চলে যাওয়া মানে চিরপ্রস্থান নয়

বিউটি হাসু
প্রকাশ : ১০ জুলাই ২০২৫, ১৪: ১৯
আপডেট : ১১ জুলাই ২০২৫, ১০: ২৭

জীবনযুদ্ধে হার না মানা এক নিভৃতচারী যোদ্ধার নাম মাহমুদা বেগম। অপরাজিতা এই নারী আপন দ্যুতিতে উদ্ভাসিত। কর্মজীবনে তিনি মহান পেশা শিক্ষকতা বেছে নিয়েছিলেন। মাহমুদা বেগম ছিলেন মানুষ গড়ার কারিগর। তিনি শুধু নিজের সন্তানকে সুশিক্ষিত করে গড়ে তোলেননি, বহু শিক্ষার্থীর অন্তরে জ্ঞানের আলো ছড়িয়েছেন, বহু শিক্ষার্থীকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করেছেন।

বিজ্ঞাপন

মাহমুদা বেগম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে মাস্টার্স করার পর দাউদকান্দির হাসানপুর শহীদ নজরুল কলেজে শিক্ষকতা পেশায় কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর তিনি চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজ, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ, তিতুমীর কলেজসহ বিভিন্ন কলেজের বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করেন। অধ্যাপিকা মাহমুদা বেগম দৈনিক আমার দেশ পাবলিকেশন্স লিমিটেডের ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন।

দশ মাস গর্ভে ধারণ এবং নিজের সব আরাম-আয়েশ বিসর্জন দিয়ে তাকে সযত্নে লালন করেন মা। সন্তান জন্মদানের তীব্র বেদনা উপলব্ধি করার জন্য মা হওয়ার প্রয়োজন নেই; প্রয়োজন মাতৃত্ববোধ ও অনুভূতিপ্রবণ মন। সন্তান ধারণ এবং সযত্নে লালন-পালনের দায়িত্ব সাধারণত সব মা-ই পালন করে থাকেন। তবে কোনো কোনো মায়ের ত্যাগ, সংগ্রাম ও অবদান তাদের অনন্য আসনে অধিষ্ঠিত করে। সন্তানের জন্য তারা নিজের পুরো জীবনটাই উৎসর্গ করেন। তাদের স্বপ্ন, সাধনা এবং পুরো পৃথিবী শুধু সন্তানকে ঘিরেই। এমন মা সন্তানের স্বার্থে জীবনের সব আনন্দকে বলিদান করেন। এমন মায়েদের গল্প আমরা ক’জন জানতে পারি! আদৌ কি পারি? এমন একজন মা হলেন মাহমুদা বেগম।

মাহমুদা বেগমের অক্লান্ত পরিশ্রম, অদম্য সাধনা ও স্বপ্নের ফসল তার একমাত্র সন্তান আজকের মাহমুদুর রহমান। তার সন্তানকে তিনি কারো ব্যক্তিগত নয়; দেশের সম্পদ হিসেবে গড়ে তুলেছেন। এই মহীয়সী নারী কতটা ত্যাগ আর পরিশ্রম করে সন্তানকে যোগ্য করে গড়ে তুলেছেন, সে কথা কি আমরা কখনো ভেবে দেখেছি! তিনি এমন একজন মা, যিনি সারা জীবন নিজেকে মোমের মতো জ্বালিয়ে আলো বিলিয়ে গেছেন। যেকোনো সমস্যায় ছেলের মাথার ওপর ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছেন, শক্তি ও সাহস জুগিয়েছেন।

‘আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও,

আমি তোমাদের একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দেব।’

এ উক্তিটি নেপোলিয়ন বোনাপার্ট যেন শিক্ষাবিদ অধ্যাপিকা মাহমুদার মতো মায়েদের জন্যই করেছিলেন। মাহমুদা বেগমের স্বনামধন্য সুশিক্ষিত সন্তান আমার দেশ-এর সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, যিনি নিজের জীবনকে বাজি রেখে দেশ ও দেশের মানুষের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।

অন্যায়ের সঙ্গে আপসহীন, সৎ ও সাহসী এই মা সন্তানকেও নিজের আদর্শে গড়ে তুলেছেন। স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রামে আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান যে ভূমিকা রেখে চলেছেন, তার অনুপ্রেরণার উৎস ছিলেন মমতাময়ী মা অধ্যাপিকা মাহমুদা বেগম। জেল ও নির্বাসিত জীবনে তার মা যে সাহস ও দৃঢ়তা দেখিয়েছেন, তা অনন্য এক উদাহরণ।

মায়ের সম্পর্কে মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘২০১০ সালে যখন আমি ডিবি অফিসে রিমান্ডে ছিলাম, তখন আমার মা সারা রাত রাস্তায় বসেছিলেন শুধু এই চিন্তায়—আমাকে টর্চার করা হচ্ছে কি না।’

মায়ের সংগ্রামী জীবনের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘আমার মা এদেশে বহু লড়াই করেছেন। তিনি আমাকে ফ্যাসিবাদের সঙ্গে আপস না করে লড়াই করতে শিখিয়েছেন, সাহস জুগিয়েছেন। আমি পরিবার থেকেই লড়াই করার প্রেরণা পেয়েছি।’

এই নিভৃতচারী মায়েদের গল্প আমাদের অজানা রয়ে যায়, আড়ালেই থেকে যায়। তাদের ত্যাগ, সংগ্রাম ও জীবন-আখ্যান নিয়ে লিখলে হয়তো মহাকাব্য রচনা হতো।

ময়দানের যুদ্ধ সবাই দেখতে পারে। তাই তার ভয়াবহতা ও ক্ষয়ক্ষতি আন্দাজ করা যায়। কিন্তু মানুষের মনের ভেতর, হৃদয়ের গোপন প্রকোষ্ঠে যে যুদ্ধ হয় নিজের সঙ্গে নিজের, তা ময়দানের যুদ্ধের চেয়েও মারাত্মক ও ভয়াবহ। এই যে মর্মভেদী কষ্ট, অন্তরদহন ও নিভৃতে হৃদয়ক্ষরণ! তার খবর কেউ জানে না, কেউ রাখে না। বাইরে থেকে তা উপলব্ধি করাও সম্ভব নয়। নিভৃতচারী এই মহীয়সী জননী মাহমুদা বেগম সারাজীবন অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়েছেন, অপরাজিতা এই যোদ্ধা মা কখনো দমে যাননি।

রাজনৈতিক রোষানলে ‘আমার দেশ’ বন্ধ হওয়ার আগে মাহমুদা বেগম অফিসে দু-একবার এসেছিলেন। দূর থেকে তাকে দেখেছি। তখন তার সম্পর্কে সেভাবে জানা হয়নি। পরে যখন তার দৃঢ় ব্যক্তিত্ব, তীব্র আত্মসম্মানবোধ ও অটল আত্মবিশ্বাস সম্পর্কে কিছুটা জানতে পারি, তখন তার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও জানার আগ্রহ বেড়ে যায়। খুব ইচ্ছা হয় তাকে ছুঁয়ে দেখার, জিজ্ঞেস করার—‘এত মানসিক শক্তি ও সাহস আপনি কোথা থেকে সঞ্চয় করেছেন?’ সব প্রতিবন্ধকতা ও প্রতিকূলতা অগ্রাহ্য করে জীবনের এই দুর্গম ও বন্ধুর পথ একাকী পাড়ি দেওয়ার মনোবল কিভাবে আয়ত্ব করেছেন?’

শিক্ষকতা পেশায় অত্যন্ত নিষ্ঠাবান অধ্যাপিকা মাহমুদা বেগম নিজ মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে তার অসংখ্য ছাত্রছাত্রীকে সুশিক্ষিত করেছেন, যারা এখন সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে দেশের জন্য অবদান রাখছেন। তিনি ধর্মপ্রাণ ও পরোপকারীও ছিলেন। একজন মহীয়সী নারী হিসেবে সবার কাছে ছিলেন অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন।

শিক্ষকতা পেশায় মাহমুদা বেগম অত্যন্ত নিষ্ঠাবান, মেধাবী ও দায়িত্বশীল ছিলেন। তিনি কতটা কর্তব্যপরায়ণ ও স্নেহকাতর মা ছিলেন—সে কথা তার সহকর্মী রয়টার্সের সাবেক ব্যুরোপ্রধান সিরাজুল ইসলাম কাদিরের লেখা পড়ে অনুধাবন করতে পারি।

সিরাজুল ইসলাম কাদির লেখেন–‘মাহমুদা আপার মুখচ্ছবি দেখে মনে হলো তিনি মনের দিক থেকে খুব বিচলিত, উদ্বিগ্ন। এগিয়ে গিয়ে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বললাম—‘আপা কী হয়েছে? মনে হচ্ছে আপনি মানসিকভাবে বিচলিত।’

কোনো ভূমিকা বা রাখঢাক না করেই তিনি বললেন, ‘আমার ছেলে অসুস্থ। ও আমার একমাত্র সন্তান। আমার গোটা পৃথিবী...।’

তিনি আরো লিখেছেন, ‘আপার দুচোখ টলটল করছে। আমার নিজের চোখ আর কণ্ঠ অজান্তে ভিজে গেল; বললাম, ‘তাহলে কলেজে এসেছেন কেন? ছুটি নিতে পারতেন। ছেলের পাশে থাকলে এত খারাপ লাগত না।’ তিনি আমার সঙ্গে একমত হয়ে বললেন, ‘আজ ডিগ্রিতে আমার একটা গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস রয়েছে। ওরাও তো আমার সন্তান।’

বিদুষী এই মায়ের সারাটা হৃদয়ে, পৃথিবী জুড়ে ছিলেন একমাত্র সন্তান মাহমুদুর রহমান। এই সন্তানই ছিলেন তার আশা-ভরসা এবং একমাত্র অবলম্বন।

আমরা একজন গুণী মানুষকে হারিয়েছি; হারিয়েছি একজন মহান শিক্ষক ও সংগ্রামী মা তথা নারীকে। গত রোববার (৬ জুলাই) ভোর সোয়া ৫টায় রাজধানীর মগবাজার ইনসাফ আল বারাকাহ কিডনি হাসপাতালে অধ্যাপিকা মাহমুদা বেগম ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর। তিনি বেশ কিছুদিন ধরে বার্ধক্যজনিত জটিলতায় ভুগছিলেন।

প্রখ্যাত এই শিক্ষাবিদ দীর্ঘ সময় শিক্ষকতার পাশাপাশি তার মহৎ কর্মের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তিনি চোখের আড়াল হলেও কখনো তার সন্তানের মনের আড়াল হবেন না। চলে গেলেও তিনি থাকবেন না থাকা ভুবনজুড়ে। কর্মের মাধ্যমে তিনি আমাদের মনেও আজীবন শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় বেঁচে থাকবেন।

লেখক : ফিচার ইনচার্জ

দৈনিক আমার দেশ

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত