গৃহিণীর শ্রম : ভোর থেকে গভীর রাত

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
প্রকাশ : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৫: ০৪

সমাজে গৃহিণী নারীকে প্রায়ই বলা হয়, ‘তিনি তো ঘরে বসে থাকেন।’ অথচ বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। একজন গৃহিণীর প্রতিটি মুহূর্ত ব্যস্ততা, ত্যাগ ও অদৃশ্য শ্রমে ভরা। ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত তিনি পরিবার, সন্তান, স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি কিংবা আত্মীয়—সবাইকে ভালো রাখার চেষ্টায় ব্যস্ত থাকেন, সবটুকু সময় ব্যয় করেন। অথচ তার কাজের হিসাব নেই কোথাও, নেই কোনো বেতন বা স্বীকৃতি। গৃহিণীর ২৪ ঘণ্টার এই পরিশ্রমকে যদি ভেঙে দেখা যায়, তবে স্পষ্ট বোঝা যাবে, তার প্রতিটি ঘণ্টা কতটা শ্রমঘন ও মূল্যবান।

প্রভাতের আলো ফোটার আগেই একজন গৃহিণীর ব্যস্ততা শুরু হয়। তিনি প্রথমেই ঘর গোছানো, চা বা নাশতা তৈরি, সন্তানদের স্কুলের প্রস্তুতি, স্বামীর অফিসের জন্য কাপড়-চোপড় গুছিয়ে দেওয়া—এসব কাজ হাতে নেন। অনেক সময় সন্তানদের পড়াশোনায় সাহায্য করা বা তাদের মানসিকভাবে প্রস্তুত করার জন্যও তাকে সময় দিতে হয়। ভোরবেলা অন্যরা যখন ঘুম থেকে ওঠার চেষ্টা করছে, তিনি তখন দিনের প্রথম যুদ্ধ শুরু করেন রান্নাঘর আর সংসারের নানা খুঁটিনাটিতে।

বিজ্ঞাপন

গৃহস্থালির ভার

সকাল ৯টা থেকে দুপুর পর্যন্ত গৃহিণীর কাজ সবচেয়ে বেশি চাপের হয়। সকালের খাবারের পর থালা-বাসন ধোয়া, কাপড় কাচা, ঘরদোর পরিষ্কার করা, বয়স্কদের ওষুধ খাওয়ানো, সন্তানদের আবার পড়াশোনায় বসানো—সবই তাকে একসঙ্গে সামলাতে হয়।

এ সময় গৃহিণীকে শুধুই গৃহস্থালি নয়, প্রায়ই আর্থিক পরিকল্পনার কাজও করতে হয়। কত খরচ হবে, কোন জিনিস কেনা প্রয়োজন, মাসিক বাজেট কেমন হবে—এসব হিসাবের দায়িত্বও তার কাঁধে থাকে। অর্থাৎ তিনি একজন ‘ম্যানেজার’-এর মতো সংসারের সব দিক নিয়ন্ত্রণ করেন।

দুপুরে ক্লান্তির মাঝেই যত্ন

দুপুরের খাবার তৈরি গৃহিণীর আরেকটি বড় দায়িত্ব। পরিবারের সবার জন্য স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিকর খাবার প্রস্তুত করতে হয়। অনেক সময় অতিথি এলে বা বাড়িতে হঠাৎ কাউকে আপ্যায়ন করতে হলে বাড়তি শ্রম দিতে হয়।

খাওয়াদাওয়ার পর আবার থালাবাসন ধোয়া, রান্নাঘর গোছানো, ছোট শিশু থাকলে তার ঘুম পাড়ানো বা তাকে দেখাশোনা করা—সব মিলিয়ে দুপুরটা তার জন্য বিশ্রামের নয়, বরং নতুন কাজের চাপে কাটে।

বিকালে ছোট ছোট কাজের ভিড়

বিকালে সন্তানদের স্কুল থেকে ফেরার সময় হয়ে যায়। তাদের জন্য নাশতা তৈরি, স্কুলের হোমওয়ার্ক দেখা, প্রয়োজন হলে কোচিং বা টিউশনের ব্যবস্থা করা—সবই গৃহিণীর দৈনন্দিন রুটিনে অন্তর্ভুক্ত। একই সঙ্গে প্রতিবেশী বা আত্মীয়স্বজন এলে তাদের আপ্যায়ন করাও তার দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায়।

বিকালবেলা গৃহিণী নিজেকে একটু সময় দিতে চান, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেটি সম্ভব হয় না। তার নিজের শখ, স্বাস্থ্য বা বিশ্রামের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে হয় পারিবারিক চাহিদার কারণে।

সন্ধ্যায় গৃহিণীই পরিবারের প্রাণ

সন্ধ্যা নামলে বাড়ির সবাই আবার একত্র হয়। এ সময় তিনি হয়ে ওঠেন পরিবারের মূল ভরসা। তিনি সবাইকে নিয়ে বসতে চেষ্টা করেন, খাবার প্রস্তুত করেন। আবার বাচ্চাদের পড়াশোনায় উৎসাহ দেন, পরিবারের সদস্যদের মানসিক সমর্থন দেন।

অনেক সময় আবার বিদ্যুৎ সমস্যা, পানির ঝামেলা, বা ঘরের অন্য কোনো অসুবিধা দেখা দিলে সেটি সমাধান করতেও তাকে এগিয়ে আসতে হয়। ফলে সংসারের সব ঝামেলার কেন্দ্রবিন্দুতেও তিনিই থাকেন।

রাতে অদৃশ্য ক্লান্তি

রাতের খাবার রান্না, পরিবেশন, থালাবাসন ধোয়া, কাপড় শুকাতে দেওয়া বা গোছানো—এসব কাজ শেষে যখন সবাই ঘুমোতে যায়, তখনও গৃহিণীর ঘুম আসে দেরিতে। তিনি নিশ্চিত করেন—দরজা-জানালা ঠিকভাবে বন্ধ হয়েছে কি না, বাচ্চারা ঠিকমতো ঘুমিয়েছে কি না, পরদিন সকালের জন্য খাবারের প্রস্তুতি রাখা হয়েছে কি না...।

দিনশেষে তিনি যখন নিজের জন্য একটু সময় পান, তখন শরীর-মন এতটাই ক্লান্ত থাকে যে বিশ্রামের বদলে ঘুমই হয়ে ওঠে সবচেয়ে বড় আশ্রয়।

অদৃশ্য পরিশ্রমের হিসাব

গৃহিণীর এই ২৪ ঘণ্টার কাজকে যদি অর্থমূল্যে পরিমাপ করা হয়, তবে তিনি একই সঙ্গে একাধিক পেশার দায়িত্ব পালন করেন—রান্নার জন্য একজন বাবুর্চি, সন্তান দেখাশোনার জন্য একজন শিক্ষক, পরিবারের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার জন্য একজন অর্থনৈতিক উপদেষ্টা, বয়স্কদের দেখভালের জন্য একজন নার্স, আবার পুরো পরিবারকে মানসিক সমর্থন দেওয়ার জন্য একজন পরামর্শক হিসেবে। অথচ এই শ্রম বেতনহীন এবং অনেক ক্ষেত্রে স্বীকৃতিহীন থেকে যায়।

স্বীকৃতি ও সম্মানের প্রয়োজন

গৃহিণী নারীর পরিশ্রমকে ছোট করে দেখার মানসিকতা বদলাতে হবে। পরিবারে তার শ্রমের মর্যাদা দিতে হবে, তাকে কৃতজ্ঞতা জানাতে হবে। পাশাপাশি সমাজকেও বুঝতে হবে, গৃহিণীর কাজ কোনোভাবেই ‘অকাজ বা ছোট’ নয়। বরং তার শ্রমই একটি সুস্থ, সুখী ও সুশৃঙ্খল পরিবারের ভিত্তি।

পরিশেষে বলতে চাই, একজন গৃহিণীর ২৪ ঘণ্টা আসলে বিরামহীন সংগ্রাম, যেখানে প্রতিটি মুহূর্ত জড়িয়ে থাকে শ্রম, ভালোবাসা, ত্যাগ ও দায়িত্বের সুনিপুণ সমন্বয়। তিনি ভোরে পরিবারের সবার আগে জেগে ওঠেন, আবার সবার শেষে ঘুমান। রান্না, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, সন্তানদের লালনপালন, পরিবারের অসুস্থ সদস্যের সেবা, অতিথি আপ্যায়ন—সবকিছুতেই তিনি নিঃস্বার্থভাবে শ্রম দেন, সেবা দেন। অথচ তার এই কাজের কোনো নির্দিষ্ট মূল্য নির্ধারণ নেই, নেই প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতিও। সমাজে প্রায়ই তাকে বলা হয়, ‘তিনি তো ঘরে বসে থাকেন।’ কিন্তু বাস্তবতা হলো, একজন গৃহিণীর শ্রম ছাড়া কোনো পরিবার টেকসই হতে পারে না। তাই গৃহিণীর প্রতি সম্মান, শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা শুধু পারিবারিক নয়, সামাজিক ও মানবিক দায়িত্বও বটে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক

প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত