
রেজাউল করিম রনি

একথা সত্য হলেও একটু করুণ শোনাবে যে, এখন পর্যন্ত আমরা হুমায়ূনের ‘পাঠ’ দাঁড় করাতে পারিনি। তাহলে প্রশ্ন এসে যাচ্ছে, কোনো কিছু পড়া মানে সাধারণ অর্থে রিড করা আর ‘পাঠ’ দাঁড় করানো কি এককথা নয়? এ দুটা যে সম্পূর্ণ ভিন্ন, তা আমরা প্রায়ই খেয়ালের মধ্যে রাখি না। আমাদের উদ্দেশ্য হুমায়ূনের ‘পাঠ’ দাঁড় করানো। কথাটা ভেঙে বলা প্রয়োজন।
আমরা এতদিন হুমায়ূন নিয়ে যত আলোচনা, মতামত-মাতম ইত্যাদি দেখেছি, তাতে হুমায়ূন পাঠের দিকটা আড়ালে চলে গিয়েছে। ফলে সেইসব রেটরিক্যাল/বাচালি কথাবার্তার বাইরে হুমায়ূনকে ‘পাঠ’ করা অতি সহজ কাজ নয় মোটেই। আরো গোড়া থেকে প্রশ্ন করা যায়, কীভাবে হুমায়ূনকে বা তার কোনো টেক্সট/রচনাকে পাঠ করতে হবে?
কোনো রচনাকে আমরা শুধু তার অন্তর্গত বৈশিষ্ট্যের কারণেই পাঠ করে উঠতে পারি না। অন্তর্গত বৈশিষ্ট্য কথাটার মানে হলো—লেখার ধরন, বিশেষ ধরনের বাক্যপ্রকরণ, চরিত্রের বুনন, হাস্যরস, জীবনদৃষ্টি ইত্যাদি নানা কিছু। এসবের বাইরেও মেলা কিছু আছে। তাই কেবল টেক্সচুয়াল বা কিতাবি রিডিংয়ে পুরোটা ধরা পড়ে না। তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে, কোনো রচনা পাঠ করতে হলে রচনার অন্তর্গত এবং কনটেক্সচুয়াল বা সময়ময়তা—দুই অর্থেই তাকে খতিয়ে দেখতে হয়।
তাতেও শেষ পর্যন্ত আমরা কোনো রচনা থেকে আমাদের কাজে লাগে—এমন বিষয়সমূহ ঠিক ঠিক উদ্ধার করতে পারি না। এর জন্য প্রথমত একটা বিষয়ের দিকে আমাদের নজর ফেরাতে হয়। সেটা হলো সাহিত্য পাঠ করার যে ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা সমাজে গড়ে ওঠে তাকে আমলে আনা। এর মধ্যে সামাজিক-রাজনৈতিক শ্রেণি সম্পর্ক ও আদর্শের প্রশ্নও চলে আসে।
আমি হুমায়ূন সম্পর্কে যেটা বলছি তা হলো, আমরা এখনো হুমায়ূনের ‘পাঠ’ দাঁড় করাতে পারিনি বা হুমায়ূন ‘পাঠে’র কোনো তরিকাও আমরা জানি না। ‘পাঠ’ কথাটা যদি কনটেক্সচুয়ালাইজেশন অর্থে বলি, তাহলে দেখব, হুমায়ূন যে ইতিহাসের মধ্যে বা বিশেষভাবে বললে, যে ইতিহাসের বয়ানের মধ্যে বা প্রাধান্য বিস্তারকারী, যেটাকে আমরা হেজেমনিক বয়ান বলি, তার মধ্যে লেখক হিসেবে গড়ে ওঠা সেই বয়নটার কোনো বিচার আমরা করিনি।
দুই, সাংস্কৃতিক যে ঐতিহ্য হুমায়ূনের সময়ে জারি ছিল, তার নিরিখে হুমায়ূন নিয়ে কোনো কথা আমরা দেখি না। এই দুটি দিক ছাড়া আরো বিবেচনাযোগ্য দিক রয়েছে। আশা করি কনটেক্সচুয়ালাইজেশন করা বলতে কী বুঝিয়েছি, তা পরিষ্কার করতে পেরেছি। হুমায়ূন ‘পাঠ’ কথাটা এই কনটেক্সচুয়ালাইজ করা অর্থেই বলেছি। এটা আমাদের এখানে হয়নি। এর জন্য শুধু সাহিত্যের একাডেমিক বা অধ্যাপকীয় সমালোচনাই যথেষ্ট নয়। এর জন্য ঐতিহাসিক পর্যালোচনার রাজনৈতিক-সামাজিক বিবেচনা দরকার। সেই দিক থেকে হুমায়ূনের ভাগ্য খুব খারাপ বলতে হবে। তিনি ব্যাপক পাঠক পেয়েছেন, কিন্তু তার বিশাল কাজের কোনো কনটেক্সচুয়াল বা পাঠ-পর্যালোচনা দাঁড়ায়নি। চেষ্টাও দেখা যায়নি। আমরা হুমায়ূন নিয়ে ঘুরেফিরে মুখস্থ কিছু কথাবার্তা শুনি, এই যা।
হুমায়ূনকে ‘পাঠ’ করতে হলে এইসব দিক একইসঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। মনে হতে পারে, এ আর এমন কী! কথাটা এজন্যই জোর দিয়ে বলা দরকার। এতদিন হুমায়ূন নিয়ে আমরা যে আলোচনা দেখেছি, তাতে আগের দুটি বিষয় কমবেশি এসেছে। অর্থাৎ তার রচনার অন্তর্নিহিত বিষয় ও কনটেন্ট ধরে সমালোচকরা আলোচনা করেছেন। কিন্তু সেই আলোচনা দিয়ে হুমায়ূনকে বোঝার ক্ষেত্রে বহুমাত্রিক সমস্যা তৈরি হয়েছে। কারণ আমাদের এখানে সাহিত্যপাঠের যে ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা গড়ে উঠেছে, তার মধ্যে যে গভীর কুশিক্ষা, সেটার কোনো হদিস আমরা রাখিনি। ফলে হুমায়ূন-পাঠের জন্য ভূমিকা প্রস্তাবনার ওসিলায় এই জরুরি দিকটি সংক্ষেপে আলোচনা করতে হচ্ছে।
হুমায়ূন-পাঠে বাংলা সাহিত্যে যে ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা গড়ে উঠেছে, তাকে খতিয়ে দেখা হয়নি। এই প্রশ্ন না করলে হুমায়ূন পাঠ করার মূল সূত্রটিই আমরা ধরতে পারব না। ঐতিহাসিকভাবেই হুমায়ূনের পথটি এত আলাদা যে, তাবৎ সাহিত্য মূল্যায়নের ট্র্যাডিশন হুমায়ূনে এসে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। আমরা এতদিন সাহিত্য মূল্যায়নের যে চর্চা জারি রেখেছি, তা মূলত বঙ্গীয় রেনেসাঁ-প্রভাবিত। বাবুআনার রুচি ধরে এইটা তৈরি হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ তো সরাসরি এই রেনেসাঁ প্রকল্পের মধ্যে পড়ে না।
এর স্বাতন্ত্র্য এত স্পষ্ট হওয়া সত্ত্বেও আমরা ঔপনিবেশিক রুচির মধ্যেই বাংলাদেশের সাহিত্য বোঝার চেষ্টা করেছি। এই উপনিবেশ কিন্তু আবার সেকেন্ড-হ্যান্ড উপনিবেশ। এটাকে বলা যায়, সাবলেট কলোনিয়ালিজম। মানে কলকাতা পশ্চিমের রুচিমতো নিজেদের সাহিত্যরুচি তৈরি করছে। এর সঙ্গে সংস্কৃতি-জানা হিন্দুয়ানি গরিমা মিশাই দিছে। আর সেই ঠুলি দিয়া বাংলাদেশের সাহিত্য দেখা হইতেছে। নন্দনতত্ত্বের রাজনীতি নিয়ে অন্য এক লেখায় এগুলো বলেছি। আজ হুমায়ূনেই থাকি।
তো সেই দিক থেকে হুমায়ূন ঔপনিবেশিক সাহিত্য রুচির জন্য বিরাট হুমকি হিসেবে দাঁড়িয়েছেন। বিশেষ করে, আমাদের এখানে তথাকথিত ক্লাসিক সাহিত্যের যে ধারণা গড়ে উঠেছে, তা পশ্চিমা এনলাইটনমেন্টের প্রভাবেই গড়ে ওঠা। হুমায়ূন সচেতনভাবে এই প্রকল্পকে থোড়াই কেয়ার করেছেন। সেই কারণে হুমায়ূনকে সস্তা-বাজারি লেখক বললে আর কাজ হচ্ছে না। কোথায় তার লিটারেরি প্রকল্পটা, আলাদা তার হদিস না করলে আমরা হুমায়ূন বিচারে বড় ধরনের অবিচারই করে ফেলব। টীকা আকারে এতটুকুই আপাতত।
হুমায়ূন পাঠের ক্ষেত্রে আমরা যে ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা অবলম্বন করেছি, তা আমাদের জন্য আত্মঘাতী হয়ে উঠেছে। আমি হুমায়ূন নিয়ে আমাদের এখানে যে সকল আলোচনা ইতোমধ্যে হাজির হয়েছে, তার দিকে নজর রাখার চেষ্টা করেছি এবং এ সকল আলোচনার কোনোটাই এখন পর্যন্ত হুমায়ূনের মূল শাঁসটা বা নাড়ি বা অন্তর্গত পালস্ ধরতে পারেনি। এজন্য তাদের দোষারোপ করার কোনো যুক্তি নেই। কারণ হুমায়ূনপাঠের জন্য তারা যে টেক্সচুয়াল এবং কনটেক্সচুয়াল পথ অনুসরণ করেছেন, তা দিয়ে তারা যথারীতি অনেক গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক মতামতের অবতারণা করে ফেলেছেন। কিন্তু হুমায়ূন যে তাদের এত দিনের অনুসরণীয় কনটেক্সচুয়ালের বাইরের লেখক, তা তারা ঠিক ঠিক ঠাওরে উঠতে পারেননি।
ফলে সাহিত্যিক আলোচনার জন্য যে ঐতিহাসিক সিলসিলা বা ভাবধারা দ্বারা এই সকল পণ্ডিতকুল তাড়িত, হুমায়ূন সেই পথ থেকে শত মাইলের দূরত্বে থাকেন। এতে করে তাকে গড়গড় করে পড়েও আমরা তার ‘পাঠ’ দাঁড় করাতে পারিনি। এইবার আমরা দেখব হুমায়ূনকে নিয়ে আমাদের সাহিত্যপাড়ায় কী কথা হয় এবং তার সঙ্গে হুমায়ূনের ফারাক কতখানি?
ট্র্যাডিশনাল সাহিত্যের আলোচনায় হুমায়ূন সম্পর্কে অনিবার্যভাবে উচ্চারণ করা হয়, হুমায়ূন জনপ্রিয় লেখক। আরো বলা হয়, তিনি পাঠকপ্রিয় লেখক, প্রকাশনা ব্যবসায় বিপ্লব এনেছেন, পাঠক তৈরিতে ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছেন, বাংলাদেশের সাহিত্যের বাজার থেকে পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের একচেটিয়া প্রভাব প্রায় একাই হটিয়ে দিয়েছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে, এ সকল কথাবার্তার কোনোটাই হুমায়ূনকে বোঝার ক্ষেত্রে আমাদের কাজে আসে না।
হুমায়ূন আলোচনার জন্য তারা যেসকল প্রশ্ন বা প্রসঙ্গ সামনে আনেন, তা হুমায়ূনের যে ঐতিহাসিক কনটেক্সট সেদিক থেকে খুবই গৌণ। কারণ তারা হুমায়ূনের ঐতিহাসিক পটভূমি কখনো তালাশ করার চেষ্টা করেননি। তাই হুমায়ূন আলোচনায় তাদের খেই হারানো ভাবটা লুকাতে তারা হুমায়ূনকে বাজারি লেখক আখ্যা দিয়ে পাশ কাটিয়ে যেতে চান। তাকে হালকা চালের লেখক বলে সাহিত্যেও একটা ‘এলিটিজম’ খাড়া করে হুমায়ূনের ব্যাপারে পাহাড়প্রমাণ মূর্খতাকে পণ্ডিতি বলে চালিয়ে দেন। ফলে এত আবর্জনার ভেতর হুমায়ূনপাঠের একটা ধরন বের করা খুবই কষ্টকর কাজ সন্দেহ নেই।
এখন আমরা দেখব কেন ‘হুমায়ূনপাঠ’ এতদিনেও দানা বাঁধেনি।
হুমায়ূনপাঠের জন্য বাংলাদেশ ও ভারতে অভিন্ন যে ডমিনেন্ট সাহিত্যরুচি দাঁড়িয়ে গেছে, তা সবচেয়ে বড় বাধা। এই সাহিত্যরুচি মোটা দাগে ঔপনিবেশিক। ফলে আলাদা করে যখনই আমরা হুমায়ূনের ‘পাঠ’ নির্মাণের দিকে এগোব, সঙ্গে সঙ্গে ধসে পড়বে কলোনিয়াল আধুনিক সাহিত্যরুচি। এই কলোনিয়াল সাহিত্যরুচির জন্য হুমায়ূন বিপদ আকারে হাজির হয়েছেন। তাই হুমায়ূনের বিশাল পাঠক থাকা সত্ত্বেও ক্যালকেশিয়ান এলিট পারোকিয়াল সাহিত্যধারা হুমায়ূনকে প্রতিনিয়ত তাচ্ছিল্য করে চলেছে।
অন্যদিকে আরো কিছু বিপত্তি আছে, তাও একটু একটু করে আলোচনা করা হবে। আমাদের এখানে কোনো লেখককে আমরা যেসব কোয়ালিটির জন্য নমস্য বিবেচনা করি, হুমায়ূন সচেতনভাবে সেগুলোকে নিজের লেখালেখির এলাকা থেকে বিদায় করেছিলেন। যেমন লেখায় ভীষণরকম একটা মতাদর্শ থাকতে হবে। চরিত্রগুলোকে হতে হবে খুবই আদর্শিক। ভাষা হবে ঠাস-বুনট, উপন্যাসের ক্ষেত্রে থাকতে হবে মহাকাব্যিক দ্যোতনা ইত্যাদি। এককথায় আমাদের সাহিত্যিক রুচি ভীষণরকম ধর্মতাত্ত্বিক। কারণ উনিশ শতকের বাঙালি রেনেসাঁই আমাদের রুচি তৈরি করেছে, এরা এসেছে সরাসরি ইউরোপের প্রোটেস্টান্ট রুচি থেকে। সেই অর্থে ধর্মতাত্ত্বিক। ফলে হুমায়ূন সবসময়ই এখানকার তথাকথিত প্রগতিশীলতার নামে মৌলবাদী সাহিত্যিক-আলোচকদের দ্বারা আক্রমণের শিকার হয়েছেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো যারা হুমায়ূনকে গালি দিতেন, তারাও হুমায়ূনের নতুন বই পড়ার জন্য মুখিয়ে থাকতেন। হুমায়ূন পড়তেন গোপনে আর প্রকাশ্যে করতেন গালাগালি। তাদের সাহিত্যিক এলিটিজম হুমায়ূনকে হজম করতে পারত না। কিন্তু হুমায়ূনের আকর্ষণ এড়ানোও তাদের পক্ষে সম্ভব হতো না। আমরা যদি এতদিন নিজের কাছে এই প্রশ্নটাও করতাম—‘আমি কেন হুমায়ূন পড়ি,’ তাহলেও হুমায়ূনের ব্যাপারে যে কুসংস্কার তৈরি হয়েছে, তা এত পর্বতসমান হতো না।
আমরা যদি নিজেদের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী হতে পারি, তাহলে এতসব আলোচনা-সমালোচনার তোয়াক্কা না করে ঘোষণা দিতে পারতাম—আমি হুমায়ূন পড়ি এবং এই কারণেই হুমায়ূন জরুরি। এই ‘আমি’ মানে পূর্ব বঙ্গের ‘আমি’। হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে এখানকার তাবৎ লেখকদের সঙ্গে যে জায়গাটায় সবচেয়ে বড় ফারাক, তাকে এককথায় ‘আমি’র ফারাকও বলা যায়। আধুনিক বা আধুনিক-উত্তর চিন্তায় আচ্ছন্ন লেখকের কাছে ‘আমি’ মানে একক। তাদের কাছে ‘আমি’ কেবল ইনডিভিজুয়ালের আইডেন্টিটি মাত্র। ফলে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি হুমায়ূনের সঙ্গে এসে যেখানে মার খায় তা হলো, লেখক মাত্রই ইনডিভিজুয়াল চরিত্র সৃষ্টি করেন, কিন্তু হুমায়ূনের ‘আমি’ কোনোভাবেই পশ্চিমা আধুনিকতার আছর-পড়া ইন্ডিভিজুয়াল আমি না। তার ‘আমি’ হলো বাংলার চিন্তার ভেতর থেকেই উঠে আসা।
আর হুমায়ূন বলেন, ‘আমি’ আমার কিছু অপছন্দের শব্দের একটি। আমরা পৃথিবীতে যখন বাস করতে আসি, তখন ‘আমি’র সঙ্গে যুক্ত হয় সন্তান, স্ত্রী, বন্ধুবান্ধব, স্বজন। জন্মের আগে এবং মৃত্যুর পরে ‘আমি’ বলে কিছু থাকলেও থাকতে পারে; কিন্তু জীবিত অবস্থায় ‘আমি’ বলে কিছু নেই।’ (আমি, হুমায়ূন আহমেদ, অন্য প্রকাশ, ২০১১)
এটা সমষ্টির ‘আমি’ এবং সে এখনো নিজের সম্পর্কে সচেতন হয়নি। তার এখনো চৈতন্যপ্রাপ্তি ঘটেনি। বাংলার চিন্তাভূমিতে যে দার্শনিক তর্কটা অতি জরুরি—মানুষ একই সঙ্গে বিশেষ এবং সামান্য। এই বিশেষ বা সামান্যকে ধরার জন্য আধুনিক ‘আমি’র নিরাকরণ ঘটাতে হয়। এই দিক থেকে হুমায়ূন বাংলার চিন্তামূলের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত।
আলোচনা করছিলাম আমাদের সাহিত্যিক রুচিটা ধর্মতাত্ত্বিক। এই ধর্মতত্ত্বের বয়ানও দাঁড়িয়েছে পরদেশি যাজকদের বয়ানের মারফতে। ফলে এর প্রতি আমরা এতদিন যে প্রশ্নহীন অবস্থানে ছিলাম, তা নতুন করে আর ব্যাখ্যা করছি না। তবে হুমায়ূনপাঠের সরাসরি ফজিলত হলো, এটাকে সমূলে উপড়ে ফেলার কাজটা সহজ হয়ে যায়। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকে আবার যদি শুধু সাহিত্যের ইতিহাস আকারে দেখি, তাহলে সেই দেখাটাও আংশিক দেখা হবে, এর সঙ্গে ইতিহাস নির্মাণের প্রশ্নটা সরাসরি জড়িত। আমাদের আত্মপরিচয়ের প্রশ্নটা ডাইরেক্ট জড়িত। এই আত্মপরিচয়ের যে অলিখিত ন্যারেশন বাংলাভূগোলে ছড়িয়ে আছে, তাকে আধুনিক সাহিত্যরুচির শাসনকে থোরাই কেয়ার করে হাজির করার যে ক্যারিশমা হুমায়ূন দেখিয়েছেন, তাকে আমি বিপ্লবী প্রচেষ্টা আকারে দেখছি। এটা আবিষ্কার করার জন্য আমাদের যে ধরনের জ্ঞানগত প্রস্তুতি নিয়ে সাহিত্যের দিকে তাকানো দরকার, তার কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। এটা অতি আফসোসের কথা। হুমায়ূন পাঠের সময় একটু খেয়াল করে বাংলার জনগোষ্ঠীর আত্মপরিচয়ের প্রশ্নটা এখন মাথায় রাখলে নতুন অর্থ তৈরি হতে থাকবে। আর সাহিত্য বিচারের পুরোনো অচলায়তনটাও ভাঙতে থাকবে বলে মনে হয়।
(শেষ পর্ব আগামী সংখ্যায়)

একথা সত্য হলেও একটু করুণ শোনাবে যে, এখন পর্যন্ত আমরা হুমায়ূনের ‘পাঠ’ দাঁড় করাতে পারিনি। তাহলে প্রশ্ন এসে যাচ্ছে, কোনো কিছু পড়া মানে সাধারণ অর্থে রিড করা আর ‘পাঠ’ দাঁড় করানো কি এককথা নয়? এ দুটা যে সম্পূর্ণ ভিন্ন, তা আমরা প্রায়ই খেয়ালের মধ্যে রাখি না। আমাদের উদ্দেশ্য হুমায়ূনের ‘পাঠ’ দাঁড় করানো। কথাটা ভেঙে বলা প্রয়োজন।
আমরা এতদিন হুমায়ূন নিয়ে যত আলোচনা, মতামত-মাতম ইত্যাদি দেখেছি, তাতে হুমায়ূন পাঠের দিকটা আড়ালে চলে গিয়েছে। ফলে সেইসব রেটরিক্যাল/বাচালি কথাবার্তার বাইরে হুমায়ূনকে ‘পাঠ’ করা অতি সহজ কাজ নয় মোটেই। আরো গোড়া থেকে প্রশ্ন করা যায়, কীভাবে হুমায়ূনকে বা তার কোনো টেক্সট/রচনাকে পাঠ করতে হবে?
কোনো রচনাকে আমরা শুধু তার অন্তর্গত বৈশিষ্ট্যের কারণেই পাঠ করে উঠতে পারি না। অন্তর্গত বৈশিষ্ট্য কথাটার মানে হলো—লেখার ধরন, বিশেষ ধরনের বাক্যপ্রকরণ, চরিত্রের বুনন, হাস্যরস, জীবনদৃষ্টি ইত্যাদি নানা কিছু। এসবের বাইরেও মেলা কিছু আছে। তাই কেবল টেক্সচুয়াল বা কিতাবি রিডিংয়ে পুরোটা ধরা পড়ে না। তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে, কোনো রচনা পাঠ করতে হলে রচনার অন্তর্গত এবং কনটেক্সচুয়াল বা সময়ময়তা—দুই অর্থেই তাকে খতিয়ে দেখতে হয়।
তাতেও শেষ পর্যন্ত আমরা কোনো রচনা থেকে আমাদের কাজে লাগে—এমন বিষয়সমূহ ঠিক ঠিক উদ্ধার করতে পারি না। এর জন্য প্রথমত একটা বিষয়ের দিকে আমাদের নজর ফেরাতে হয়। সেটা হলো সাহিত্য পাঠ করার যে ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা সমাজে গড়ে ওঠে তাকে আমলে আনা। এর মধ্যে সামাজিক-রাজনৈতিক শ্রেণি সম্পর্ক ও আদর্শের প্রশ্নও চলে আসে।
আমি হুমায়ূন সম্পর্কে যেটা বলছি তা হলো, আমরা এখনো হুমায়ূনের ‘পাঠ’ দাঁড় করাতে পারিনি বা হুমায়ূন ‘পাঠে’র কোনো তরিকাও আমরা জানি না। ‘পাঠ’ কথাটা যদি কনটেক্সচুয়ালাইজেশন অর্থে বলি, তাহলে দেখব, হুমায়ূন যে ইতিহাসের মধ্যে বা বিশেষভাবে বললে, যে ইতিহাসের বয়ানের মধ্যে বা প্রাধান্য বিস্তারকারী, যেটাকে আমরা হেজেমনিক বয়ান বলি, তার মধ্যে লেখক হিসেবে গড়ে ওঠা সেই বয়নটার কোনো বিচার আমরা করিনি।
দুই, সাংস্কৃতিক যে ঐতিহ্য হুমায়ূনের সময়ে জারি ছিল, তার নিরিখে হুমায়ূন নিয়ে কোনো কথা আমরা দেখি না। এই দুটি দিক ছাড়া আরো বিবেচনাযোগ্য দিক রয়েছে। আশা করি কনটেক্সচুয়ালাইজেশন করা বলতে কী বুঝিয়েছি, তা পরিষ্কার করতে পেরেছি। হুমায়ূন ‘পাঠ’ কথাটা এই কনটেক্সচুয়ালাইজ করা অর্থেই বলেছি। এটা আমাদের এখানে হয়নি। এর জন্য শুধু সাহিত্যের একাডেমিক বা অধ্যাপকীয় সমালোচনাই যথেষ্ট নয়। এর জন্য ঐতিহাসিক পর্যালোচনার রাজনৈতিক-সামাজিক বিবেচনা দরকার। সেই দিক থেকে হুমায়ূনের ভাগ্য খুব খারাপ বলতে হবে। তিনি ব্যাপক পাঠক পেয়েছেন, কিন্তু তার বিশাল কাজের কোনো কনটেক্সচুয়াল বা পাঠ-পর্যালোচনা দাঁড়ায়নি। চেষ্টাও দেখা যায়নি। আমরা হুমায়ূন নিয়ে ঘুরেফিরে মুখস্থ কিছু কথাবার্তা শুনি, এই যা।
হুমায়ূনকে ‘পাঠ’ করতে হলে এইসব দিক একইসঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। মনে হতে পারে, এ আর এমন কী! কথাটা এজন্যই জোর দিয়ে বলা দরকার। এতদিন হুমায়ূন নিয়ে আমরা যে আলোচনা দেখেছি, তাতে আগের দুটি বিষয় কমবেশি এসেছে। অর্থাৎ তার রচনার অন্তর্নিহিত বিষয় ও কনটেন্ট ধরে সমালোচকরা আলোচনা করেছেন। কিন্তু সেই আলোচনা দিয়ে হুমায়ূনকে বোঝার ক্ষেত্রে বহুমাত্রিক সমস্যা তৈরি হয়েছে। কারণ আমাদের এখানে সাহিত্যপাঠের যে ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা গড়ে উঠেছে, তার মধ্যে যে গভীর কুশিক্ষা, সেটার কোনো হদিস আমরা রাখিনি। ফলে হুমায়ূন-পাঠের জন্য ভূমিকা প্রস্তাবনার ওসিলায় এই জরুরি দিকটি সংক্ষেপে আলোচনা করতে হচ্ছে।
হুমায়ূন-পাঠে বাংলা সাহিত্যে যে ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা গড়ে উঠেছে, তাকে খতিয়ে দেখা হয়নি। এই প্রশ্ন না করলে হুমায়ূন পাঠ করার মূল সূত্রটিই আমরা ধরতে পারব না। ঐতিহাসিকভাবেই হুমায়ূনের পথটি এত আলাদা যে, তাবৎ সাহিত্য মূল্যায়নের ট্র্যাডিশন হুমায়ূনে এসে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। আমরা এতদিন সাহিত্য মূল্যায়নের যে চর্চা জারি রেখেছি, তা মূলত বঙ্গীয় রেনেসাঁ-প্রভাবিত। বাবুআনার রুচি ধরে এইটা তৈরি হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ তো সরাসরি এই রেনেসাঁ প্রকল্পের মধ্যে পড়ে না।
এর স্বাতন্ত্র্য এত স্পষ্ট হওয়া সত্ত্বেও আমরা ঔপনিবেশিক রুচির মধ্যেই বাংলাদেশের সাহিত্য বোঝার চেষ্টা করেছি। এই উপনিবেশ কিন্তু আবার সেকেন্ড-হ্যান্ড উপনিবেশ। এটাকে বলা যায়, সাবলেট কলোনিয়ালিজম। মানে কলকাতা পশ্চিমের রুচিমতো নিজেদের সাহিত্যরুচি তৈরি করছে। এর সঙ্গে সংস্কৃতি-জানা হিন্দুয়ানি গরিমা মিশাই দিছে। আর সেই ঠুলি দিয়া বাংলাদেশের সাহিত্য দেখা হইতেছে। নন্দনতত্ত্বের রাজনীতি নিয়ে অন্য এক লেখায় এগুলো বলেছি। আজ হুমায়ূনেই থাকি।
তো সেই দিক থেকে হুমায়ূন ঔপনিবেশিক সাহিত্য রুচির জন্য বিরাট হুমকি হিসেবে দাঁড়িয়েছেন। বিশেষ করে, আমাদের এখানে তথাকথিত ক্লাসিক সাহিত্যের যে ধারণা গড়ে উঠেছে, তা পশ্চিমা এনলাইটনমেন্টের প্রভাবেই গড়ে ওঠা। হুমায়ূন সচেতনভাবে এই প্রকল্পকে থোড়াই কেয়ার করেছেন। সেই কারণে হুমায়ূনকে সস্তা-বাজারি লেখক বললে আর কাজ হচ্ছে না। কোথায় তার লিটারেরি প্রকল্পটা, আলাদা তার হদিস না করলে আমরা হুমায়ূন বিচারে বড় ধরনের অবিচারই করে ফেলব। টীকা আকারে এতটুকুই আপাতত।
হুমায়ূন পাঠের ক্ষেত্রে আমরা যে ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা অবলম্বন করেছি, তা আমাদের জন্য আত্মঘাতী হয়ে উঠেছে। আমি হুমায়ূন নিয়ে আমাদের এখানে যে সকল আলোচনা ইতোমধ্যে হাজির হয়েছে, তার দিকে নজর রাখার চেষ্টা করেছি এবং এ সকল আলোচনার কোনোটাই এখন পর্যন্ত হুমায়ূনের মূল শাঁসটা বা নাড়ি বা অন্তর্গত পালস্ ধরতে পারেনি। এজন্য তাদের দোষারোপ করার কোনো যুক্তি নেই। কারণ হুমায়ূনপাঠের জন্য তারা যে টেক্সচুয়াল এবং কনটেক্সচুয়াল পথ অনুসরণ করেছেন, তা দিয়ে তারা যথারীতি অনেক গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক মতামতের অবতারণা করে ফেলেছেন। কিন্তু হুমায়ূন যে তাদের এত দিনের অনুসরণীয় কনটেক্সচুয়ালের বাইরের লেখক, তা তারা ঠিক ঠিক ঠাওরে উঠতে পারেননি।
ফলে সাহিত্যিক আলোচনার জন্য যে ঐতিহাসিক সিলসিলা বা ভাবধারা দ্বারা এই সকল পণ্ডিতকুল তাড়িত, হুমায়ূন সেই পথ থেকে শত মাইলের দূরত্বে থাকেন। এতে করে তাকে গড়গড় করে পড়েও আমরা তার ‘পাঠ’ দাঁড় করাতে পারিনি। এইবার আমরা দেখব হুমায়ূনকে নিয়ে আমাদের সাহিত্যপাড়ায় কী কথা হয় এবং তার সঙ্গে হুমায়ূনের ফারাক কতখানি?
ট্র্যাডিশনাল সাহিত্যের আলোচনায় হুমায়ূন সম্পর্কে অনিবার্যভাবে উচ্চারণ করা হয়, হুমায়ূন জনপ্রিয় লেখক। আরো বলা হয়, তিনি পাঠকপ্রিয় লেখক, প্রকাশনা ব্যবসায় বিপ্লব এনেছেন, পাঠক তৈরিতে ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছেন, বাংলাদেশের সাহিত্যের বাজার থেকে পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের একচেটিয়া প্রভাব প্রায় একাই হটিয়ে দিয়েছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে, এ সকল কথাবার্তার কোনোটাই হুমায়ূনকে বোঝার ক্ষেত্রে আমাদের কাজে আসে না।
হুমায়ূন আলোচনার জন্য তারা যেসকল প্রশ্ন বা প্রসঙ্গ সামনে আনেন, তা হুমায়ূনের যে ঐতিহাসিক কনটেক্সট সেদিক থেকে খুবই গৌণ। কারণ তারা হুমায়ূনের ঐতিহাসিক পটভূমি কখনো তালাশ করার চেষ্টা করেননি। তাই হুমায়ূন আলোচনায় তাদের খেই হারানো ভাবটা লুকাতে তারা হুমায়ূনকে বাজারি লেখক আখ্যা দিয়ে পাশ কাটিয়ে যেতে চান। তাকে হালকা চালের লেখক বলে সাহিত্যেও একটা ‘এলিটিজম’ খাড়া করে হুমায়ূনের ব্যাপারে পাহাড়প্রমাণ মূর্খতাকে পণ্ডিতি বলে চালিয়ে দেন। ফলে এত আবর্জনার ভেতর হুমায়ূনপাঠের একটা ধরন বের করা খুবই কষ্টকর কাজ সন্দেহ নেই।
এখন আমরা দেখব কেন ‘হুমায়ূনপাঠ’ এতদিনেও দানা বাঁধেনি।
হুমায়ূনপাঠের জন্য বাংলাদেশ ও ভারতে অভিন্ন যে ডমিনেন্ট সাহিত্যরুচি দাঁড়িয়ে গেছে, তা সবচেয়ে বড় বাধা। এই সাহিত্যরুচি মোটা দাগে ঔপনিবেশিক। ফলে আলাদা করে যখনই আমরা হুমায়ূনের ‘পাঠ’ নির্মাণের দিকে এগোব, সঙ্গে সঙ্গে ধসে পড়বে কলোনিয়াল আধুনিক সাহিত্যরুচি। এই কলোনিয়াল সাহিত্যরুচির জন্য হুমায়ূন বিপদ আকারে হাজির হয়েছেন। তাই হুমায়ূনের বিশাল পাঠক থাকা সত্ত্বেও ক্যালকেশিয়ান এলিট পারোকিয়াল সাহিত্যধারা হুমায়ূনকে প্রতিনিয়ত তাচ্ছিল্য করে চলেছে।
অন্যদিকে আরো কিছু বিপত্তি আছে, তাও একটু একটু করে আলোচনা করা হবে। আমাদের এখানে কোনো লেখককে আমরা যেসব কোয়ালিটির জন্য নমস্য বিবেচনা করি, হুমায়ূন সচেতনভাবে সেগুলোকে নিজের লেখালেখির এলাকা থেকে বিদায় করেছিলেন। যেমন লেখায় ভীষণরকম একটা মতাদর্শ থাকতে হবে। চরিত্রগুলোকে হতে হবে খুবই আদর্শিক। ভাষা হবে ঠাস-বুনট, উপন্যাসের ক্ষেত্রে থাকতে হবে মহাকাব্যিক দ্যোতনা ইত্যাদি। এককথায় আমাদের সাহিত্যিক রুচি ভীষণরকম ধর্মতাত্ত্বিক। কারণ উনিশ শতকের বাঙালি রেনেসাঁই আমাদের রুচি তৈরি করেছে, এরা এসেছে সরাসরি ইউরোপের প্রোটেস্টান্ট রুচি থেকে। সেই অর্থে ধর্মতাত্ত্বিক। ফলে হুমায়ূন সবসময়ই এখানকার তথাকথিত প্রগতিশীলতার নামে মৌলবাদী সাহিত্যিক-আলোচকদের দ্বারা আক্রমণের শিকার হয়েছেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো যারা হুমায়ূনকে গালি দিতেন, তারাও হুমায়ূনের নতুন বই পড়ার জন্য মুখিয়ে থাকতেন। হুমায়ূন পড়তেন গোপনে আর প্রকাশ্যে করতেন গালাগালি। তাদের সাহিত্যিক এলিটিজম হুমায়ূনকে হজম করতে পারত না। কিন্তু হুমায়ূনের আকর্ষণ এড়ানোও তাদের পক্ষে সম্ভব হতো না। আমরা যদি এতদিন নিজের কাছে এই প্রশ্নটাও করতাম—‘আমি কেন হুমায়ূন পড়ি,’ তাহলেও হুমায়ূনের ব্যাপারে যে কুসংস্কার তৈরি হয়েছে, তা এত পর্বতসমান হতো না।
আমরা যদি নিজেদের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী হতে পারি, তাহলে এতসব আলোচনা-সমালোচনার তোয়াক্কা না করে ঘোষণা দিতে পারতাম—আমি হুমায়ূন পড়ি এবং এই কারণেই হুমায়ূন জরুরি। এই ‘আমি’ মানে পূর্ব বঙ্গের ‘আমি’। হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে এখানকার তাবৎ লেখকদের সঙ্গে যে জায়গাটায় সবচেয়ে বড় ফারাক, তাকে এককথায় ‘আমি’র ফারাকও বলা যায়। আধুনিক বা আধুনিক-উত্তর চিন্তায় আচ্ছন্ন লেখকের কাছে ‘আমি’ মানে একক। তাদের কাছে ‘আমি’ কেবল ইনডিভিজুয়ালের আইডেন্টিটি মাত্র। ফলে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি হুমায়ূনের সঙ্গে এসে যেখানে মার খায় তা হলো, লেখক মাত্রই ইনডিভিজুয়াল চরিত্র সৃষ্টি করেন, কিন্তু হুমায়ূনের ‘আমি’ কোনোভাবেই পশ্চিমা আধুনিকতার আছর-পড়া ইন্ডিভিজুয়াল আমি না। তার ‘আমি’ হলো বাংলার চিন্তার ভেতর থেকেই উঠে আসা।
আর হুমায়ূন বলেন, ‘আমি’ আমার কিছু অপছন্দের শব্দের একটি। আমরা পৃথিবীতে যখন বাস করতে আসি, তখন ‘আমি’র সঙ্গে যুক্ত হয় সন্তান, স্ত্রী, বন্ধুবান্ধব, স্বজন। জন্মের আগে এবং মৃত্যুর পরে ‘আমি’ বলে কিছু থাকলেও থাকতে পারে; কিন্তু জীবিত অবস্থায় ‘আমি’ বলে কিছু নেই।’ (আমি, হুমায়ূন আহমেদ, অন্য প্রকাশ, ২০১১)
এটা সমষ্টির ‘আমি’ এবং সে এখনো নিজের সম্পর্কে সচেতন হয়নি। তার এখনো চৈতন্যপ্রাপ্তি ঘটেনি। বাংলার চিন্তাভূমিতে যে দার্শনিক তর্কটা অতি জরুরি—মানুষ একই সঙ্গে বিশেষ এবং সামান্য। এই বিশেষ বা সামান্যকে ধরার জন্য আধুনিক ‘আমি’র নিরাকরণ ঘটাতে হয়। এই দিক থেকে হুমায়ূন বাংলার চিন্তামূলের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত।
আলোচনা করছিলাম আমাদের সাহিত্যিক রুচিটা ধর্মতাত্ত্বিক। এই ধর্মতত্ত্বের বয়ানও দাঁড়িয়েছে পরদেশি যাজকদের বয়ানের মারফতে। ফলে এর প্রতি আমরা এতদিন যে প্রশ্নহীন অবস্থানে ছিলাম, তা নতুন করে আর ব্যাখ্যা করছি না। তবে হুমায়ূনপাঠের সরাসরি ফজিলত হলো, এটাকে সমূলে উপড়ে ফেলার কাজটা সহজ হয়ে যায়। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকে আবার যদি শুধু সাহিত্যের ইতিহাস আকারে দেখি, তাহলে সেই দেখাটাও আংশিক দেখা হবে, এর সঙ্গে ইতিহাস নির্মাণের প্রশ্নটা সরাসরি জড়িত। আমাদের আত্মপরিচয়ের প্রশ্নটা ডাইরেক্ট জড়িত। এই আত্মপরিচয়ের যে অলিখিত ন্যারেশন বাংলাভূগোলে ছড়িয়ে আছে, তাকে আধুনিক সাহিত্যরুচির শাসনকে থোরাই কেয়ার করে হাজির করার যে ক্যারিশমা হুমায়ূন দেখিয়েছেন, তাকে আমি বিপ্লবী প্রচেষ্টা আকারে দেখছি। এটা আবিষ্কার করার জন্য আমাদের যে ধরনের জ্ঞানগত প্রস্তুতি নিয়ে সাহিত্যের দিকে তাকানো দরকার, তার কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। এটা অতি আফসোসের কথা। হুমায়ূন পাঠের সময় একটু খেয়াল করে বাংলার জনগোষ্ঠীর আত্মপরিচয়ের প্রশ্নটা এখন মাথায় রাখলে নতুন অর্থ তৈরি হতে থাকবে। আর সাহিত্য বিচারের পুরোনো অচলায়তনটাও ভাঙতে থাকবে বলে মনে হয়।
(শেষ পর্ব আগামী সংখ্যায়)

গত ২ নভেম্বর উদ্বোধন করা হলো মহান মিসরীয় জাদুঘর, যেখানে ৭৯টি দেশের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। এই অনুষ্ঠানে প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতা, ঐতিহ্য এবং বর্তমান সময়ে এর স্থায়ী প্রভাব প্রদর্শন করা হয়। গিজা পিরামিডের পাশে অবস্থিত মহান মিসরীয় জাদুঘর উদ্বোধন উপলক্ষে সেদিন সরকারি ছুটি ঘোষণা করেছিল মিসর।
১ ঘণ্টা আগে
১০ নভেম্বর, সোমবার লন্ডনে হাঙ্গেরীয়-ব্রিটিশ লেখক ডেভিড সালাই-এর ষষ্ঠ উপন্যাস ‘ফ্লেশ’কে ২০২৫ সালের বুকার পুরস্কারজয়ী হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সালাই পুরস্কার হিসেবে পেয়েছেন ৫০,০০০ পাউন্ড বা প্রায় আশি লাখ টাকা এবং একটি ট্রফি।
১ ঘণ্টা আগে
এথেনাকে প্রথম দেখেছিলাম বড় অদ্ভুত সময়ে। সারা দিনের রোদ শেষে মিঠেল হাওয়ার অপরাহ্ণে। আমাদের ছোট্ট পুরোনো বাড়ির উত্তর পাশে বিহারি পট্টি। সেখানে সিরাজগঞ্জের একজন ডেভেলপার দশতলা ফ্ল্যাট অ্যান্ড কমার্শিয়াল সেন্টার নির্মাণ করছে। তখন ফোর্থ ফ্লোর পর্যন্ত ফিনিশিং হয়ে বিল্ডিং উঠেছে আরো দুতলা।
২ ঘণ্টা আগে
সাহিত্য আমাদের চিন্তার বাহন; কিন্তু সে বাহনমাত্র নয়। সাহিত্য এক প্রক্রিয়া, গতি, যা চিন্তাকে তার উৎসের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায়। সাহিত্য যে উপাদানগুলোর সমন্বয়ে গঠিত, সেগুলোকে যদি বিশ্লেষণ না করা হয়, তবে সাহিত্য শুধু প্রকাশের মাধ্যম হয়ে থাকবে, আত্ম-অনুসন্ধানের পথ রচনা করবে না।
২ ঘণ্টা আগে