মাদরাসা ও সংসার হারিয়ে দিশেহারা জুলাইযোদ্ধা শফিকুর

স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ : ২৯ আগস্ট ২০২৫, ২০: ৪৬

চব্বিশের জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম একজন যোদ্ধা তরুণ আলেম মাওলানা শফিকুর রহমান। আন্দোলন ঘিরে যাত্রাবাড়ীর কাজলা এলাকায় পতিত আওয়ামী সরকারের পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে তার বাগবিতন্ডার একটি ছবি ভাইরাল হয়ে যায়। রামপুরা এলাকায় আন্দোলনকারীদের মাঝে খাবার বিতরণ করতে দেখা যায় তাকে। একপর্যায়ে পুলিশের ছোড়া গুলিতে বিদ্ধ হয়।

এমনই একজন জুলাইযোদ্ধা এখন চরম অসহায় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। বাড়িওয়ালা শ্রমিকলীগ নেতার রোষানলে পড়ে নিজের প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা বন্ধ করতে বাধ্য হন তিনি। ঋণের চাপ আর অভাব অনটনের কারণে মেয়েসহ সংসার ছেড়ে গেছেন তার স্ত্রীও। এ অবস্থায় জুলাইযোদ্ধা হিসেবে সরকারের স্বীকৃতির পাশাপাশি আবারও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা ও ঘুরে দাঁড়াতে সরকারসহ সংশিষ্টদের সহায়তা কামনা করছেন মাওলানা শফিকুর রহমান।

বিজ্ঞাপন

জানা গেছে, রাজধানীর ভাটারার ছোলমাইদ এলাকায় আব্দুল লতিফ খন্দকার বাড়ির মোড়ের একটি দোতলা বাড়িতে তিনটি কক্ষ ভাড়া নিয়ে প্রিন্সিপাল হিসেবে মাদরাসা চালাতেন মাওলানা শফিকুর রহমান। প্রতিষ্ঠানটির বাড়িওয়ালা ছিলেন ভাটারা থানা শ্রমিক লীগের সভাপতি মিজান খন্দকার।

গত বছরের ১৭ জুলাইয়ে যাত্রাবাড়ীর কাজলা সেতুতে পুলিশের সঙ্গে মাওলানা শফিকুর রহমানের বাগবিতন্ডার একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। সেদিনই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে শহীদ আবু সাঈদের গায়েবানা জানাজায় অংশ নেন। সন্ধ্যায় তিনি মাদ্রাসায় ফিরলে বাড়িওয়ালা মিজান খন্দকারের ছেলে রাব্বী খন্দকার ৪-৫ জন সঙ্গে নিয়ে এসে তাকে হুমকিধমকি দেন এবং বাসা ছেড়ে দিতে বলেন।

পরদিন ১৮ জুলাই রামপুরায় ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেন মওলানা শফিকুর রহমান। সেদিন তার পায়ে ও হাতে পুলিশের ছোড়া রাবার বুলেট ও ছররা গুলি লাগে। তাৎক্ষণিকভাবে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির দোতলায় অস্থায়ী মেডিকেল ক্যাম্পে প্রাথমিক চিকিৎসাও নেন তিনি।

সে সময় মাদ্রাসার শিক্ষকরা তাকে বারবার ফোন করছিলেন বাড়িওয়ালার চাপের কথা জানিয়ে। ১৯ জুলাইয়েও রামপুরা সেতুতে আন্দোলনে অংশ নেন মাওলানা শফিকুর। পরেও মাদ্রাসায় গিয়ে মিজান খন্দকারের ভাই মনির খন্দকারের হুমকিধমকির শিকার হন।

মাওলানা শফিকুর রহমান জানান, শ্রমিক লীগ নেতার দোতলা বাড়িটির দোতলায় তিনটি কক্ষে ২৪ হাজার টাকা ভাড়ায় পরিচালিত হতো তার মাদরাসাতুল ফুনুন আল ইসলামিয়্যা, ঢাকা। সেখানে শিশু থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত নূরানী, নাজেরা ও হেফজ পড়ানো হতো। ৭০ জন শিক্ষার্থী এবং সাতজন শিক্ষক ছিল মাদ্রাসাটিতে। জুলাই-আগস্টে বাড়িওয়ালার চাপ বুঝতে পেরে অভিভাবকরাও সন্তানদের নিয়ে চিন্তায় পড়ে যান।

মাদরাসাটির মেয়েশিশুদের বিভাগের প্রধান ছিলেন শফিকুরের স্ত্রী তানিয়া আক্তার। তাদের ২ বছর বয়সি মেয়ে আছে। অভাব অনটন ও প্রতিষ্ঠান বন্ধসহ বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে স্ত্রী তানিয়া শফিকুরকে তালাক দিয়ে চার বছরের সংসার ছেড়ে গেছেন। দীর্গ দিন যোগাযোগ বন্ধ রাখার পর তিন মাস আগে এই তালাকনামা পাঠান তিনি। তবে এতে শফিকুর এখনো সই করেননি বলে জানিয়েছেন।

বন্ধ হওয়া মাদ্রাসাটির শিক্ষক হাফেজ দাউদ ইসলাম জানান, গত বছরের আগস্টে বাসা ছেড়ে দেয়ার চাপ দেন মালিক। অনেক চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে নভেম্বরে পুরো ছাড়তে বাধ্য হই। পরিস্থিতি খারাপের কারণে কয়েকমাসের বেতনও আমি নিতে পারিনি।

মাওলানা শফিকুর জানান, তিনি নিজে জুলাই আহতদের জন্য নানা কাজ করেছেন। নিজের জন্য কিছু প্রয়োজন মনে করতেন না তিনি। যে কারণে এতদিন সহায়তার জন্য কোথাও কোন আবেদনও করেননি তিনি।

পরে সংকটময় পরিস্থিতিতে বন্ধুদের পরামর্শে জুলাই আহত হিসেবে তালিকাভুক্তির জন্য ঢাকা জেলা সিভিল সার্জনের কার্যালয়ে গত ১৫ এপ্রিল তার কাগজপত্র জমা দেন। সম্প্রতি ঢাকা ও তার জন্ম এলাকা চাঁদপুরের জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ডেকে প্রয়োজনীয় তথ্য নেওয়া হয়েছে।

তিনি জানান, মাদরাসা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তিনি প্রায় ৫ লাখ টাকা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। প্রয়োজনীয় সহায়তা পেলে তার মাদরাসাটি আবার চালু করতে চান। এ বিষয়ে এনসিপি সহ বিভিন্ন দলের সঙ্গেও তিনি যোগাযোগ করেছেন। জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে তাকে জানানো হয়েছে, এমআইএস নম্বর (আহত সার্টিফিকেট সংক্রান্ত) দিতে। সেটি এখনও প্রক্রিয়াধীন।

এদিকে মাওলানা শফিকুরের বন্ধ হয়ে যাওয়া মাদরাসাটির বাড়িওয়ালা মিজান খন্দকারের হোয়াটসআপ নম্বরে কল দিলে তিনি রিসিভ করনেনি। শফিকুর গত সোমবার বাড়িটিতে গেলে দারওয়ান জানান, বাসায় কেউ নেই।

এ বিষয়ে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সামসি আরা জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, আমরা মাওলানা শফিকুর রহমানের বিষয়টি বিভিন্ন মাধমে শুনেছি। তবে তিনি আমাদের সঙ্গে এখনো যোগাযোগ করেননি। তার বিষয়টি খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত