আয়া সোফিয়া মসজিদে প্রথম জুমা

মাহফুজ আল মাদানী
প্রকাশ : ১১ জানুয়ারি ২০২৫, ১৫: ৩০

সুলতান রজব তাইয়্যেব এরদোয়ান সরকারপ্রধান হওয়ার পর থেকে আয়া সোফিয়াকে মসজিদে ফিরিয়ে আনার স্বপ্নে বিভোর ছিলেন। তবে সেটা খুব সহজ ছিল না। যার কারণে তিনি বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে জনমত গঠনের দিকে মনোনিবেশ করেন। আস্তে আস্তে ব্যাপক সাড়া ফেলে। ২০১৪ সালে আনতালিয়া ইয়ুত ফোরামের মাধ্যমে ‘জায়নামাজ নিয়ে আয়া সোফিয়া চল’ স্লোগানে আপামরজনতার মধ্যে বিপ্লব গড়ে তোলেন। সর্বশেষ জনগণের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১০ জুলাই ২০২০, শুক্রবার আয়া সোফিয়াকে জাদুঘরের মর্যাদা নাকচ করে মসজিদে রূপান্তরের আদেশ দেওয়া হয়। সুলতান এরদোয়ানের স্বাক্ষরের পরপরই এদিন আসরের আজান আয়া সোফিয়া থেকে সম্প্রচার করা হয়, যা ছিল প্রায় ৮৬ বছর পর ফিরে পাওয়া মসজিদ আয়া সোফিয়া। মামলার রায়ে তুরস্কের সর্বোচ্চ আদালত ‘১৯৩৪ সালে মন্ত্রিসভার যে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মসজিদ থেকে আয়া সোফিয়াকে জাদুঘরে রূপান্তরিত হয়েছিল, তা আইন মেনে করা হয়নি’ বলে ঘোষণা করেন। একই দিন সুলতান এরদোয়ান ২৪ জুলাই ২০২০, শুক্রবার নামাজ আদায়ের বিবৃতিও দেন। যে ঘোষণা তুরস্কসহ মুসলিম বিশ্বের আপামর জনতাকে করে উচ্ছ্বসিত, যা ছিল বায়তুল মাকদিস পুনরুদ্ধারের বীজ বপনের সূচনা।

বিজ্ঞাপন

যখন থেকে গুঞ্জন উড়ছিল শিগগিরই আয়া সোফিয়াকে আবার নামাজের স্থান হিসেবে ঘোষণা করা হচ্ছে, তখন থেকেই প্রতীক্ষার প্রহর গুনছিলাম। সর্বশেষ সংবাদমাধ্যমে নিউজ প্রকাশিত হলো, ১০ জুলাই রায় ঘোষিত হবে। আমি মনে মনে ভাবছিলাম, যেদিন রায় ঘোষিত হবে, সেদিন সম্ভবত মসজিদে নামাজ আদায় হবে। সে জন্য প্রস্তুতি নিয়েই রেখেছিলাম, রায় ঘোষণার দিন যেভাবেই হোক উপস্থিত হয়ে নামাজ আদায় করব। রায় ঘোষণা হওয়ার দিন রীতিমতো জায়নামাজ নিয়ে আয়া সোফিয়ায় উপস্থিত হই। মজার বিষয় হলো, আমি আসলে কল্পনাই করতে পারিনি যে, এত আয়োজন করে আয়া সোফিয়া মসজিদ হিসেবে ফিরে আসবে। সবশেষে, আয়া সোফিয়ায় পৌঁছে দেখি নামাজের মতো কোনো ব্যবস্থা তখনো হয়নি এবং ওইদিন রায় ঘোষণা হওয়ার কথা থাকলেও জুমার নামাজের আগে রায় প্রকাশিত হয়নি। পরে আয়া সোফিয়ার পাশেই বিখ্যাত ব্লু মোস্ক বা সুলতান আহমেদ মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করি। নামাজ আদায় শেষে আয়া সোফিয়ায় প্রবেশ করি। বলে রাখা ভালো, তখনও আয়া সোফিয়ায় প্রবেশ করতে প্রবেশ ফি বাধ্যতামূলক ছিল। আমার কাছে এক বছরের মিউজিয়াম কার্ড থাকায় অনায়াসে প্রবেশ করতে পারি।

আয়া সোফিয়ায় প্রবেশ করে চতুর্দিক ঘুরে ঘুরে ভালো করে অবলোকন করতে থাকি আর কল্পনা করে মনে মনে বলতে থাকি, আয়া সোফিয়া ইনশাআল্লাহ! শিগগিরই আমরা তোমাকে তোমার মূল হিসেবে ফিরে পাব। তোমায় মহান রবের তরে মাথাবনত করে আমরা ফিরে পাব ইস্তাম্বুল বিজেতা মহাবীর সুলতান মুহাম্মদ ফাতিহ (রহ.)-এর রেখে যাওয়া আমানত। ওইদিন বিকালে আসরের পরপরই রায় ঘোষিত হয় আয়া সোফিয়া আবারও মসজিদ হিসেবে নামাজের জন্য খুলে দেওয়া হবে। এটাও বলা হয়, আগামী ২৪ জুলাই শুক্রবার আনুষ্ঠানিকভাবে আয়া সোফিয়ায় জুমার নামাজ আদায়ের মাধ্যমে উদ্বোধন হবে এবং এ সময়ের মধ্যে আয়া সোফিয়াকে নামাজের জন্য প্রস্তুত করা হবে। যেহেতু এটা মিউজিয়াম ছিল এবং তাতে নামাজের পরিবেশ ছিল না। সেদিন থেকেই ক্ষণ গণনা শুরু করতে থাকি।

২৪ জুলাই শুক্রবার। আমরা রুমমেট সবাই বৃহস্পতিবার রাত থেকে প্রস্তুতি নিতে থাকি পরদিন আয়া সোফিয়ায় জুমার নামাজ আদায়ের জন্য। বাসা থেকে আয়া সোফিয়া যেতে সময় লাগে ঘণ্টাখানেক। সকাল ৯টায় রওনা দিয়ে পৌঁছাতে প্রায় পৌনে ১১টা বেজে যায়। মসজিদের আশপাশে জায়গা না পাওয়ায় অনেক দূরেই অবস্থান করতে হয়। আগের দিন সন্ধ্যা থেকে মসজিদের চতুর্পাশ কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে যায়। তাও আমরা নামাজের বহু আগে চলে যাওয়ায় অনেকটা কাছে ছিলাম, যেখান থেকে মসজিদ দেখা যাচ্ছিল। আসার সময় দেখতে পাই আমাদের পেছনে প্রায় দেড় থেকে দুই কিলোমিটারজুড়ে মানুষের সমাগম। সবদিকের যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ৮৬ বছর পর নামাজ আদায় এবং নিজে উপস্থিত থাকার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ অনেকটা কঠিন বা অসম্ভব। সেদিন আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে ইস্তাম্বুলসহ তুরস্কের আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়েছিল। মানুষের হাতে কালিমাখচিত পতাকা আর কপালে কালেমাখচিত ব্যাজে অনন্য এক পরিবেশ। সকাল থেকে মসজিদে পবিত্র কোরআনের সুরা ইয়াসিন, সুরা মারইয়াম, সুরা কাহাফ, সুরা আল ফাতহসহ বিভিন্ন সুরা তিলাওয়াত করা হচ্ছিল। নামাজে সুলতান এরদোয়ানসহ মন্ত্রিপরিষদের অনেকেই অংশ নেন। অংশ নেন লক্ষাধিক মুসলিম জনতা। করোনার প্রাদুর্ভাব জনসমাগম ঠেকাতে পারেনি। খুতবার আগে সুলতান এরদোয়ান পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত করেন। ধর্মমন্ত্রী নামাজের খুতবা পাঠ ও ইমামতি করেন। হাতে তরবারি নিয়ে খুতবা দেওয়ার মাধ্যমে জানান দেন মুসলিম জাতি বীরের জাতি। আল্লাহ ছাড়া কারও রক্তচক্ষুকে ভয় করে না। খুতবার এই ভিডিও ঝড় তুলে বিশ্বজুড়ে। এটা ছিল আধুনিক তুরস্কে আতাতুর্কের কালো অধ্যায় থেকে ইসলামের দিকে এগিয়ে যাওয়ার অন্যতম সোপান। আধুনিক তুরস্ক বিশ্বে আবার তাদের উসমানীয় শাসনের জানান দিতে সক্ষম হয়েছে।

ঘোষণা

প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য-উদ্ভাবন, রাজনীতি-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর আমাদের পাঠাতে পারেন। ই-মেইল: probash@dailyamardesh.com

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত