সাহিত্যবিশারদ: কৃতি ও জীবনদৃষ্টি

আহমদ শরীফ
প্রকাশ : ১৬ অক্টোবর ২০২৫, ১৯: ০২

ব্রিটিশের প্রচারণার বদৌলত কিনা জানিনে, বাঙালি হিন্দুরা যখন ইংরেজি শিক্ষার আলো পেয়ে মৃত মুসলিমের-মরা হাতি তুর্কি-মুঘলের নিন্দাবাদে মুখর ও বিদ্বেষ-বিষ ছড়িয়ে কৃতার্থমন্য, তুর্কি-মুঘলের জ্ঞাতিত্ব গৌরব-গর্বী স্বল্পশিক্ষিত মুসলিম লিখিয়েরা তখন হীনমন্যতার লজ্জা গোপন করবার অপচেষ্টায় ভারতের সীমা অতিক্রম করে মরুভূ আরব, ইরান ও মধ্য এশিয়ার গলি-গুঁজিতে অতীত কৃতি ও কীর্তি সন্ধান-সুখে আত্মগ্লানি মোচনে নিষ্ঠ। হিন্দুরাও তখন আত্মমহিমার সন্ধানে প্রাচীন আর্যাবর্তে, উত্তর ভারতে, রাজপুতনার মরুতে এবং মারাঠা অঞ্চলে মানস পরিক্রমায় নিরত।

বিজ্ঞাপন

তখন কেউ সুস্থ ছিল না। যে-মাটির লালনে তারা মানুষ, সে-মাটির দিকে, তার মানুষ ও প্রকৃতির দিকে দৃষ্টি দেবার প্রয়োজন-চেতনা যেন ছিল না কারো। তখন হিন্দু শিক্ষিত হয়ে আর্য হচ্ছে, মুসলমান বিদ্যার্জন করে আরব-ইরানি বনে যাচ্ছে-বাঙালি থাকছে না কেউই। বাঙালি থাকা যেন অন্ত্যজ হওয়ার মতোই বড় লজ্জার অথবা বাংলাদেশ যেন তাদের প্রবাসের বাসা। অন্ধ আভিজাত্য-গৌরবে ও কৃত্রিম স্মৃতিচারণায় তখন মিথ্যা তৃপ্তি খুঁজছে হিন্দু ও মুসলমান শিক্ষিত বাঙালি। নবপ্রবুদ্ধ শিক্ষিত বাঙালি-সমাজের প্রায় সবারই মন-মেজাজ যখন এক আদর্শিক জাতীয়তাবোধের মউজে মশগুল, তখন আবদুল করিমের আবির্ভাব বাঙলার লিখিয়ে সমাজে। সাহিত্য-ক্ষেত্রে তাঁর বিচরণ সাহিত্যিক হিসেবে নয়-সাহিত্যের সেবকরূপেই। তিনিও ছিলেন গৌরব-সন্ধানী। সাহিত্যের অঙ্গনে তাঁর পদচারণাও ছিল গৌরবগর্বের সম্পদ সন্ধানে। তবে পার্থক্য এই যে, তিনি স্বধর্মীর স্বাজাত্যে আস্থাবান ছিলেন না, তাই ধর্মীয় জাতীয়তার টানে তিনি স্বদেশের সীমা অতিক্রম করতে রাজি ছিলেন না। স্বদেশের মাটি ও মানুষকে ভালোবেসে-স্বদেশের মাটি ও মানুষের পরিচয় জেনে তিনি তৃপ্ত ও কৃতার্থ হতে চেয়েছিলেন।

১৯২০ সনে সাহিত্য-ক্ষেত্রে কাজী নজরুল ইসলামের উপস্থিতির পূর্বমুহূর্ত অবধি সম্ভবত আবদুল করিমই একমাত্র মুসলিম লিখিয়ে, যাঁর সাম্প্রদায়িক ভেদ-বুদ্ধি ছিল না। হিন্দুর মধ্যেও তখন চার-ছয়জনের বেশি দুর্লক্ষ্য। ইংরেজ শাসকের প্রবর্তনায় উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই প্রাচীন সহিত্যের উদ্ধারকার্য শুরু হয়েছে, কিন্তু রাজেন্দ্রলাল মিত্র থেকে শুরু করে সাম্প্রতিককালের সংগ্রাহক অবধি কেউ মুসলিম ঘরে অযত্নে বিলীয়মান পুঁথি সংগ্রহ-সংরক্ষণে আগ্রহী হন নি। তাঁরা গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরে ঘুরে পুঁথির সন্ধান করেছেন বটে, কিন্তু মুসলিম ঘরে উঁকি মেরে দেখার গরজ বোধ করেন নি। অথচ পল্লীতে হিন্দু-মুসলিম প্রায় পাশাপাশি ঘরেই বাস করে-শহরে বাস করে ঘেঁষাঘেঁষি গৃহে।

আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদই এক্ষেত্রে প্রথম মানুষ, যিনি হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকলের ঘরে হানা দিয়ে বাঙালির কৃতি ও কীর্তির নিদর্শন-লুপ্তপ্রায় সাহিত্য-সম্পদ কালের কবল থেকে মুক্ত করতে আত্মোৎসর্গ করেছিলেন। বিদেশীর বংশোদ্ভূত উর্দুভাষী সামন্ত নেতাদের প্রচারণায় ও প্ররোচনায় দেশজ মুসলমান যখন উর্দুকেই হৃত ‘মাদরীজবান’ বলে ভাবতে গৌরব বোধ করছে এবং বাংলাকে হিন্দুর ভাষা বলে অবজ্ঞাভরে পরিহার করবার প্রবণতা দেখাচ্ছে, তখন আবদুল করিমই বাঙালি মুসলিমকে এই আত্মবিনাশী মরীচিকা-মোহ থেকে উদ্ধার করেছেন বাংলা ভাষায় মুসলিম-রচিত সাহিত্যের সন্ধান দিয়ে।

তখন হিন্দু-মুসলিম সবাই সবিস্ময়ে দেখল এবং বুঝল দু’-দশ পরিবার ছাড়া বাঙালিরা দেশজ মুসলমান। তাদের মাতৃভাষা চিরকালই বাংলা। পাঁচশ’ বছর ধরে অর্থাৎ যখন থেকে বাংলায় লিখিত সাহিত্য-সৃষ্টির শুরু, তখন থেকেই হিন্দুর মতো মুসলিমরাও তাদের মনের কথা, ভাবের কথা, রসের কথা বাংলায় রচনা করছে ও পড়ে-শুনে আস্বাদন করছে। এই প্রথম একালের বাঙালি মুসলিম চোখ তুলে তাকাল নিজের দিকে ও নিজের ঘরের পানে। তাকিয়ে দেখল, সে রিক্ত নয়, নিঃস্ব নয়, এদেশে প্রবাসী নয়। ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, সাহিত্য, কীর্তি, গৌরব, সম্পদ, সভ্য মানব-কাম্য সবকিছুই রয়েছে তার। আরব-ইরান-মধ্য এশিয়ায় কিংবা উত্তর ভারতে, রিকথের সন্ধানে আওয়ারা হয়ে এতিমের মতো ঘুরে বেড়াবার প্রয়োজন নেই তার। পিতৃ-পুরুষের ধনে সে ঋদ্ধ, পিতৃ সম্মানে সে সম্মানিত, দৈশিক মর্যাদায় সে মর্যাদাবান। বাঙালি মুসলিমের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে, তাদের আরব-ইরানমুখীতা নিবারণে, তাদের স্বচ্ছ ও সুস্থ মন-বুদ্ধি গঠনে আবদুল করিমের সাধনা গভীর ও ব্যাপকভাবে সহায়ক হয়েছে। এভাবে বাঙালি মুসলিম নিজেদের মধ্যে দৈশিক জাতীয়তাবোধ জাগ্রত করার একটা Locus standi বা অবলম্বন পেল। উর্দু-বাংলা বিতর্ক হ্রাস পেল। যদিও তা ক্ষীণভাবে প্রায় ১৯২৫-৩০ সন অবধি চলেছে।

দুই.

১৮৭১ সনে তাঁর জন্ম। লিখিয়ে হিসেবে কলম ধরেন ১৮৯৪ সনে এবং ১৯৫৩ সনের ৩০ সেপ্টেম্বর তিনি মৃত্যুর পূর্বক্ষণে ত্যাগ করেন সে-লেখনী। সুদীর্ঘ ষাট বছর ধরে তিনি পুঁথি সংগ্রহে-সংরক্ষণে, পরিচিতি সংকলনে, সম্পাদনায় ও সমালোচনায় নিরত ছিলেন। ইবাদতের মতো এই নিষ্ঠা, এই সাধনা, এই আত্মোৎসর্গ বিরলতায় বিশিষ্ট।

জীবন নিয়েই সাহিত্য। জীবনকে দেখবার, জানবার ও বুঝবার জন্যেই রচিত হয় সাহিত্য। নিরবলম্ব আগুন যেমন নেই, সাহিত্যও তেমনি অস্তিত্ব পায় জীবনকে অবলম্বন করেই। আবদুল করিম এই সাহিত্য পাঠ করেই জীবনের সুদীর্ঘ তিরাশি বছর অতিবাহিত করেছেন। সাহিত্যেই মানবিকবোধ ও মানবতার প্রকাশ। মানুষের জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা, বিভিন্ন প্রতিবেশে মানুষের বৃত্তি প্রবৃত্তির বিচিত্র প্রকাশ ও বিকাশ সাহিত্যে তিনিও প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তাছাড়া তাঁর মন-মেজাজও ছিল কোমল ও প্রীতিপ্রবণ। এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই হয়তো সর্বপ্রকার সংকীর্ণতা ও অসূয়ার ঊর্ধ্বে এক সবল ও উদার জীবন-দৃষ্টি অর্জনের সহায়ক হয়েছিলো। নতুবা তিনি যে পরিবেশে জন্মেছিলেন এবং কৈশোর অবধি লালিত হয়েছিলেন, তা এমন মানুষ গড়ে উঠার পক্ষে অনুকূল ছিল না। যে গাঁয়ে তাঁর জন্ম, তা একটি সুপ্রাচীন ঐতিহ্য-সমৃদ্ধ গ্রাম। সুচক্রদণ্ডী নামটাও সংস্কৃত এবং প্রাচীন। গাঁটি হিন্দু-অধ্যুষিত-ব্রাহ্মণ-বৈদ্য ও কায়স্থের গাঁ। আর আনুষঙ্গিক কারণে দু'-এক ঘর নাপিত, ধোপা ও হাঁড়ি। আর মূলত পাঁচটি মুসলিম পরিবার।

গাঁয়ের হিন্দুদের প্রায় সবাই মধ্য ও নিম্নবিত্তের এবং একটি মাঝারি গোছের নতুন জমিদার পরিবার। কিন্তু ইংরেজি শিক্ষা চালু হয়ে গেছে, পটিয়া ইংরেজি বিদ্যালয় গাঁয়ের প্রান্তেই প্রতিষ্ঠিত। মুসলিম পরিবারগুলোর মধ্যে আবদুল করিমের পরিবারে লেখাপড়া পুরুষানুক্রমে চালু ছিল বটে, তবে উচ্চ শিক্ষা ছিল না কারো। তাঁর চাচা (জন্ম ১৮৪০ খ্রিঃ) থেকেই সরকারি অফিসে চাকরির শুরু। দুই পুরুষ ধরে মুখ্যত কেরানি পরিবার। আর্থিক দিক দিয়ে সচ্ছল গৃহস্থ-দ্রৌন চারেক ধানী জমি আর দু'টো ছোট তালুক-হাজারখানেক টাকা বার্ষিক আয়, তবে সব উসুল হয় না। তাঁর যৌবনকালেই পরিবারের কর্তা চাচা মুন্সী আইনুদ্দীন নানা দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলায় জড়িয়ে পড়েন। এতে ঋণে ঋণে সম্পত্তি নিলামে গেল অধিকাংশ। ফলে পরিবার দরিদ্র হয়ে গেল এবং আবদুল করিমদের চাকুরিজীবীই হতে হলো। বলেছিলাম, পরিবেষ্টনীর প্রভাব তাঁর উদার সুজন হওয়ার অনুকূল ছিলো না। পল্লীগ্রামে মানুষ সহজেই ঈর্ষা ও অসূযার শিকার হয় এবং মন-বুদ্ধি তাই অসুস্থ ও বিকৃত থাকে।

সংকীর্ণ পরিসরের বদ্ধজীবনে ধনগর্ব, জনগর্ব, বংশ-গৌরব, মান-লিদা, পরশ্রীকাতরতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রবণতা ও প্রতিশোধ-বাঞ্ছা প্রভৃতি সাধারণত মানুষকে পেয়ে বসে। আবদুল করিম আবাল্য এ সবের কবল-মুক্ত ছিলেন। তাঁর কাছে হিন্দু-মুসলমান ও আত্মীয়-অনাত্মীয় ভেদ ছিল না। গৃহভৃত্যকে তিনি পুত্রবৎ স্নেহ করতেন এবং পরিজনের অধিকার দিতেন। চিরকাল প্রত্যহ কারো না কারো শিশু কোলে করেই তিনি অবসর উপভোগ করতেন। অপরের দুঃখ-শোকে ব্যথিত হতেন। সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তি তাঁর কাছে অসহ্য ছিল। পাকিস্তানোত্তর যুগেও সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান বলে মুসলিম লীগে তাঁর অশ্রদ্ধা ছিল। পাক-ভারতে বিধর্মী হত্যায় ও বাস্তুত্যাগে তিনি বিচলিত ও ব্যথিত হতেন।

পুত্রার্থে আর একটি বিয়ে করবার জন্যে হিতৈষীদের পরামর্শ তিনি অগ্রাহ্য করেন, তাঁর স্ত্রী মনে আঘাত পাবেন বলেই। বন্ধু আলতাফ আলীর অকালমৃত্যুতে তাঁর স্মৃতি অম্লান রাখবার বাসনায় নিজের একমাত্র কন্যার নাম রাখেন আলতাফুননিসা। মতান্তরে ও বিবাদে হঠাৎ ক্রুদ্ধ হয়েছেন, জেদ চেপে গেছে, আবার অবিলম্বে শিশুর মতোই সব ভুলতে পেরেছেন। তাঁর জেদটা বংশগত। জেদের বশে এ পরিবারের তিনজন সরকারি চাকুরি ত্যাগ করেছেন। স্বয়ং আবদুল করিমও স্কুল ইন্সপেক্টর খাঁ বাহাদুর আহসানুল্লাহর দুর্ব্যবহারের প্রতিবাদে চাকুরি ছেড়ে দিয়েছিলেন। অবশ্য খাঁ বাহাদুর আবদুল আজিজের অনুরোধে ও মধ্যস্থতায় এ অবাঞ্ছিত ঘটনার অবসান ঘটে। যাদের সঙ্গে ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলা চলছে, সে সব পারিবারিক শত্রুর সঙ্গেও তাঁর আলাপচারিতা বন্ধ হয় নি। পরিবারের এরূপ একজন চিরশত্রু কিন্তু তাঁর বাল্যবন্ধু অশিক্ষিত মাতব্বর ব্যক্তি মকবুল আলীই গাঁয়ে তাঁর শ্রেষ্ঠ সুহৃদ ছিলেন। গাঁয়ের বাড়িতে সপ্তাহ-অন্তে শনিবার সন্ধ্যা থেকে সোমবার সকাল অবধি মকবুল আলীই তাঁর আড্ডার সাথী। শেষ বয়সে এক দেওয়ানি মামলায় আবদুল করিম ছিলেন বাদি আর মকবুল আলী বিবাদি, বাড়ির কাছের পটিয়া মুন্সেফি আদালতে দু’জনে এক সঙ্গেই যেতেন। এই বর্ণনা রূপকথার মতোই অদ্ভুত অবাস্তব মনে হচ্ছে-কিন্তু সুচক্রদণ্ডী গাঁয়ে এখনো কয়েকশ’ প্রত্যক্ষদর্শী রয়েছে। তাঁর ও তাঁদের বাড়ির লোকের ক্রোধ ছিল, অসহিষ্ণুতা ছিল না। তাই পরাজিত শত্রুকে ক্ষমা করাই তাঁর ও তাঁদের বংশগত ঐতিহ্য। তাঁর অন্তরে প্রীতি ছিল, করুণাবোধও ছিল প্রবল। কার্পণ্য তাঁর ছিল না-ধার করেও তিনি আমরণ গাঁয়ের কয়েকটি অনাথা ও এতিমকে অর্থ সাহায্য করেছেন, এ ব্যাপারে অধ্যাপক ইদরিস আলী, পটিয়া স্কুলের দু’-একজন শিক্ষক ও বাজারের দু’-একজন দোকানদার ছিলেন তাঁর মহাজন। আরো কারা ছিলেন আমার জানা নেই। বৈষয়িক ব্যাপারে চির উদাসীন শিশুর মতো সরল এই মানুষটি আত্মীয়-বন্ধু কিংবা অতিথিকে আদর-আপ্যায়নে

লৌকিকতা প্রদর্শন করতে জানতেন না বা পারতেন না। মনে হতো যেন অতিথি তাঁর কাছে অনভিপ্রেত, যেন থাকা-খাওয়ার জন্যে যে ক্ষীণ কণ্ঠে সাধছেন তাতে আন্তরিকতার স্পর্শ নেই। অতিথি অভ্যাগতেরা হয়তো তাই মনে করতেন, অথচ পরিজনেরা জানত-ওতে এতটুকু খাদ নেই। পরের বাড়িতে কিছু গ্রহণে প্রথমে যে অনিচ্ছা প্রকাশ করাই দেশী রেওয়াজ-তা যেন তাঁর মনে থাকত না।

তিনি প্রথম জীবনে গ্রাম্য মধ্য ইংরেজি স্কুলে শিক্ষক এবং মধ্য বয়স থেকে বিভাগীয় বিদ্যালয় পরিদর্শক অফিসে কেরানি ছিলেন। দেশের মাটি, মানুষ ও সাহিত্যের প্রতি কত গভীর মমতা থাকলে রোজ দশটা থেকে পাঁচটা অবধি কেরানির খাটুনির পরও একাগ্রমনে প্রাচীন হাতের লেখা দুষ্পাঠ্য পুঁথি নিয়ে কঠিন কর্মে নিশিরাত অবধি নিরত থাকা সম্ভব-তা অনুভব করলে বিস্মিত হতে হয়। কবি জীবেন্দ্র কুমার দত্তকে লেখা এক পত্রে তিনি বলেছেন- বিষয় কর্মে আমার আগ্রহ নেই, এই কর্ম চাচার হাতে দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত মনে সাহিত্যসেবা নিয়েই আছি।

এক অভিভাষণে তিনি বলেছেন- দেশের মানুষ, পাশের বাড়ির লোক কি কীর্তি রেখে গেছেন তা যদি না জানলাম তা হলে আরব-ইরানি ভাইয়ের কীর্তির খবর নিয়ে কি লাভ। এই সুস্থ মন ও সুস্থ বুদ্ধিই তাঁকে ঋজু ও পরিচ্ছন্ন জীবনদৃষ্টি দান করেছিল। সাহিত্যসেবী আবদুল করিমের পরিচয় তাঁর রচনায় ও সাহিত্যকর্মে বিধৃত রয়েছে। তাঁর পরিশ্রম, তাঁর নিষ্ঠা, তাঁর যোগ্যতা, তাঁর পাণ্ডিত্য, তাঁর স্বদেশ অন্বেষা ও সাহিত্যপ্রীতি গুহায়িত নেই। আমরা এখানে বাঙালি মুসলিম জীবনে তাঁর সাধনার দান ও সুফল এবং গুরুত্ব ও প্রভাব কতখানি তা জানবার-বুঝবার চেষ্টা করেছি মাত্র এবং সে প্রসঙ্গে মানুষ আবদুল করিমের অন্তরঙ্গ পরিচয়-সূত্র ও জীবন-দৃষ্টির আভাস দেয়ার প্রয়াস পেয়েছি। কয়েকটি কথায় তিরাশি বছরের কর্মবহুল ও ঘটনা-ঋদ্ধ সুদীর্ঘ জীবনের সামগ্রিক ধারণা দেয়া সম্ভব নয়। কেউ কোনোদিন তাঁর পূর্ণাঙ্গ পরিচয় লাভে ও তাঁর কৃতির মূল্যায়নে আগ্রহী হলে দেখবেন আবদুল করিম ব্যক্তিগত জীবনে যেমন, গবেষণা ক্ষেত্রেও তেমনি সত্যনিষ্ঠ ও সত্য-সন্ধানী ছিলেন। কোনো প্রলোভনের বশে তিনি তাঁর বিবেক-বুদ্ধিকে ও জ্ঞান-বিশ্বাসকে প্রতারিত করেন নি। স্কুলে তিনি আদর্শ শিক্ষক এবং অফিসে কর্তব্য-নিষ্ঠ কেরানি ছিলেন। সৌজন্যেই যদি সংস্কৃতিবানতার পরিচয় মেলে, তাহলে মানতে হবে সুজন আবদুল করিম দুর্লভ মানবিক গুণসম্পন্ন সংস্কৃতিবান নাগরিক ছিলেন।

তিনি জীবনে কোনো সংস্কারের দাসত্ব করেন নি, এই যুগ-দুর্লভ মুক্তমন ও স্বচ্ছবুদ্ধি মানববাদী না হলে কারো আয়ত্তে আসে না। মানুষকে যে তিনি নিবর্ণ মানুষ হিসেবেই দেখেছিলেন, তার প্রমাণ মেলে ১৯৫২ সনে কুমিল্লায় অনুষ্ঠিত সংস্কৃতি সম্মেলনে সভাপতি রূপে প্রদত্ত তাঁর ভাষণে। তিনি মানবিক সমস্যার বৈজ্ঞানিক ও যৌক্তিক সমাধানে আস্থাবান ছিলেন। তিনি যে সংস্কারমুক্ত মানববাদী ছিলেন, তাও অশীতিপর বৃদ্ধের উক্ত ভাষণে প্রকটিত। সাহিত্যের অঙ্গনে তাঁর বিচরণ ক্ষেত্র ছিল প্রাচীন ও মধ্যযুগের পরিসরে। কিন্তু তাঁর মন ও রুচি মধ্যযুগীয় ছিল না।

এক উদার মানবিক বোধের প্রেরণায় তিনি আধুনিক ও মানববাদী ছিলেন। যে-কোনো জিজ্ঞাসু তরুণের মতো স্বদেশের স্বকালের সম্পদ ও সমস্যা, আনন্দ ও যন্ত্রণা জানবার-বুঝবার প্রবল আগ্রহ ছিল তাঁর। তাই তিনি তাঁর সমকালীন বাংলাদেশের সব মাসিক-সাপ্তাহিক পত্রিকার গ্রাহক ছিলেন। সম্পাদক-লেখকদের সঙ্গে পরিচয় ও সম্পর্ক স্থাপন বাঞ্ছায় তিনি বাংলাদেশের সব পত্র-পত্রিকায় প্রবন্ধও লিখেছেন। তাঁর রচিত সাড়ে পাঁচশ’-ছয়শ’ প্রবন্ধের সর্বত্র তাঁকে বাংলাদেশের বাঙালিরূপেই প্রত্যক্ষ করি।

শিথিল-চরিত্র, বিকৃতবুদ্ধি, চাটুকার আকীর্ণ রূগ্নদেশে আবদুল করিমের মতো খাঁটি মানুষের বহুলতা সমাজস্বাস্থ্য উদ্ধার ও রক্ষার জন্যেই আবশ্যক। আবদুল করিমের চিত্তবৃত্তি ও কৃতি স্মরণে অন্তত দু-চারটি বুকে শ্রেয়স-চেতনা ও মূল্যবোধ জিইয়ে রাখার আগ্রহ জাগবে, এ প্রত্যাশা অসঙ্গত নয়।

(লেখকের বানানরীতি অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে)

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত