খুব সম্ভব মানুষের জ্ঞান অতীতকালে এক অভিজ্ঞতা রূপেই দেখা দিয়েছিল। এতে ধর্ম, দর্শন ও বিজ্ঞান একত্রে জড়িত ছিল। জ্ঞানের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গেই এ তিনটি ধারা সম্পূর্ণ পৃথক হয়নি। বহুদূর অগ্রসর হওয়ার পরই এ তিনটি ধারা পরস্পর থেকে বিছিন্ন হয়ে যায়। তখন থেকেই ধর্মীয় সত্যগুলো স্বজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত হয়। বিজ্ঞান অভিজ্ঞতা ও তার্কিক বুদ্ধির ওপর হয় নির্ভরশীল এবং দর্শন, ধর্ম ও বিজ্ঞানের আবিষ্কৃত সত্যগুলোর মধ্যে সমঝোতা সৃষ্টির চেষ্টা করে।
ধর্মের বিশেষত্ব এই যে, এতে আবেগের থাকে প্রাধান্য। ধর্ম ও দর্শনের মূল্যমানগুলোর মধ্যেও রয়েছে বিশেষ পার্থক্য। দার্শনিক মূল্যমান প্রত্যক্ষভাবে মানুষের মনে কর্মের কোনো প্রেরণা সৃষ্টি করে না। দর্শনের মূল্যমানের প্রকৃতি হচ্ছে চিন্তা ও বুদ্ধিকে পরিচ্ছন্ন করা। ধর্মের প্রতিটি মূল্যমান জীবনকে নানবিধ আশা-আকাঙ্ক্ষায় সঞ্জীবিত করে এবং তার অনুসারীদের চরিত্র গঠন করে। ধর্মের ধারণাগুলো কেবলমাত্র ধর্মীয় গ্রন্থাবলিতেই সীমাবদ্ধ নয়। নানাবিধ কথিকায়, ছড়া ও কাব্যেও তাদের প্রকাশ করা হয়েছে। সমগ্র মধ্যযুগে ধর্ম ও কাব্য ছিল ওতপ্রোতভাবে বিজড়িত। এতে দর্শনেরও নানাবিধ তত্ত্ব ছিল প্রচ্ছন্নভাবে প্রকাশিত। কবীর, রজ্জব, দাদু প্রভৃতি সাধু-সন্ন্যাসীদের দার্শনিক যেমন বলা যায়, তেমনি কবিও বলা যায়।
আলোচ্য কবিও এরূপ ব্যক্তি ছিলেন। যদিও তার জন্ম আধুনিক যুগেই হয়েছিল, তবু তার চরিত্রে ছিল মধ্যযুগীয় ভাবধারার ছাপ। তিনি ছিলেন সত্যের অন্বেষণে নিবেদিতপ্রাণ এক অসাধারণ মানুষ। তবে আধুনিক যুগে তিনি তার চিন্তার বিকাশের অনুকূল কোনো পরিবেশ পাননি। এজন্যই তিনি তার আত্মার গভীরে প্রবেশ করে, জীবন ও সত্তার অর্থ আবিষ্কারে ছিলেন রত। যদিও তিনি নিজে হয়তো এ সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন না, তার মুসলিম পূর্বপুরুষদের ধারণা তার মগ্ন চেতনায় ছিল ক্রিয়াশীল। এসব ধারণার সঙ্গে এ দেশীয় হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের ধারণাও এসে যুক্ত হয়েছিল। এগুলো ব্যতীত তার নিজস্ব ধারণাও ছিল অনন্য।
তাকে অনেকেই ‘বাউল’ বলে ভুল করে থাকেন। প্রায় ৪০ বছর পূর্বে ‘বিশ্ব ভারতী’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে পরলোকগত পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন সেন শাস্ত্রী তাকে বাউল বলে আখ্যায়িত করে একটি বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছেন। বাউল শব্দের উৎপত্তি নিয়ে নানা বাগ্বিতণ্ডার সৃষ্টি হয়েছে। কেউবা একে সংস্কৃত বাতুল শব্দের অপভ্রংশ বলেই মনে করেন। আবার কেউবা একে বৌদ্ধদের ‘বজ্রযান’ শব্দের অপভ্রংশ মনে করেন। যা থেকেই বাউল শব্দের উৎপত্তি হোক না কেন, বর্তমানে বাউল একটি মতবাদে পরিণত হয়েছে এবং বাউলদের মধ্যে নানা শাখার উৎপত্তি হয়েছে। এসব শাখার প্রত্যেকটিরই এক-একজন আদি পুরুষ রয়েছেন। কোনো শাখার আদি পুরুষ কবীর, কোনো শাখার আদিতে রয়েছেন জগমোহন। এজন্য এদের বলা হয় কবীরপন্থি বা জগমোহনী। হাছন রাজা এরূপ কোনো বাউল শাখার অনুসারী কস্মিনকালেও ছিলেন না। কাজেই তাকে বাউল বলে আখ্যায়িত করা সত্যের অপলাপ ব্যতীত কিছুই নয়।
হাছন রাজা তার নানাবিধ গানে নিজেকে নানাবিধ নামে আখ্যায়িত করেছেন। কোনো সময় তাকে তিনি বলেছেন ‘বাউল’, কোনো সময় ‘আশিক’ আবার কোনো কোনো সময় তাকে ‘পাগল’ও বলেছেন। তার এ নাম গ্রহণের জন্য তাকে ‘বাউল’ বললে সঙ্গে সঙ্গে ‘আশিক’ ও ‘পাগল’ বলতে হয়। কাজেই এসব নাম গ্রহণ থেকে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায় না।
অপরদিকে হাছন রাজা যৌবনেই সৈয়দ মাহমুদ আলী বলে পাঞ্জাব থেকে আগত চিশতিয়া তরিকার এক দরবেশের কাছে মুরিদ হয়েছিলেন। এ দরবেশ সিলেট শহরের অদূরবর্তী রণকেলি নামক গ্রামে স্থায়ীভাবে বাস করার পর সেখানেই ইন্তেকাল করেন।
হাছন রাজার কাব্যজীবনের সূত্রপাত হয় মুমিনরূপে। ক্রমবিকাশের ধারায় তিনি মরমবাদে গিয়ে পৌঁছেন। এ কথা অবশ্য সত্য যে, তিনি মাঝে মাঝে শরিয়তের শুষ্ক দিক নিয়ে তামাশা করেছেন এবং কোনো কোনো শরিয়তের আইন-কানুনকে অস্বীকারও করেছেন। তবে হয়তো পর মুহূর্তেই তিনি মুমিনের জীবনকেই মানব জীবনের আদর্শ বলে গ্রহণ করেছেন। শরিয়ত তথা মোল্লাতন্ত্রের বিরুদ্ধে তার এসব আঘাতকে তাই সহানুভূতিশীল ডাক্তারের শৈল্যচালনার সঙ্গে তুলনা করা যায়। একে গুপ্তঘাতকের অস্ত্রের আঘাত বলা যায় না। তার রচনার মধ্যে হিন্দুদের নানাবিধ দেব-দেবীর বন্দনা রয়েছে। তিনি দেবী কালীকে বা রাধাকৃষ্ণকে কোনো কোনো গানে আহ্বান ও আরাধনা করেছেন। তবে এগুলোকে তিনি রূপক হিসেবে গ্রহণ করেছেন। কারণ তার চিন্তাধারায় মূল সুরটি আগাগোড়াই ছিল ইসলামি।
ইসলামি কালচারের বিশেষত্ব হচ্ছে তার আত্মমুখীনতা (Subectivism)। অন্যান্য কালচার থেকে এখানেই ইসলামি কালচার সম্পূর্ণ ভিন্ন। ইতিহাসের আলোচনা করলে দেখা যায় বৈদিক ধর্মের গোড়ার কথা হচ্ছে ব্রহ্মসতা, জগৎ মিথ্যা। ব্রহ্মজ্ঞান বিষয়মুখী জ্ঞান (Objective)। ব্রহ্মের সঙ্গে মানব আত্মার অচ্ছেদ্য সম্বন্ধ গতিকে মানবাত্মার সম্বন্ধে জ্ঞানও প্রয়োজনীয়।
ব্রহ্মজ্ঞানের অনুসিদ্ধান্ত হচ্ছে আত্মানামবিধি। ইসলামি কালচারের মর্মকথা হচ্ছেÑ‘মন আরেফ, নফসুস্থ ফকদ আরেফ, রব্বহু’ যে তার সত্তাকে জেনেছে সে তার রবকে (সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা ও বিবর্তনকারীকেও) জেনেছে। ইসলামে আত্মজ্ঞান সৃষ্টিকর্তার জ্ঞানের পূর্ববর্তী পর্যায়ে দেখা দেয়। অন্যদিক থেকেও বিচার করলে দেখা যায়, বৈদান্তিক ধর্মের কোনো কোনো শাখার ব্যাখ্যায় আধ্যাত্মিক সাধনার সর্বশেষ পর্যায়ে পরমাত্মার মধ্যে জীবাত্মার লয়কেই কামনা করা হয়েছে। শংকরাচার্যক বেদান্ত ভাষ্যের সংজ্ঞানুসারে চরম স্তরে জীবাত্মার কোনো অস্তিত্বই থাকে না। ইসলামি সাধনার কোনো শাখার জীবাত্মার বিলোপ লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়নি। এ সম্বন্ধে ইসলামি সংস্কৃতির বিকাশের আলোচনা করলে দেখা যায়, জীবাত্মার স্থিতি ও প্রাধান্যের ভিত্তিতেই যুগে যুগে মুসলিম সাধক ও মনীষীরা নানাবিধ উক্তি করেছেন। মনসুর হাল্লাজ এ নীতির ভিত্তিতেই বলেছেন ‘আনাল হক’ (আমিই সত্য), বায়েজিদ বলেছেন ‘সুবহানি’ (আমিই পবিত্র), ইবনুল ফরীদ বলেছেন ‘আনা হিয়া’ (আমিই সেই সুন্দরী নারী), যাকে এই দুনিয়া কামনা করে। জালালউদ্দিন বলেছেন, আমার সত্তা থেকে বিশ্বের সবকিছুর উৎপত্তি। এ কালচারের ঢেউ আমাদের দেশে এসে লেগেছিল। তাই লালন শাহ বলেছেন, ‘এই মানুষে আছেরে মন যারে বলে মানুষ রতন’। হাছন রাজাও এদেরই ধারায় অগ্রসর হয়ে বলেছিলেন, ‘আমি হইতে সর্বোৎপত্তি হাছন রাজায় কয়।’
ইসলামি কালচারের এ ধারা থেকে হাছন রাজা পৃথক হননি বলে তাকে ইসলামি কালচারেরই এক নতুন ধারার প্রবর্তক বলে গণ্য করা যেতে পারে। যদিও মাঝে মাঝে তার মানসে বিষাদের কালো ছায়াপাত হয়েছে এবং মহাকবি হাফিজের মতোই তিনি তকদিরকে জীবন পথের নিয়ামক বলে গ্রহণ করেছেন, এবং রূজ-ই-আলস্তই এর জন্য দায়ী বলে মৃদু ভর্ৎসনার সুরে তার বক্তব্য পেশ করেছেন, তবু কোনো অবস্থায়ই তিনি আত্মার বিলুপ্তি কামনা করেননি। হাছন রাজার পর এ উপমহাদেশে ইসলামের সে নীতি অনুসরণ করে মহাকবি ইকবাল ও বিদ্রোহী কবি নজরুল মানবাত্মার চরম জয় ঘোষণা করেছেন। তকদির ও রুজ-ই-আলস্তকে স্বীকার করে মহাকবি হাফিজ ছিলেন আশাবাদী। হাছন রাজার সুরে কিন্তু জাবারিয়াদের মতো মাঝে মাঝে নিরাশবাদের সুরও ফুটে উঠেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিনি বৌদ্ধদের মতো নির্বাণও কামনা করেছেন। হাছন রাজার দার্শনিকতাবাদ বুঝতে হলে তার চিন্তাধারার বিকাশের সূত্র অবলম্বন করে যাত্রা আরম্ভ করতে হবে।
মানস চিন্তার সূচনায় হাছন রাজা ছিলেন একজন খাঁটি মুমিন। তার এ ভাব প্রকাশ পেয়েছে তার মহান আকর্ষণকারী আবাহনে :
মুমিন আরে ভাই ঈমান রাখিও দড়
ঈমান না থাকিলে মুমিন কীসের
নামাজ পড়
ও ঈমান রাখিও দড়।
এক আল্লা বিনে যে শরিক নাহি তার
লা-শরিক জানিলে মুমিন হইবায় উদ্ধার
ও ঈমান রাখিও দড়।
অপর এক সময়ে শরিয়তের নির্দেশের ওপর তার প্রগাঢ় ভক্তি ও আস্থা প্রকাশ পেয়েছেÑ
এই মতে নামাজ যে পড়িবে ভাই-নিশ্চয়ই জানিও তার বেহেশতে হবে ঠাঁই-নামাজ পড়, রোজা রাখ, কর এবাদত মুমিন মুসলমান ভাই এ মূল পথ হাছন রাজা সালাম দেয় নামাজি সব ভাই নামাজ রোজাও ছাড়িও না আল্লার দোহাই মুই গুনাগারের প্রতি দোয়া করিও ভাই।
আশিক হাছন রাজা যেন আল্লার দিদার পাই।
এতে স্পষ্টই প্রমাণ হয়, তিনি তার প্রভুর বদন-চন্দ্রিমা অবলোকন করার জন্যই ব্যস্ত। প্রার্থনা তার কাছে লক্ষ্য নয়, মাধ্যম মাত্র। এ সময় রোজ হাশরে তার জন্য কোনো স্থান নির্দেশিত হয়Ñএ ভাবনায়ই তিনি ব্যাকুল, এজন্য তিনি ভীষণ যন্ত্রণায় কাঁদছেন :
কী হবে মোর হাশরের দিন ভাই মুমিন। মুমিন হায়রে কী হইবে মোর হাশরের দিন।
এক্ষেত্রেও মুসলিমদের ঐতিহ্যগত প্রত্যয় থেকে তিনি একটু সরে পড়েছেন। তার প্রাথমিক বাসনা বেহেশতে কোনো আসন লাভে পর্যবসিত নয়। দোজখের সে অবিচ্ছিন্ন শাস্তির ভয়েও তিনি ভীত নন; তার একমাত্র কামনাÑতার প্রভুর সন্নিকটের একটি আসন লাভ। প্রার্থনায় তিনি যেসব উপমা ব্যবহার করেছেন, তাদের প্রচলিত দর্শনের ভাষায় নরাত্মারোপ বলা যেতে পারে।
বাকি অংশ আগামী সংখ্যায়
আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

