শারমিনের ‘মায়ের পাঠশালা’

মোহনা জাহ্নবী
প্রকাশ : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৪: ০৩

শারমিন রহমান সুইট, পেশায় একজন শিক্ষক। স্কুলে পড়াতে গিয়ে তিনি অনুভব করেন, বাচ্চাদের সুশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে তাদের মায়েদেরও শিক্ষিত হওয়া জরুরি; অন্তত মায়েরা যেন প্রাথমিক শিক্ষাটা পান। তাই বাড়ি বাড়ি গিয়ে তিনি মায়েদের পড়াতে থাকেন। তার নিরলস প্রচেষ্টায় সবার কাছে তিনি প্রিয় শিক্ষক হয়ে ওঠেন। ২০২২ সাল থেকে প্রতি বছর উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত হয়েছেন তিনি, পেয়েছেন শ্রেষ্ঠ জয়িতা পুরস্কারও। তাকে নিয়ে লিখেছেন মোহনা জাহ্নবী

বিজ্ঞাপন

মানবিক শিক্ষক

শারমিনের মা জেসমিন আক্তার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। মায়ের আদর্শই শিক্ষকতার প্রতি তার ভালোবাসা বাড়িয়েছে। চার ভাইবোনের মধ্যে শারমিন রহমান সবার বড়। ২০০৪ সালে বাবাকে হারিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়ে শারমিনের পুরো পরিবার। এরপর শুরু হয় টিকে থাকার লড়াই। সেই সংগ্রামে থিতু হতে না হতেই অন্য এক ঝড়ের মুখে পড়েন তিনি। বিয়ের কিছুদিন পরেই তাকে আলাদা জীবন বেছে নিতে হয়। কিন্তু তার মনের জোর আর অদম্য ইচ্ছার কাছে সব প্রতিকূলতা হার মানতে বাধ্য হয়। সমালোচনা ও নিন্দা তাকে ভেতর থেকে আরো শক্তিশালী করে।

Mayer-Pathsala-4

২০১৩ সালে ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলার ঘারুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন তিনি। চাকরির শুরু থেকেই শিশুদের নিজের সন্তানের মতো আগলে রাখার চেষ্টা করেন, খুঁজে নেন কাজের মাঝেই সুখ। গ্রামের শিশুদের স্বপ্ন দেখাতে ভালোবাসেন তিনি। শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয়ে আগ্রহী করে তোলেন। কবিতা আবৃত্তি, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, ভাষা ক্লাব, নাচ ও ছবি আঁকায় গ্রামের শিক্ষার্থীরা দক্ষতার পরিচয় দিতে শুরু করে । দরিদ্র শিক্ষার্থীদের মাঝে প্রতিবছর তিনি ইউনিফর্ম, খাতা ও কলম উপহার দেন। শিশুশ্রম বন্ধ করতে বিভিন্ন কাজ থেকে ছাড়িয়ে এনে বেশ কিছু শিক্ষার্থীর পড়ালেখার সব ভার তুলে নেন তিনি। গ্রামের শিক্ষার্থীদের জুম ও গুগল মিটের মাধ্যমে দেশের বাইরের শিক্ষার্থীদের সঙ্গেও যোগাযোগ করান শারমিন রহমান।

তিনি ঘুরে বেড়ান অনুপস্থিত শিক্ষার্থীর বাড়ি বাড়ি। খোঁজ রাখেন সব শিক্ষার্থীর। নিয়মিত হোম ভিজিট, উঠান বৈঠক ও মা সমাবেশ করতে থাকেন। শ্রেণিকক্ষে আনন্দদায়ক পাঠদান তার অনন্য বৈশিষ্ট্য। প্রতিটি শিশুর পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা, পরিবেশ ও সুযোগ-সুবিধা তার জানা। সমাপনী ও বৃত্তি পরীক্ষার সময় চার-পাঁচ মাস আগে থেকেই শিক্ষার্থীদের রাতে নিজের বাড়িতে রেখে পড়ালেখা করান তিনি। কারণ গ্রামের অভিভাবকরা পড়া বলে দিতে পারেন না, পড়াশোনার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে পারেন না। এমনকি পড়ার জন্য নিরিবিলি ও সুন্দর পরিবেশও থাকে না সেখানে। তাই ভালো ফলাফলের কথা ভেবে শিক্ষার্থীদের তিনি নিজের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে দেন।

মায়ের পাঠশালা

তিনি উপলব্ধি করেন, গ্রামের মায়েদের লেখাপড়া না জানা এবং সচেতনতার অভাবে একটি সম্ভাবনাময় শিশু ঝরে যায় মুকুলেই। তাই মায়েদের সচেতন করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন শারমিন। ‘রাস্তার মাস্টার’ নামে খ্যাত বিশ্বসেরা শিক্ষক দীপ নারায়ণ নায়কের দেয়ালে পড়ানোর বিষয়টা তার ভীষণ ভালো লাগে। এই ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে, তাঁর পরামর্শ ও অনুপ্রেরণায় শারমিন গড়ে তোলেন ‘মায়ের পাঠশালা’। এখানে মা ও সন্তান একসঙ্গে পড়ালেখা করে। মায়েরা তো স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পান না। তাই শারমিন মায়েদের কাছেই স্কুলকে পৌঁছে দিয়েছেন। টিনের ঘরের দেয়ালে বানানো হয়েছে বোর্ড। সেখানে চক দিয়ে বর্ণ লেখা এবং নিজের নাম লেখা শিখছেন মায়েরা। সন্তান তার মাকে সহায্য করছে। শুক্রবার ও শনিবার শারমিন ‘মায়ের পাঠশালা’য় সময় দেন। তার এই কাজে তাকে সাহায্য করে ওই বিদ্যালয়ের দুই সাবেক শিক্ষার্থী অন্তরা ও রোহানী।

সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে

তার মাধ্যমে মায়েরা সন্তানের পড়ালেখা, পুষ্টি, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন বিষয়ে সচেতন হচ্ছেন। গ্রামের মায়েদের স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারে সচেতন করে তুলছেন শারমিন। তিনি মায়েদের বিভিন্ন কাজের পুরস্কার হিসেবে স্যানিটারি ন্যাপকিন তুলে দিচ্ছেন। শারমিনের স্বপ্ন—দেশের সব মা একদিন সচেতন হয়ে উঠবেন। তারা তাদের সন্তানের সত্যিকারের ভালোটা বুঝবেন। মেয়েদের বোঝা মনে না করে সম্পদ মনে করবেন।

Mayer-Pathsala-2

অনুশীলন ও প্রতিযোগিতা

মায়ের পাঠশালায় উলের কাজ, কাঁথা সেলাই, পাটের জিনিস তৈরি এবং বিভিন্ন ধরনের পিঠা তৈরির অনুশীলন ও প্রতিযোগিতা চলে। গ্রামের শিশু ও মায়েদের কাছে প্রিয় নাম শারমিন রহমান সুইট।

কাজের স্বীকৃতি

শারমিন রহমান ২০২২, ২০২৩ ও ২০২৪ সালে উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত হয়েছেন, পেয়েছেন শ্রেষ্ঠ জয়িতা পুরস্কার। বিভিন্ন ইনোভেশন আইডিয়ার জন্য পেয়েছেন সেরা উদ্ভাবক পুরস্কার। এটুআই কর্তৃক নির্বাচিত ভাঙ্গা উপজেলার একমাত্র আইসিটি অ্যাম্বাসেডর শারমিন রহমান। তিনি বাংলা ও ইংরেজি বিষয়ের মাস্টার ট্রেইনার।

Mayer-Pathsala-3

লেখক শারমিন

শিক্ষকতার পাশাপাশি আরো একটি পরিচয় রয়েছে শারমিন রহমানের, তিনি একজন লেখক। এ পর্যন্ত তার চারটি বই প্রকাশিত হয়েছে। কয়েদি নম্বর ৩৩২ (গল্পগ্রন্থ), নির্মাতা তারেক মাসুদ (জীবনীগ্রন্থ), প্রিয় সমুদ্র (পত্রকাব্য) এবং ন মানুষ (গল্পগ্রন্থ)।

শেষ কথা

নারীরা আগের তুলনায় অনেক এগিয়ে এসেছে। সব ক্ষেত্রেই নারীরা অবদান রাখছে। কিন্তু গ্রামে সে চিত্র ভিন্ন। অভাব-অসচেতনতা একটি শিশুর সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে বড় বাধা। মায়েদের সচেতন করা এবং লেখাপড়া শেখানোর কোনো বিকল্প নেই। কারণ একটা শিশুর প্রথম শিক্ষক তার মা। ‘মায়ের পাঠশালা’ একদিন পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়বে—এ স্বপ্ন দেখেন ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলায় জন্মগ্রহণ করা মানবিক শিক্ষক শারমিন রহমান।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত