মো. রফিকুল ইসলাম খন্দকার
বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য বিশেষ মানস ও পরিবেশ গড়ে তোলার প্রয়োজন হয়। লেখকরাই এ মানস ও পরিবেশ সবচাইতে বেশি ও সবচাইতে সহজে সৃষ্টি করতে পারেন। পাক-ভারত স্বাধীনতা আন্দোলনের যুগে মওলানা আকরম খাঁ এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন।
ব্রিটিশ বাংলায় তার জোরালো লেখনী জনগণের মনে এক বিশেষ রাজনৈতিক চেতনার সৃষ্টি করে। তিনি তীক্ষ্ণ লেখনী দিয়ে জাতিকে মানসিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ না করলে মরহুম এ কে ফজলুল হক, খাজা নাজিমুদ্দীন, নবাব সলিমুল্লাহ, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রমুখ নেতার পক্ষে রাজনৈতিক আন্দোলনে সাফল্য লাভ করা কঠিন হতো। মওলানা আকরম খাঁর লেখা রাজনীতি ও সাহিত্য ক্ষেত্রে ছিল শক্তিশালী ও মহীয়ান।
বাংলা সাহিত্য ও সাংবাদিকতায় মওলানা আকরম খাঁ অবিস্মরণীয় নাম। তিনি ছিলেন তদানীন্তন মুসলিম বাংলার সাংবাদিকতার জনক, সুসাহিত্যিক, বাগ্মী, স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রনায়ক, প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ, মুসলিম চিন্তাবিদ ও সমাজ সংস্কারক।
মওলানা আকরম খাঁ সাহিত্য সৃষ্টির খাতিরে সাহিত্য রচনা করেননি। পশ্চাৎপদ স্বজাতিকে জাগিয়ে তোলা ও তাদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিই ছিল তার সাহিত্য সৃষ্টির উদ্দেশ্য। তার সাহিত্য ছিল গঠনমূলক। তিনি ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি সমর্থন করেননি এবং জড়বাদ নীতির নিন্দা করেছেন। তিনি নিজ প্রতিভা ও সাধনায় বাংলা সাহিত্যে যে স্বাক্ষর রেখে গেছেন, তার মূল্য অসীম।
তার প্রতিভাময় ও জোরদার লেখনীর ফসল ‘মোস্তাফা চরিত’, ‘সমস্যা ও সমাধান’, ‘তফসীরুল কুরআন’, ‘মোসলেম বাংলার সামাজিক ইতিহাস’ এবং ‘বাইবেলের নির্দেশ ও প্রচলিত খ্রিষ্টান ধর্ম’। এ ছাড়া তিনি জেলখানায় বসে ‘আমপারার অনুবাদ’ করেন। এটি তার সর্বপ্রথম সাহিত্যকর্ম। গ্রন্থ রচনা ছাড়াও মওলানা আকরম খাঁ সাপ্তাহিক মোহাম্মদী, মাসিক মোহাম্মদী, দৈনিক জামানা, দৈনিক সেবক ও দৈনিক আজাদ সম্পাদনা করেন। তার এসব পত্রপত্রিকা বাংলার রাজনীতি, সমাজ, সাহিত্য, তমদ্দুন প্রভৃতি ক্ষেত্রে অভিভাবকসুলভ ভূমিকা পালন করেছে। দৈনিক আজাদ বাংলায় আমাদের সাংবাদিকতার ইতিহাসে একটি অমর কীর্তি এবং এটাই বাংলার প্রাচীনতম দৈনিক পত্রিকা। জাতীয় জাগরণ ও আজাদী আন্দোলনকে এগিয়ে নেওয়ার পেছনে এ পত্রিকার অবদান অপরিসীম।
‘মোস্তফা চরিত’ মওলানা আকরম খাঁর সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত ও মৌলিক গ্রন্থ। এটি তার দীর্ঘ ১৪ বছর সাধনার ফসল এবং বাংলায় সর্বপ্রথম বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি, যুক্তিমূলক ও সমালোচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে রচিত। তথ্যপ্রাচুর্যের দিক থেকেও এটি অনেক সমৃদ্ধ। ‘সমস্যা ও সমাধান’ গ্রন্থটি তৎকালীন কিছু সমস্যার সমাধানদানের উদ্দেশ্যে লিখিত। এটাকে মওলানা সাহেবের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ বলে গণ্য করা হয়। সে সময় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ইসলামের যেসব অনুশাসন সম্পর্কে মুসলিম সমাজে বিতর্ক ছিল এবং প্রাচীন ও আধুনিক প্রবক্তাদের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছিল, এই গ্রন্থটি তা নিরসনে অনেকটা সফল হয়েছে। এতে বাংলার ধর্মীয় পরিবেশে আধুনিকতা আনয়ন করার চেষ্টা করা হয়।
‘তফসিরুল কুরআন’ পাঁচ খণ্ডে লিখিত মওলানা আকরম খাঁর বৃহদাকার গ্রন্থ। দীর্ঘ ১২ বছরে তিনি এটি রচনা করেন। এতে মওলানা সাহেব বিজ্ঞান ও যুক্তির আলোকে কোরআনের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বাংলা ভাষায় এটাই এ শ্রেণির সর্বপ্রথম গ্রন্থ। তদানীন্তন বাংলার মুসলিম সমাজের বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা সম্পর্কে আলোচনা করে রচিত হয়েছে ‘মোসলেম বাংলার সামাজিক ইতিহাস’। প্রকৃতপক্ষে এটি সমগ্র মুসলিম ভারতেরই সামাজিক ইতিহাস। এক্ষেত্রে তিনি মুসলিম রাজা-বাদশাহকেও ক্ষমা করেননি। বাইবেলের নির্দেশ ও প্রচলিত খ্রিষ্টধর্ম একটি প্রচারধর্মী গ্রন্থ। ভারত বিভাগের পর তদানীন্তন পাকিস্তানে খ্রিষ্টান মিশনারিদের তৎপরতা বেড়ে গেলে তাদের প্ররোচনা থেকে মুসলমানদের রক্ষা করার উদ্দেশ্যে মওলানা আকরম খাঁ এ পুস্তকটি রচনা করেন।
এসব গ্রন্থ ছাড়াও মওলানা মোহাম্মদী ও অন্যান্য পত্র-পত্রিকায় যেসব গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখেছেন, বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়েছেন, তা বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। কিন্তু সেগুলো একত্রে সংকলন করে প্রকাশ করার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এগুলো সংকলিত ও প্রকাশিত হলে বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডার আরো সমৃদ্ধ হতো।
মওলানা আকরম খাঁর বিভিন্ন প্রতিভা সম্বন্ধে আলোচনা করতে গিয়ে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আবুল ফজল বলেন, “প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে পাকিস্তান কায়েম হওয়ার আগ পর্যন্ত যে যুগ গেছে বাঙালি মুসলমানদের ইতিহাসে তা নানা কারণে স্মরণীয়। এটি আমাদের স্বতন্ত্র আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রয়াস এবং জাতীয় মনের বিচিত্র আকুলি-বিকুলির পরিচয় সর্বাপেক্ষা লক্ষগোচর হয় শিক্ষা, রাজনীতি আর সাহিত্যের ক্ষেত্রে। ইতিহাস বহু বিচিত্র ও বিস্ময়কর।... আমার বিশ্বাস, এই ইতিহাস রচনার যোগ্যতম ব্যক্তি মওলানা আকরম খাঁ।
এই ইতিহাস আগাগোড়া তিনি দেখেছেন। এর ভেতর তিনি বিচরণ করেছেন এবং এ যুগের বহু সংগ্রামের তিনি একাধারে সৈনিক ও সেনাপতির ভূমিকা পালন করেছেন। তদুপরি তার যে সাহিত্যিক প্রজ্ঞা যা তার ‘মোস্তফা চরিত’, ‘সমস্যা ও সমাধান’ এবং কোরআনের ভাষ্যে রূপ পেয়েছে, তা তার রচিত ইতিহাসকে সাহিত্যিক মানে উত্তীর্ণ করে তুলবে। তার সঙ্গে রাজনৈতিক ব্যাপারে আমাদের যতই মতবিরোধ থাকুক, তার সাহিত্যিক মনীষা সম্বন্ধে কারো দ্বিমত থাকার কথা নয়। ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক কারণে যদি আজ আমরা তার সাহিত্যিক অবদান ও প্রতিভাকে অস্বীকার করি, তাহলে বুঝতে হবে সাহিত্যের মান ও মূল্য নির্ধারণ, আর তার গুণগ্রাহিতার শক্তি এখনো আমাদের মধ্যে বিকাশ লাভ করেনি। এ এক বড় রকমের দুর্বলতা আর এই মানসিকতা অবক্ষয়েরই লক্ষণ।”
চট্টগ্রামে ১৯১৮ সালে কয়েকটি সাহিত্য ও ধর্মীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সাহিত্য সমিতির সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন মওলানা আকরম খাঁ। এসব সম্মেলনের বর্ণনা দিতে গিয়ে অধ্যাপক আবুল ফজল মন্তব্য করেন, “সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠিত এই সভা-সমিতিগুলোয় সেদিন যে উৎসাহ-উদ্দীপনা ও উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ জীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নবিভোর ব্যাকুল জীবন চাঞ্চল্য দেখেছিলাম, তাতে আমি জাতির প্রথম প্রাণস্পন্দন অনুভব করেছিলাম বললে ভুল হবে না। আকরম খাঁ তখন জীবনের মধ্য গগনে। আচকান-পায়জামা ও সবুজ পাগড়ি—এই ছিল তখন এই ধর্মবীরের পোশাক। এই পোশাকে যৌবনের প্রদীপ্ত কণ্ঠে তিনি সেদিন সাহিত্য সম্মেলনে এক স্মরণীয় অভিভাষণ দিয়েছিলেন।
তার ও অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের অভিভাষণ দুই-ই ভাষা ও ভাবে অনবদ্য ও অনন্যসাধারণ ছিল। এই অভিভাষণ আমি বহুবার পড়েছি। প্রতিবারই তার উচ্চ সাহিত্যিক মান ও সৌন্দর্য আমাকে মুগ্ধ করেছে। সময়ের পরিবর্তন হয়েছে, জীবনের প্রতি স্তরেই ঘটেছে বিবর্তন। দেশ ও দেশের পরিবেশ ওলট-পালট হয়ে গেছে; কিন্তু আশ্চর্য, আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ বা মওলানা আকরম খাঁর সাহিত্যিক মানের এতটুকু পরিবর্তন হয়নি, হয়নি বিন্দুমাত্র অবনমিত। রাজনৈতিক ও সাহিত্যিক ধ্যান-ধারণায় আমি বিপক্ষ শিবিরের লোক, তবুও আকরম খাঁর বিশুদ্ধ ও সুনির্বাচিত শব্দ সমন্বয়ে গঠিত সুসংবদ্ধ ভাষণ ও তার সুগভীর ভাব-পরিবেশ আমাকে মুগ্ধ করেছে। তাই আমি তার রচনার একজন পরম ভক্ত। ক্লাসিক রচনার স্পর্শে আকরম খাঁর ভাষা সুসমৃদ্ধ।”
মওলানা আকরম খাঁর সাহিত্য প্রতিভা সম্বন্ধে বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ আবুল হাশিম বলেন, ‘‘সাহিত্য ক্ষেত্রে মওলানা সাহেবের প্রতিষ্ঠিত ও সম্পাদিত মাসিক মোহাম্মদীর অবদান স্মরণীয়। জনাব নাসিরউদ্দীন সম্পাদিত ‘সওগাত’ এবং মওলানা সাহেবের মাসিক মোহাম্মদীর মাধ্যমে মওলানা সাহেব একদিন আমাদের সাংস্কৃতিক নিজস্বতা ও বৈশিষ্ট্যগুলোকে পরিস্ফুট করে তোলার জন্য লেখনী চালনা করেছেন, অন্যদিকে গড়ে তুলতে চেয়েছেন আত্মচেতনায় বলিষ্ঠ এক মুসলিম সাহিত্যিক গোষ্ঠী।
সেদিন মুসলিম সমাজের লেখকমাত্রই মাসিক মোহাম্মদীর পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছেন, কারণ মোহাম্মদীই ছিল তাদের সাহিত্য প্রতিভা বিকাশের সর্বাপেক্ষা বলিষ্ঠ বাহন। কাজেই পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশের) বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসেও মাসিক মোহাম্মদীর অবদান উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। মওলানা সাহেবের সাহিত্যকীর্তি ‘মোস্তফা চরিত’ ও ‘সমস্যা ও সমাধান’ প্রভৃতি গ্রন্থে যেমন তাকে আমরা ভাষাশিল্পীরূপে পাই, তেমনি পাই একজন মুক্তবুদ্ধির ধর্মীয় চিন্তাবিদরূপে। এ প্রসঙ্গে তার আল-কোরআনের তফসিরের কথাও স্মরণীয়। তার সব ব্যাখ্যাই যে সবাই গ্রহণ করবেন, এমন আশা করা যায় না; কিন্তু কোরআনের ব্যাখ্যা করতে গিয়েও তিনি যে মুক্তবুদ্ধি ও যুক্তি বিচারের পরিচয় দিয়েছেন, তা এক দুর্লভ জিনিস।”
মওলানা আকরম খাঁর রচনাবলি বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও সাময়িকীতে প্রকাশিত তার বহু গবেষণামূলক প্রবন্ধ এখনো বিক্ষিপ্তভাবে রয়েছে। এগুলোকে সংকলন করে প্রকাশ করলে তার সাহিত্য প্রতিভার আরো পরিচয় পাওয়া যেত। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও কর্তৃপক্ষের আশু পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য বিশেষ মানস ও পরিবেশ গড়ে তোলার প্রয়োজন হয়। লেখকরাই এ মানস ও পরিবেশ সবচাইতে বেশি ও সবচাইতে সহজে সৃষ্টি করতে পারেন। পাক-ভারত স্বাধীনতা আন্দোলনের যুগে মওলানা আকরম খাঁ এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন।
ব্রিটিশ বাংলায় তার জোরালো লেখনী জনগণের মনে এক বিশেষ রাজনৈতিক চেতনার সৃষ্টি করে। তিনি তীক্ষ্ণ লেখনী দিয়ে জাতিকে মানসিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ না করলে মরহুম এ কে ফজলুল হক, খাজা নাজিমুদ্দীন, নবাব সলিমুল্লাহ, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রমুখ নেতার পক্ষে রাজনৈতিক আন্দোলনে সাফল্য লাভ করা কঠিন হতো। মওলানা আকরম খাঁর লেখা রাজনীতি ও সাহিত্য ক্ষেত্রে ছিল শক্তিশালী ও মহীয়ান।
বাংলা সাহিত্য ও সাংবাদিকতায় মওলানা আকরম খাঁ অবিস্মরণীয় নাম। তিনি ছিলেন তদানীন্তন মুসলিম বাংলার সাংবাদিকতার জনক, সুসাহিত্যিক, বাগ্মী, স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রনায়ক, প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ, মুসলিম চিন্তাবিদ ও সমাজ সংস্কারক।
মওলানা আকরম খাঁ সাহিত্য সৃষ্টির খাতিরে সাহিত্য রচনা করেননি। পশ্চাৎপদ স্বজাতিকে জাগিয়ে তোলা ও তাদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিই ছিল তার সাহিত্য সৃষ্টির উদ্দেশ্য। তার সাহিত্য ছিল গঠনমূলক। তিনি ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি সমর্থন করেননি এবং জড়বাদ নীতির নিন্দা করেছেন। তিনি নিজ প্রতিভা ও সাধনায় বাংলা সাহিত্যে যে স্বাক্ষর রেখে গেছেন, তার মূল্য অসীম।
তার প্রতিভাময় ও জোরদার লেখনীর ফসল ‘মোস্তাফা চরিত’, ‘সমস্যা ও সমাধান’, ‘তফসীরুল কুরআন’, ‘মোসলেম বাংলার সামাজিক ইতিহাস’ এবং ‘বাইবেলের নির্দেশ ও প্রচলিত খ্রিষ্টান ধর্ম’। এ ছাড়া তিনি জেলখানায় বসে ‘আমপারার অনুবাদ’ করেন। এটি তার সর্বপ্রথম সাহিত্যকর্ম। গ্রন্থ রচনা ছাড়াও মওলানা আকরম খাঁ সাপ্তাহিক মোহাম্মদী, মাসিক মোহাম্মদী, দৈনিক জামানা, দৈনিক সেবক ও দৈনিক আজাদ সম্পাদনা করেন। তার এসব পত্রপত্রিকা বাংলার রাজনীতি, সমাজ, সাহিত্য, তমদ্দুন প্রভৃতি ক্ষেত্রে অভিভাবকসুলভ ভূমিকা পালন করেছে। দৈনিক আজাদ বাংলায় আমাদের সাংবাদিকতার ইতিহাসে একটি অমর কীর্তি এবং এটাই বাংলার প্রাচীনতম দৈনিক পত্রিকা। জাতীয় জাগরণ ও আজাদী আন্দোলনকে এগিয়ে নেওয়ার পেছনে এ পত্রিকার অবদান অপরিসীম।
‘মোস্তফা চরিত’ মওলানা আকরম খাঁর সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত ও মৌলিক গ্রন্থ। এটি তার দীর্ঘ ১৪ বছর সাধনার ফসল এবং বাংলায় সর্বপ্রথম বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি, যুক্তিমূলক ও সমালোচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে রচিত। তথ্যপ্রাচুর্যের দিক থেকেও এটি অনেক সমৃদ্ধ। ‘সমস্যা ও সমাধান’ গ্রন্থটি তৎকালীন কিছু সমস্যার সমাধানদানের উদ্দেশ্যে লিখিত। এটাকে মওলানা সাহেবের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ বলে গণ্য করা হয়। সে সময় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ইসলামের যেসব অনুশাসন সম্পর্কে মুসলিম সমাজে বিতর্ক ছিল এবং প্রাচীন ও আধুনিক প্রবক্তাদের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছিল, এই গ্রন্থটি তা নিরসনে অনেকটা সফল হয়েছে। এতে বাংলার ধর্মীয় পরিবেশে আধুনিকতা আনয়ন করার চেষ্টা করা হয়।
‘তফসিরুল কুরআন’ পাঁচ খণ্ডে লিখিত মওলানা আকরম খাঁর বৃহদাকার গ্রন্থ। দীর্ঘ ১২ বছরে তিনি এটি রচনা করেন। এতে মওলানা সাহেব বিজ্ঞান ও যুক্তির আলোকে কোরআনের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বাংলা ভাষায় এটাই এ শ্রেণির সর্বপ্রথম গ্রন্থ। তদানীন্তন বাংলার মুসলিম সমাজের বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা সম্পর্কে আলোচনা করে রচিত হয়েছে ‘মোসলেম বাংলার সামাজিক ইতিহাস’। প্রকৃতপক্ষে এটি সমগ্র মুসলিম ভারতেরই সামাজিক ইতিহাস। এক্ষেত্রে তিনি মুসলিম রাজা-বাদশাহকেও ক্ষমা করেননি। বাইবেলের নির্দেশ ও প্রচলিত খ্রিষ্টধর্ম একটি প্রচারধর্মী গ্রন্থ। ভারত বিভাগের পর তদানীন্তন পাকিস্তানে খ্রিষ্টান মিশনারিদের তৎপরতা বেড়ে গেলে তাদের প্ররোচনা থেকে মুসলমানদের রক্ষা করার উদ্দেশ্যে মওলানা আকরম খাঁ এ পুস্তকটি রচনা করেন।
এসব গ্রন্থ ছাড়াও মওলানা মোহাম্মদী ও অন্যান্য পত্র-পত্রিকায় যেসব গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখেছেন, বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়েছেন, তা বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। কিন্তু সেগুলো একত্রে সংকলন করে প্রকাশ করার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এগুলো সংকলিত ও প্রকাশিত হলে বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডার আরো সমৃদ্ধ হতো।
মওলানা আকরম খাঁর বিভিন্ন প্রতিভা সম্বন্ধে আলোচনা করতে গিয়ে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আবুল ফজল বলেন, “প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে পাকিস্তান কায়েম হওয়ার আগ পর্যন্ত যে যুগ গেছে বাঙালি মুসলমানদের ইতিহাসে তা নানা কারণে স্মরণীয়। এটি আমাদের স্বতন্ত্র আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রয়াস এবং জাতীয় মনের বিচিত্র আকুলি-বিকুলির পরিচয় সর্বাপেক্ষা লক্ষগোচর হয় শিক্ষা, রাজনীতি আর সাহিত্যের ক্ষেত্রে। ইতিহাস বহু বিচিত্র ও বিস্ময়কর।... আমার বিশ্বাস, এই ইতিহাস রচনার যোগ্যতম ব্যক্তি মওলানা আকরম খাঁ।
এই ইতিহাস আগাগোড়া তিনি দেখেছেন। এর ভেতর তিনি বিচরণ করেছেন এবং এ যুগের বহু সংগ্রামের তিনি একাধারে সৈনিক ও সেনাপতির ভূমিকা পালন করেছেন। তদুপরি তার যে সাহিত্যিক প্রজ্ঞা যা তার ‘মোস্তফা চরিত’, ‘সমস্যা ও সমাধান’ এবং কোরআনের ভাষ্যে রূপ পেয়েছে, তা তার রচিত ইতিহাসকে সাহিত্যিক মানে উত্তীর্ণ করে তুলবে। তার সঙ্গে রাজনৈতিক ব্যাপারে আমাদের যতই মতবিরোধ থাকুক, তার সাহিত্যিক মনীষা সম্বন্ধে কারো দ্বিমত থাকার কথা নয়। ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক কারণে যদি আজ আমরা তার সাহিত্যিক অবদান ও প্রতিভাকে অস্বীকার করি, তাহলে বুঝতে হবে সাহিত্যের মান ও মূল্য নির্ধারণ, আর তার গুণগ্রাহিতার শক্তি এখনো আমাদের মধ্যে বিকাশ লাভ করেনি। এ এক বড় রকমের দুর্বলতা আর এই মানসিকতা অবক্ষয়েরই লক্ষণ।”
চট্টগ্রামে ১৯১৮ সালে কয়েকটি সাহিত্য ও ধর্মীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সাহিত্য সমিতির সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন মওলানা আকরম খাঁ। এসব সম্মেলনের বর্ণনা দিতে গিয়ে অধ্যাপক আবুল ফজল মন্তব্য করেন, “সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠিত এই সভা-সমিতিগুলোয় সেদিন যে উৎসাহ-উদ্দীপনা ও উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ জীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নবিভোর ব্যাকুল জীবন চাঞ্চল্য দেখেছিলাম, তাতে আমি জাতির প্রথম প্রাণস্পন্দন অনুভব করেছিলাম বললে ভুল হবে না। আকরম খাঁ তখন জীবনের মধ্য গগনে। আচকান-পায়জামা ও সবুজ পাগড়ি—এই ছিল তখন এই ধর্মবীরের পোশাক। এই পোশাকে যৌবনের প্রদীপ্ত কণ্ঠে তিনি সেদিন সাহিত্য সম্মেলনে এক স্মরণীয় অভিভাষণ দিয়েছিলেন।
তার ও অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের অভিভাষণ দুই-ই ভাষা ও ভাবে অনবদ্য ও অনন্যসাধারণ ছিল। এই অভিভাষণ আমি বহুবার পড়েছি। প্রতিবারই তার উচ্চ সাহিত্যিক মান ও সৌন্দর্য আমাকে মুগ্ধ করেছে। সময়ের পরিবর্তন হয়েছে, জীবনের প্রতি স্তরেই ঘটেছে বিবর্তন। দেশ ও দেশের পরিবেশ ওলট-পালট হয়ে গেছে; কিন্তু আশ্চর্য, আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ বা মওলানা আকরম খাঁর সাহিত্যিক মানের এতটুকু পরিবর্তন হয়নি, হয়নি বিন্দুমাত্র অবনমিত। রাজনৈতিক ও সাহিত্যিক ধ্যান-ধারণায় আমি বিপক্ষ শিবিরের লোক, তবুও আকরম খাঁর বিশুদ্ধ ও সুনির্বাচিত শব্দ সমন্বয়ে গঠিত সুসংবদ্ধ ভাষণ ও তার সুগভীর ভাব-পরিবেশ আমাকে মুগ্ধ করেছে। তাই আমি তার রচনার একজন পরম ভক্ত। ক্লাসিক রচনার স্পর্শে আকরম খাঁর ভাষা সুসমৃদ্ধ।”
মওলানা আকরম খাঁর সাহিত্য প্রতিভা সম্বন্ধে বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ আবুল হাশিম বলেন, ‘‘সাহিত্য ক্ষেত্রে মওলানা সাহেবের প্রতিষ্ঠিত ও সম্পাদিত মাসিক মোহাম্মদীর অবদান স্মরণীয়। জনাব নাসিরউদ্দীন সম্পাদিত ‘সওগাত’ এবং মওলানা সাহেবের মাসিক মোহাম্মদীর মাধ্যমে মওলানা সাহেব একদিন আমাদের সাংস্কৃতিক নিজস্বতা ও বৈশিষ্ট্যগুলোকে পরিস্ফুট করে তোলার জন্য লেখনী চালনা করেছেন, অন্যদিকে গড়ে তুলতে চেয়েছেন আত্মচেতনায় বলিষ্ঠ এক মুসলিম সাহিত্যিক গোষ্ঠী।
সেদিন মুসলিম সমাজের লেখকমাত্রই মাসিক মোহাম্মদীর পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছেন, কারণ মোহাম্মদীই ছিল তাদের সাহিত্য প্রতিভা বিকাশের সর্বাপেক্ষা বলিষ্ঠ বাহন। কাজেই পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশের) বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসেও মাসিক মোহাম্মদীর অবদান উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। মওলানা সাহেবের সাহিত্যকীর্তি ‘মোস্তফা চরিত’ ও ‘সমস্যা ও সমাধান’ প্রভৃতি গ্রন্থে যেমন তাকে আমরা ভাষাশিল্পীরূপে পাই, তেমনি পাই একজন মুক্তবুদ্ধির ধর্মীয় চিন্তাবিদরূপে। এ প্রসঙ্গে তার আল-কোরআনের তফসিরের কথাও স্মরণীয়। তার সব ব্যাখ্যাই যে সবাই গ্রহণ করবেন, এমন আশা করা যায় না; কিন্তু কোরআনের ব্যাখ্যা করতে গিয়েও তিনি যে মুক্তবুদ্ধি ও যুক্তি বিচারের পরিচয় দিয়েছেন, তা এক দুর্লভ জিনিস।”
মওলানা আকরম খাঁর রচনাবলি বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও সাময়িকীতে প্রকাশিত তার বহু গবেষণামূলক প্রবন্ধ এখনো বিক্ষিপ্তভাবে রয়েছে। এগুলোকে সংকলন করে প্রকাশ করলে তার সাহিত্য প্রতিভার আরো পরিচয় পাওয়া যেত। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও কর্তৃপক্ষের আশু পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. রইছ উদ্দীন বলেছেন, ছাত্রদল নেতা ও পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী জোবায়েদ হোসাইন হত্যাকাণ্ডে প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে—কেউ যেন আইনের ফাঁক দিয়ে কেউ বেরিয়ে না যায়।
২২ মিনিট আগেঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী রিয়াদ হাসানের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বোরকা ও পর্দাশীল নারীদের নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করার অভিযোগ উঠেছে। এই মন্তব্যের নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রীসংস্থা।
১ ঘণ্টা আগেসমাবেশে জোবায়েদের সহপাঠী সজল খান বলেন, “পুলিশ এখনো বর্ষার পরিবারের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করেনি। শুধু বর্ষা ও মাহির নয়, এই ঘটনায় বর্ষার পরিবারও জড়িত। গতকাল আদালতে আমাদের সঙ্গে পুলিশের আচরণ ছিল অমানবিক। আমাদের এক বান্ধবী ভিডিও করতে গেলে তার ফোন কেড়ে নেওয়া হয়। আমরা পুলিশের এই আচরণের তীব্র নিন্দা জানাই।”
১ ঘণ্টা আগেসামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ আইনের মামলায় বুয়েটের ২১তম ব্যাচের শিক্ষার্থী শ্রীশান্ত রায়কে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে মামলার তদন্ত কর্মকর্তার উপস্থিতিতে জামিনের বিষয়ে অধিকতর শুনানির জন্য আগামীকাল বৃহস্পতিবার দিন ধার্য করেন বিচার
২ ঘণ্টা আগে