ষেত্রে বাংলা প্রয়োগ করা যায়নি। অফিস-আদালতে এখনো ইংরেজি ভাষার গুরুত্ব অধিক। তারপরও বাংলা ভাষাচর্চার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পশ্চিম বাংলার চেয়ে বহু গুণ এগিয়ে।
বাংলা বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা। এ ভাষার কেন্দ্রস্থল এখন ঢাকা। পশ্চিম বাংলায় বাংলা ভাষা চর্চা বিপর্যস্ত। ভারতের রাষ্ট্রভাষা হিন্দি এবং সেখানে বাংলা একটি আঞ্চলিক ভাষা। পশ্চিম বাংলায় বাংলা ভাষা চর্চার পরিস্থিতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে ‘বিনা স্বদেশী ভাষা, মিটে কি আশা’ প্রবন্ধে অমিতাভ চৌধুরি বলেছেন, “আমি অনেককে বলে থাকি, আর আর পঞ্চাশ বছরের মধ্যে এই ভারতে ‘বাংলা’ বলে চলতি কোনো ভাষা থাকবে না, হিন্দি ও ইংরেজি হবে আমাদের মুখের ভাষা, লেখার ভাষা। বাংলা থাকবে ওপারে-বাংলাদেশে। একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেলেও আমার কথাটা একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো নয়। ইদানীং যেভাবে ইংরেজির চল দেখছি, তাতে এই আশঙ্কা অস্বাভাবিক নয়। তার জন্যে দায়ী মা-বাবারা এবং একালের শিক্ষা-ব্যবস্থা। ‘আমার মেয়েটা কী সুন্দর ইংরেজি বলে,’ কিংবা ‘ছেলে ভালো বাংলা পারে না, এবারে ওদের একজন মাস্টার রেখে শেখাতে হবে’- এ ধরনের সংলাপ বহু বাঙালি বাড়িতে শুনতে পাবেন ইদানীং।”
জনসংখ্যার বিচারে বর্তমান বিশ্বে বাংলা ভাষা পঞ্চম স্থানে আছে। মুসলিম বিশ্বের ভাষা হিসেবে দ্বিতীয় বৃহত্তর; আরবির পরেই বাংলার অবস্থান। প্রায় ৩০ কোটি লোকের মাতৃভাষা এবং চার কোটি মানুষের দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে বাংলা পৃথিবীতে স্বগৌরবে বিরাজমান। বাংলাদেশ, ভারত (প্রধানত পশ্চিম বঙ্গ, ত্রিপুরা, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ, উড়িষ্যা, মেঘালয়, ঝাড়খণ্ড, দক্ষিণ আসাম, বরাক উপত্যকা, ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা) এবং নেপালে (মেচী অঞ্চল) বাংলাভাষী লোকের বসবাস। এ ছাড়া পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রবাসী বাঙালিরা ছড়িয়ে আছে। এত বিপুল জনগোষ্ঠীর ভাষাকে চাইলেই কেউ অবদমিত করে রাখতে পারে না। তাই বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে ঢাকার ওপর। ঢাকাই এখন বাংলা ভাষার রাজধানী।
ভাষার যে স্তরটিকে বাংলা ভাষা বলা হয়, তার উদ্ভব হয়েছিল সপ্তম শতক থেকে দশম শতকের মধ্যে। স্যার জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ারসন ভারতীয় আর্য ভাষাগুলোর সম্বন্ধ নির্দেশ করতে গিয়ে বাংলাকে নব্য ভারতীয় আর্য ভাষার প্রাচ্য শাখাভুক্ত করেছিলেন। প্রাচ্য শাখার অন্য ভাষাগুলো আসামি, উড়িয়া ও বিহারি (মৈথিলি, মাগধি, ভোজপুরি)। সে হিসেবে বাংলা, আসামি, উড়িয়া ও বিহারি ভাষা সহোদরস্থানীয়। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতামতও প্রায় এরকম। তিনি প্রাচ্য শাখার অন্তর্গত ভাষাকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করেছেন – বিহারি ও ওড্র-বঙ্গ-কামরূপী। ওড্র-বঙ্গ-কামরূপী থেকে উড়িয়া ও বঙ্গ-কামরূপী এবং বঙ্গ-কামরূপী থেকে বাংলা ও আসামি। ফলে বাংলা ও আসামির সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ এবং উড়িয়া ও বিহারির সঙ্গেও বাংলার সম্পর্ক নিরূপিত।
বাংলা সাহিত্যের আদি লিখিত নিদর্শন চর্যাপদ। চর্যাপদের ভাষা বিশ্লেষণ করে যারা এর দাবিদার তারা হিন্দি, বাংলা, উড়িয়া, বিহারি ও অসমিয়া ভাষাভাষী। ড. সুনীতিকুমার তার ‘The Origin and Development of the Bengali Language’ গ্রন্থে চর্যার ভাষাকে বাংলা বলে আখ্যায়িত করেছেন। তবে তাতে শৌরসেনী অপভ্রংশের প্রভাব রয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ চর্যার ভাষাকে আখ্যায়িত করেছেন ‘বঙ্গ-কামরূপী’ ভাষা হিসেবে। উড়িয়া ও মৈথিলির দাবিকেও অগ্রাহ্য করেননি। বিহারের বিখ্যাত পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন বাংলার পাশাপাশি হিন্দি বা মৈথিলির কথাও উল্লেখ করেছেন। অসমিয়া পণ্ডিত বাণীকান্ত কাকতী চর্যার ভাষাকে বলেছেন অসমিয়া বা আসামি। মিথিলার পণ্ডিত ড. জয়কান্ত মিশ্র দাবি করেছেন মিথিলার ভাষা বলে । ড. মায়াধর মানসিংহ অধিকাংশ চর্যাকারকে উড়িয়ার কবি বলেছেন। ড. হরেকৃষ্ণ মাহতাব উড়িয়া বলে দাবি করেছেন।
মূলত বাংলা, বিহারি, উড়িয়া ও আসামি- এই চারটি ভাষা যে সহোদরস্থানীয়, তা চর্যাপদের ভাষা বিশ্লেষণ করলে অনুমিত হয়। চর্যার রচনাকালে এই চারটি ভাষা পরস্পর ঘনিষ্ঠ ছিল, ছিল একই প্রাকৃত ভাষার আঞ্চলিক রূপভেদ কিংবা উপভাষা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘ভাষাবিচ্ছেদ’ প্রবন্ধে বলেছেন, “বাংলাভাষার সহিত আসামি ও উড়িষ্যার যে-প্রভেদ, সে-প্রভেদসূত্রে পরস্পর ভিন্ন হইবার কোনো কারণ দেখা যায় না। উক্ত দুই ভাষা চট্টগ্রামের ভাষা অপেক্ষা বাংলা হইতে স্বতন্ত্র নহে। বীরভূমের কথিত ভাষার সহিত ঢাকার কথিত ভাষার যে-প্রভেদ, বাংলার সহিত আসামির প্রভেদ তাহা অপেক্ষা খুব বেশি নহে।”
কিন্তু ব্রিটিশের ভেদনীতি, divide & rule, ভারতবর্ষের ভাষাগুলোকে পৃথক করেছে। অথচ স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড ও ওয়েলসের স্থানীয় ভাষা ইংরেজি মান ভাষা থেকে একেবারে স্বতন্ত্র হওয়া সত্ত্বেও মান ইংরেজি ভাষার একচ্ছত্র আধিপত্য ব্রিটিশ দ্বীপে বলবৎ হয়েছে। ভাষার ঐক্যে ব্রিটিশরা উন্নতি লাভ করলেও বাংলা-বিহার-উড়িয়া-আসাম তা করতে পারেনি।
ড. আহমদ শরীফ বলেছেন, “ভাষাবিদ বিদ্বানেরাও বলেছেন, তেরো শতক অবধি বাংলা-উড়িয়া-আসামিতে কোনো ভেদ ছিল না এবং ষোলো শতক অবধি বাংলা-আসামি অভিন্ন ছিল। কাজেই বারো-তেরো শতকে যদি বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা-আসাম কোনো একচ্ছত্র শাসনে থাকত এবং এখানকার যেকোনো অঞ্চলের ভাষা যদি প্রশাসনিক তথা দরবারি লেখ্য ভাষারূপে (শৌরসেনীর বদলে) ব্যবহৃত হতো, তাহলে আজ ওই বিরাট দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে একভাষী একটি জাতিসত্তা (Nationality) গড়ে উঠত। তাতে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও আর্থিক ক্ষেত্রে অভিন্ন স্বার্থবশে একটি বলিষ্ঠ ও স্বয়ম্ভর রাষ্ট্রিক জাতি গড়ে উঠতে পারত।... আজও লেখ্য বাংলা-উড়িয়া-আসামিতে প্রভেদ সামান্য। আজও এই তিন ভাষা ও সাহিত্যকে অভিন্ন করে দেখা সম্ভব।”
ড. আহমদ শরীফের এ কথার গুরুত্ব যতদিন আমরা অনুধাবন করতে না পারব ততদিন বিভাজনের রাজনীতি আমাদের পঙ্গু ও বলহীন করে তুলবে। ভাষার বিভেদ যেভাবে আমাদের বলহীন করে তোলে, তেমনি ভাষার একতা আমাদের শক্তিশালী করে তোলে। একটি শক্তিশালী ও সম্প্রসারণশীল রাষ্ট্র গঠন করতে হলে ভাষিক একতা জরুরি।
মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী বলেছিলেন, “আসাম আমার, পশ্চিমবঙ্গ আমার, ত্রিপুরাও আমার। এগুলো ভারতের কবল থেকে ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মানচিত্র পূর্ণতা পাবে না।” এসব অঞ্চলের মানুষ যতদিন নিজেদের স্বার্থ, সমৃদ্ধি এবং ভাষিক একতা-সংহতি উপলব্ধি করতে না পারবে, ততদিন ভাসানীর এই বক্তব্য বোধগম্য হবে না। পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, বিহার, উড়িষ্যা ও ত্রিপুরা ভারতের সীমানায়। কিন্তু ভাষা তো সীমানা মানে না। রাষ্ট্র চাইলেই মানুষের মুখের ভাষা পরিবর্তন করতে পারে না।
ভারতে হিন্দি ও ইংরেজির চাপে বাংলা ভাষা অবরুদ্ধ, তার গতি সংকুচিত, ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন। দেশভাগের পর বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চার ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকেই শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা ভাষার পথ রুদ্ধ হবে কি না, তাও ভেবেছিলেন কেউ কেউ। জীবনানন্দ দাশ ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ভবিষ্যৎ’ প্রবন্ধে বলেছিলেন, “পূর্ব পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা নিয়ে কিছুকাল থেকে আলোড়ন চলছে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সমস্ত লোকই বরাবর বাংলা ভাষা ব্যবহার করে আসছে। শিক্ষিতেরা ইংরেজি জানেন। কিন্তু ইংরেজি যত মহৎই হোক, বিদেশি ভাষা। রাষ্ট্রের ভাষা দেশি হওয়া দরকার। বাংলা পূর্ব পাকিস্তানের দেশজ ভাষা; এ ভাষার যে স্বরূপ মুখে ও সাহিত্যে পূর্ব বাংলা এতদিন বসে গড়ে তুলেছে, তা বিশেষভাবে সেখানকার মুসলিমদের মুখে ও মননে গড়া জিনিস।”
ভাষা আন্দোলন থেকে যে স্বাধীকার চেতনা পূর্ব বাংলার মানুষের ভেতর জাগ্রত হয়েছিল, তা থেকে এসেছে স্বাধীনতা। ১৯৭২ সালে বাংলা বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা হলেও সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রয়োগ এখনো সম্ভব হয়নি। সহিত্যচর্চায় বাংলা ভাষার ব্যাপক ব্যবহার হলেও শিক্ষাক্ষেত্রে এবং প্রশাসনে বাংলা ভাষা চর্চার পরিস্থিতি নাজুক। স্বাধীনতার এত বছর পরও শিক্ষার সব ক্ষেত্রে বাংলা প্রয়োগ করা যায়নি। অফিস-আদালতে এখনো ইংরেজি ভাষার গুরুত্ব অধিক। তারপরও বাংলা ভাষাচর্চার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পশ্চিম বাংলার চেয়ে বহু গুণ এগিয়ে।
বাংলা বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা। এ ভাষার কেন্দ্রস্থল এখন ঢাকা। পশ্চিম বাংলায় বাংলা ভাষা চর্চা বিপর্যস্ত। ভারতের রাষ্ট্রভাষা হিন্দি এবং সেখানে বাংলা একটি আঞ্চলিক ভাষা। পশ্চিম বাংলায় বাংলা ভাষা চর্চার পরিস্থিতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে ‘বিনা স্বদেশী ভাষা, মিটে কি আশা’ প্রবন্ধে অমিতাভ চৌধুরি বলেছেন, “আমি অনেককে বলে থাকি, আর আর পঞ্চাশ বছরের মধ্যে এই ভারতে ‘বাংলা’ বলে চলতি কোনো ভাষা থাকবে না, হিন্দি ও ইংরেজি হবে আমাদের মুখের ভাষা, লেখার ভাষা। বাংলা থাকবে ওপারে-বাংলাদেশে। একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেলেও আমার কথাটা একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো নয়। ইদানীং যেভাবে ইংরেজির চল দেখছি, তাতে এই আশঙ্কা অস্বাভাবিক নয়। তার জন্যে দায়ী মা-বাবারা এবং একালের শিক্ষা-ব্যবস্থা। ‘আমার মেয়েটা কী সুন্দর ইংরেজি বলে,’ কিংবা ‘ছেলে ভালো বাংলা পারে না, এবারে ওদের একজন মাস্টার রেখে শেখাতে হবে’- এ ধরনের সংলাপ বহু বাঙালি বাড়িতে শুনতে পাবেন ইদানীং।”
জনসংখ্যার বিচারে বর্তমান বিশ্বে বাংলা ভাষা পঞ্চম স্থানে আছে। মুসলিম বিশ্বের ভাষা হিসেবে দ্বিতীয় বৃহত্তর; আরবির পরেই বাংলার অবস্থান। প্রায় ৩০ কোটি লোকের মাতৃভাষা এবং চার কোটি মানুষের দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে বাংলা পৃথিবীতে স্বগৌরবে বিরাজমান। বাংলাদেশ, ভারত (প্রধানত পশ্চিম বঙ্গ, ত্রিপুরা, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ, উড়িষ্যা, মেঘালয়, ঝাড়খণ্ড, দক্ষিণ আসাম, বরাক উপত্যকা, ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা) এবং নেপালে (মেচী অঞ্চল) বাংলাভাষী লোকের বসবাস। এ ছাড়া পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রবাসী বাঙালিরা ছড়িয়ে আছে। এত বিপুল জনগোষ্ঠীর ভাষাকে চাইলেই কেউ অবদমিত করে রাখতে পারে না। তাই বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে ঢাকার ওপর। ঢাকাই এখন বাংলা ভাষার রাজধানী।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. রইছ উদ্দীন বলেছেন, ছাত্রদল নেতা ও পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী জোবায়েদ হোসাইন হত্যাকাণ্ডে প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে—কেউ যেন আইনের ফাঁক দিয়ে কেউ বেরিয়ে না যায়।
৫ মিনিট আগেঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী রিয়াদ হাসানের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বোরকা ও পর্দাশীল নারীদের নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করার অভিযোগ উঠেছে। এই মন্তব্যের নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রীসংস্থা।
১ ঘণ্টা আগেসমাবেশে জোবায়েদের সহপাঠী সজল খান বলেন, “পুলিশ এখনো বর্ষার পরিবারের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করেনি। শুধু বর্ষা ও মাহির নয়, এই ঘটনায় বর্ষার পরিবারও জড়িত। গতকাল আদালতে আমাদের সঙ্গে পুলিশের আচরণ ছিল অমানবিক। আমাদের এক বান্ধবী ভিডিও করতে গেলে তার ফোন কেড়ে নেওয়া হয়। আমরা পুলিশের এই আচরণের তীব্র নিন্দা জানাই।”
১ ঘণ্টা আগেসামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ আইনের মামলায় বুয়েটের ২১তম ব্যাচের শিক্ষার্থী শ্রীশান্ত রায়কে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে মামলার তদন্ত কর্মকর্তার উপস্থিতিতে জামিনের বিষয়ে অধিকতর শুনানির জন্য আগামীকাল বৃহস্পতিবার দিন ধার্য করেন বিচার
১ ঘণ্টা আগে