দিন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অমর একুশে বইমেলায় নামছে দর্শনার্থীর ঢল। ছুটির দিনগুলোয় দেখা যায় উপচেপড়া ভিড়। তবে বই কেনার চেয়ে দেখার লোকের সংখ্যা বেশি। কিছু ব্যতিক্রমও রয়েছে। অন্যতম আকর্ষণে পরিণত হয়েছে ইসলামি প্রকাশনার স্টল। মেলায় প্রথমবারের মতো ইসলামি সংস্কৃতির বই পেয়ে উল্লসিত পাঠকরাও। অন্যান্য দোকানে কেনাকাটা তেমন না হলেও ক্রেতা নিয়ে অসন্তুষ্ট নন ইসলামি বইয়ের প্রকাশকরা।
স্টল পাওয়া নিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রকাশকরা বলেন, আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকার গত ১৬ বছর সব জায়গা থেকে ইসলাম মুছে ফেলতে চেয়েছে। বহু আগেই তারা আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম শব্দ বাদ দেয়। আর গত এক যুগের বেশি সময় ধরে তারা রাষ্ট্রের সব জায়গা থেকে ইসলাম ও বাঙালি মুসলিম সংস্কৃতি মুছে ফেলার চেষ্টা করেছে। ব্যতিক্রম ছিল না বইমেলা; হিন্দু, বৌদ্ধÑএমনকি ভারতীয় উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন ইসকন স্টল পেলেও মুসলিম সংস্কৃতির ধারক প্রকাশনীগুলোকে দেওয়া হতো না স্থান। এমনকি ইসলামি বই প্রকাশের কারণে জঙ্গি নাটক সাজিয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হতো প্রকাশনী থেকে। দিনের পর দিন নির্যাতন করা হতো রিমান্ডে নিয়ে আর বন্দি করে রাখা হতো জেলে।
জানা গেছে, ধর্মীয় বই প্রকাশের কারণে যারা নির্যাতিত হয়েছেন, তাদের অন্যমত মাওলানা মুহাম্মাদ ইসহাক খান। মানিকগঞ্জের সিংগাইরে মারকাজুল কোরআন ওয়াল হিকমাহ মাদরাসা থেকে তাকে তুলে নেওয়া হয়, চেষ্টা করা হয় গুম করার। ২০১৮ সালের ১০ জানুয়ারি তাকে তোলা হয় আদালতে। ১৩ দিন রিমান্ড ও ৩৩ মাস জেলে কাটানোর পর তার মুক্তি মেলে। ইসলামি বইয়ের প্রকাশক হওয়া-ই ছিল তার একমাত্র অপরাধ।
মাওলানা ইসহাক আমার দেশকে বলেন, ‘আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের বিদায়ের পর আমরা নিঃশ্বাস নিতে পারছি। আমি মাত্র তিন মাস হলো আবার নতুন করে প্রকাশনার কাজ শুরু করেছি। পরিপূর্ণভাবে এখনো গুছিয়ে উঠতে পারিনি। তাই এবার বইমেলায় স্টল দিতে পারিনি। অন্তর্বর্তী সরকার এবার অনেক ইসলামি প্রকাশনীকে স্টল বরাদ্দ দিয়েছে। এটা খুব ভালো এবং প্রশংসনীয় উদ্যোগ।’
ভবিষ্যতে যারা ইসলামের পক্ষে লিখতে চান, তাদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে এই প্রকাশক বলেন, ‘নতুনদের প্রতি আমার একটাই আহ্বান, আপনারা ন্যায়ের পথে থাকবেন। সত্য কথা পরিপূর্ণভাবে জাতির সামনে তুলে ধরবেন। আংশিক লিখবেন আর আংশিক বাদ দেবেন, এটি যেন কখনো না হয়।’
‘ফাযায়েলে জিহাদ’ বইটি লেখার কারণে লেখক ও প্রকাশক খালেদ সাইফুল্লাহ আড়াইহাজারীকে জঙ্গি আখ্যা দিয়ে অপপ্রচার চালানো হয়। তিন মাস গুম এবং এক বছরেরও বেশি সময় থাকতে হয় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের কনডেম সেলে। তার প্রকাশনী ‘মাকতাবাতুল কুরআন’-এ অভিযান চালিয়ে কাউন্টার টেররিজমের সদস্যরা দিনের আলোতে লুট করে নিয়ে যায় পাঁচ লাখ টাকার বেশি বই।
প্রকাশক সাইফুল্লাহ বলেন, ‘আমি প্রকাশনীর কাজ করি ১৯৯৬ সাল থেকে। বাংলাবাজার ইসলামী টাওয়ারে আনুষ্ঠানিক কাজ শুরু করি ২০০৫ সালে। মেলায় স্টলের জন্য অনেকবার আবেদন করেছি কিন্তু ইসলামি বই ছাপাই বলে স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। জুলাই বিপ্লবে হাসিনা পালিয়ে যাওয়ায় এখন মুক্ত পরিবেশে চলাচল করতে পারছি, এটি বড় পাওয়া মনে হচ্ছে। আবার নতুন করে গত ডিসেম্বর থেকে প্রকাশনার কাজ শুরু করেছি।’
বাংলা একাডেমি এবার একুশে বইমেলায় শতাধিক নতুন প্রকাশনীকে স্টল বরাদ্দ দিয়েছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ইসলামি প্রকাশনী বরাদ্দ পেয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও বাংলা একাডেমি চত্বর উৎসবের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে।
দীর্ঘ আট বছর বাংলা একাডেমির সব শর্ত পূরণ করেও অজানা কারণে স্টল পেত না গার্ডিয়ান পাবলিকেশন। বিপ্লবপরবর্তী বইমেলায় প্রথমবারের মতো স্টল পেয়েছে প্রকাশনীটি। প্রকাশক নুর মোহাম্মাদ আমার দেশকে বলেন, ‘এর আগে কেন গার্ডিয়ান পাবলিকেশনসকে স্টল দেওয়া হয়নি, তার উত্তর বাংলা একাডেমিই দিতে পারবে। আমরা সব শর্ত পূরণ করেছিলাম। কর্তৃপক্ষকে বারবার প্রশ্ন করেও আমরা উত্তর পাইনি।’
তিনি আরো বলেন, গার্ডিয়ান শুধু স্টল বরাদ্দ পায়নি বিষয়টি এমন নয়, প্রকাশনীটি বই প্রকাশের ক্ষেত্রেও বাধার মুখে পড়ে। কায় কাউসের ইতিহাসের ছিন্নপত্র (৩য় খণ্ড) সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেও আমরা প্রকাশ করতে পারিনি। ইতিহাসের নির্মোহ এ পাঠ বিদায়ি স্বৈরশাসকের পক্ষে হজম করা একটু কঠিনই ছিল। নতুন বাংলাদেশে পাঠক ইতিহাসের ছিন্নপত্র পড়বেন ইনশাআল্লাহ। স্টলে পাঠকদের সাড়াও মিলছে বেশ। ’
আগে স্টল না পাওয়া প্রকাশনীর মধ্যে রয়েছে কাতেবিন প্রকাশনও। এর প্রকাশক সাবেত চৌধুরী আমার দেশকে বলেন, “এবার কবি আল মাহমুদের ‘বাঙালি মুসলমানদের শত্রুমিত’ বইটি মুহিম মাহফুজের সম্পাদনায় নতুন করে বাজারে এনেছি। এই বইয়ে আমাদের প্রকৃত শত্রুকে চিহ্নিত করা হয়েছে। কবি আল মাহমুদ বাঙালি মুসলিম সংস্কৃতির ধারক-বাহক ছিলেন, তাই তাকে অনেক কিছু থেকেই বঞ্চিত করা হয়েছে। এ সমাজ থেকে হিন্দুয়ানি সংস্কৃতির আগ্রাসন দূর করতে হবে। প্রতিষ্ঠিত করতে হবে বাঙালি মুসলিম সংস্কৃতি। আমরা সে লড়াই শুরু করেছি।”
শতাধিক বইয়ের লেখক ও অনুবাদক আব্দুল্লাহ আল ফারুক বলেন, বিগত সরকার ইসলামপন্থিদের কোনো কাজ করার সুযোগ দেয়নি। তারা ধর্মীয় স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ণ করেছিল। বর্তমান সরকার মানবাধিকার ও নাগরিক অধিকারের বিষয়ে সচেতন। ডান-বাম ও হিন্দু-মুসলিম সবার প্রতিই তাদের রয়েছে সমান দায়িত্ববোধ।
বইমেলা প্রসঙ্গে লেখক, কলামিস্ট এবং শায়খুল হাদিস মাওলানা যাইনুল আবিদীন বলেন, এবার বইমেলায় ইসলামি প্রকাশনীগুলো অনেক স্টল পেয়েছে। পাঠকরাও অনেক আগ্রহ নিয়ে স্টলগুলোয় ভিড় করছেন। এই ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। বইয়ের মান আরো বাড়াতে হবে।

