কারফিউ জারি ও সেনা মোতায়েন, নিহত ১৪৮

আবু সুফিয়ান
প্রকাশ : ২০ জুলাই ২০২৫, ০৬: ৩৪

দেশজুড়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের শুরু করা আন্দোলন ২০২৪ সালের ২০ জুলাই সহিংস আকার ধারণ করে। এমন পরিস্থিতিতে ১৯ জুলাই রাত ১২টা থেকে দেশের সব জেলায় কারফিউ ঘোষণা করে সরকার। মোতায়েন করা হয় সেনাবাহিনী। ১৬ থেকে ২০ জুলাই পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের গুলিতে মোট ১৪৮ জন নিহত হন। ২০ জুলাই একদিনেই সর্বোচ্চ ২৬ জন প্রাণ হারান। এর মধ্যে ঢাকাতেই নিহত হন ১৫ জন। এ ছাড়া ময়মনসিংহ ও সাভারে চারজন করে, গাজীপুরে দুজন এবং নরসিংদীতে একজন নিহত হন। চিকিৎসক ও হাসপাতাল সূত্র জানায়, নিহতদের অধিকাংশই তরুণ-তরুণী ও শিক্ষার্থী।

সেদিন রাজধানী ঢাকায় উত্তরা, যাত্রাবাড়ী, বাড্ডা, রামপুরা, মহাখালী, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, নীলক্ষেত, পুরান ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে দিনে সংঘর্ষের পর সন্ধ্যায় ব্যাপক হামলার ঘটনা ঘটে। বিক্ষুব্ধ জনতা সরকারি অফিস, আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয় ও নেতাদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করেন।

বিজ্ঞাপন

দেশে রেল ও বাস চলাচল বন্ধ থাকলেও লঞ্চ চলাচল চালু ছিল। ঢাকায় মেট্রোরেল পরবর্তী নির্দেশ না আসা পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করা হয়। মোবাইল ইন্টারনেট ও ব্রডব্যান্ড সেবা বন্ধ থাকায় তথ্যপ্রবাহ বন্ধ ছিল। জনসাধারণ অনলাইন সংবাদ থেকে বঞ্চিত হয়েছিল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের সশস্ত্র হামলার পর সারা দেশে বিক্ষোভ ও সহিংসতা শুরু হয়। ঢাকার বাইরে রংপুর, মাদারীপুর, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, কক্সবাজার, সিলেট ও নরসিংদীতেও হতাহতের ঘটনা বাড়তে থাকে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এ ঘটনাকে বাংলাদেশের ইতিহাসের বড় কোনো সহিংস ঘটনার সঙ্গে তুলনা করেছিলেন।

ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে ছাত্র আন্দোলন এবং বিক্ষোভ দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হেলিকপ্টার থেকে গুলি ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করেছিল। র‌্যাবের একটি হেলিকপ্টার থেকে মোট তিন দফা কাঁদানে গ্যাস শেল নিক্ষেপ করা হয়, যা আবাসিক এলাকাগুলোতে ধোঁয়া ছড়িয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল।

কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি পালনকালে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক সংঘর্ষ, হামলা, ভাঙচুর, গুলি, অগ্নিসংযোগ এবং প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। সেদিন রাজধানী কার্যত অচল হয়ে পড়ে।

শুরুতে আন্দোলনে শুধু শিক্ষার্থীরা অংশ নিলেও পরবর্তী সময়ে স্থানীয় লোকজনও এসে যোগ দিয়েছিল। বিএনপি, গণতন্ত্র মঞ্চ, ইসলামী আন্দোলনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল কর্মসূচি পালন করে। জবাবে পুলিশ, বিজিবি ও র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিভিন্ন এলাকায় নৃশংস পন্থা বেছে নেয়।

২০ জুলাই রাত অবধি মহাখালী, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, নীলক্ষেত, সায়েন্স ল্যাব ও অন্যান্য এলাকায় সংঘর্ষ চলে। বাসস্ট্যান্ড, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কার্যালয়, শিয়া মসজিদ, রাজারবাগসহ বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।

আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের মন্তব্য করেছিলেন, ‘কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শিক্ষার্থীদের হাত থেকে বিএনপি, ছাত্রদল, যুবদল, জামায়াত ও শিবিরের হাতে চলে গেছে’। তিনি বিরোধী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে দলের নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছিলেন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা ৯ দফা দাবি বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তাদের দাবির মধ্যে ছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সড়ক পরিবহনমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের পদত্যাগ, পুলিশের হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের দ্রুত গ্রেপ্তার, ক্ষতিপূরণ প্রদান ও ছাত্ররাজনীতির সংস্কার।

সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে প্রান্তিক এলাকায়

গাজীপুর মহানগরের টঙ্গী পশ্চিম ও গাছায় আন্দোলনকারীরা থানা অবরোধ করেন। পুলিশ হেলিকপ্টার থেকে কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে। এ ঘটনায় অন্তত ১৫০ জন আহত হন এবং ৫৩ জন গুলিবিদ্ধ হাসপাতালে ভর্তি হন।

সাভার বাসস্ট্যান্ড, বাজার রোড, রেডিও কলোনি এলাকায় পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ হয়। পুলিশের গুলি ও কাঁদানে গ্যাসের জবাবে সংঘর্ষ ও ইটপাটকেল ছোড়েন আন্দোলনকারীরা।

ময়মনসিংহের গৌরীপুরে পুলিশের গুলিতে তিন বিক্ষোভকারী নিহত হন, একই দিনে ফুলপুরে বিজিবির গাড়িতে হামলার সময় পথচারী গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।

নরসিংদীর পাঁচদোনা মোড়ে আন্দোলনকারীরা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সসহ সরকারি ভবনে আগুন দিয়ে ভাঙচুর চালায়। শিবপুরে একজন নিহত হন।

২০ জুলাই রাতে ধানমন্ডিতে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবনে নিরাপত্তা সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘জনগণের নিরাপত্তা এখন আমাদের অগ্রাধিকার। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত কারফিউ চলবে।’ তিনি দাবি করেন, কোটা আন্দোলনের নাম ভাঙিয়ে বিএনপি-জামায়াত সহিংসতা ছড়াচ্ছে।

আন্দোলনকারীদের গ্রেপ্তার

এর আগে চব্বিশের ১৯ জুলাই রাতে আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়। যদিও তখন এ অভিযোগ অস্বীকার করেছিল ডিবি। এমনকি বিষয়টি তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও অজানা বলে মন্তব্য করেন।

নৃশংস হত্যাযজ্ঞের পাশাপাশি ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ থাকায় সেদিন এক ভয়াবহ পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। জনজীবনে সৃষ্টি হয়েছিল অচলাবস্থা ও আতঙ্ক। তৎকালীন সরকার পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত কারফিউ অব্যাহত রাখে এবং দুদিনের ‘সাধারণ ছুটি’ ঘোষণা করে।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত