খাতা-কলমে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমপর্ণ করলেও এর পরও বাংলাদেশের অনেক এলাকা তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ওইসব এলাকায় পাকিস্তানি সৈন্যরা অস্ত্র সমর্পণে অস্বীকৃতি জানালে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে তাদের যুদ্ধ তীব্র হয়।
খণ্ড খণ্ড এসব যুদ্ধের মাধ্যমে সারা দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সময় লেগে যায় আরও এক সপ্তাহ।
তবে বিজয়ের সেই আনন্দ উদযাপন করার আগেই তা বিষাদে পরিণত হয় শত শত বুদ্ধিজীবী হত্যা খবরে। সারা দেশে সন্ধান মিলতে থাকে একের পর এক বধ্যভূমি ও গণকবরের।
এদিকে, যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি একেবারে ভেঙে পড়ে। বেড়ে যায় চুরি-ছিনতাই, লুটপাট-ডাকাতির ঘটনা।
কলকাতা থেকে মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রীদের ঢাকায় ফিরতে ২২শে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় লেগে যায়।
এর মাঝের কয়েকদিন দেশ কীভাবে চলবে এবং কীভাবে সারা দেশে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হবে, সেটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দেয় প্রবাসী সরকারের কাছে।
অন্যদিকে, ভারতীয় সেনারা নিজ দেশে ফিরে না যাওয়ায় জনমনে জন্ম নেয় সন্দেহ-সংশয়, উঠতে থাকে নানান প্রশ্ন।
এরই মধ্যে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে ২৪ ঘণ্টার আকস্মিক সফরে ঢাকা আসেন ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর তৎকালীন প্রধান সেনাপতি জেনারেল শ্যাম মানেকশ।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরের দুই সপ্তাহে এ ধরনের আরও অনেক ঘটনা ঘটতে থাকে, যেগুলোর উল্লেখ সেই সময়কার বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও বইপত্রে রয়েছে।
সেসব ঘটনার মধ্য থেকে আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটনার বর্ণনা তুলে ধরা হলো।
বধ্যভূমি ও গণকবরের সন্ধান
পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর ২৪ ঘণ্টা না পেরোতেই বিজয়ের আনন্দ রীতিমত বিষাদে পরিণত হয়।
১৭ই ডিসেম্বর জানা যায়, আত্মসমপর্ণের আগে পাকিস্তানি সেনারা পরিকল্পিতভাবে শিক্ষক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, চিকিৎসকসহ শত শত বাঙালি বুদ্ধিজীবীকে ধরে নিয়ে হত্যা করেছে।
ঢাকা, খুলনা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে খোঁজ মিলতে থাকে একের পর বধ্যভূমি ও গণকবরের।
বাংলাদেশের জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়ার তথ্যানুসারে, মুক্তিযুদ্ধের সময় সবমিলিয়ে সারা দেশে এগারো শ' জনের বেশি বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছিল।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রায় দেড়শ' জনই হত্যার শিকার হয়েছিলেন ঢাকায়, যাদের বেশিরভাগেরই মরদেহ পাওয়া গিয়েছিল রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে।
ঘটনাটিকে তখন "মানবেতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড" বলে বর্ণনা করেছিল দৈনিক ইত্তেফাক।
"শুক্রবার (১৭ই ডিসেম্বর) অপরাহ্নে ঢাকার কতিপয় সাংবাদিক কোন এক সূত্রে আভাস পাইয়া এই বধ্যভূমিতে গিয়া ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম হত্যাযজ্ঞের আলামত দেখিতে পান," ১৯৭১ সালের ১৯শে ডিসেম্বর প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
বধ্যভূমির পাশাপাশি বিভিন্ন এলাকায় গণকবরেরও সন্ধান মিলতে থাকে।
বিজয়ের আনন্দের মধ্যে একের পর এক বধ্যভূমি ও গণকবরের খবর সামনে আসতে থাকায় সেসময় যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, সেটির বর্ণনা দিয়ে সংবাদ প্রকাশ করেছিল দৈনিক পূর্বদেশ।
"রক্তস্নাত বাংলাদেশ কাঁদো" শিরোনামের ওই খবরে বলা হয়েছে, "স্রোতস্বিনী পদ্মা-মেঘনা-যমুনার পানি আমাদের প্রিয়জনদের রক্তে লাল হয়ে গেছে। একদিকে স্বাধীনতার আনন্দ, অন্যদিকে লাখো মানুষের আত্মহুতি।"
খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ
একাত্তরের ১৬ই ডিসেম্বর বিকেলে ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ বাহিনীর কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করলেও কিছু কিছু এলাকায় পাকিস্তানি সেনারা অস্ত্র জমা দিতে অস্বীকৃতি জানায়।
খণ্ড খণ্ড যুদ্ধের মাধ্যমে পরবর্তী এক সপ্তাহে ওইসব এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয় মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা।
বাংলাদেশ সরকারের প্রকাশিত 'বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস' গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও তা মেনে নিতে রাজি হননি পাকিস্তানি ১০৭ নম্বর ব্রিগ্রেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার হায়াত খান।
চার হাজার সৈন্য নিয়ে তিনি খুলনা অঞ্চলে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে অটল থাকেন।
তখন আট নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর আবুল মঞ্জুরের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা একযোগে আক্রমণ শুরু করলে ১৭ই ডিসেম্বর দুপুরে খুলনা সার্কিট হাউস মাঠে পাকিস্তানি সেনারা আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করেন।
একইভাবে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে তুমুল যুদ্ধের পর ১৭ই ডিসেম্বর বাগেরহাট, কিশোরগঞ্জ, রাজশাহী ও রাঙ্গামাটি; ১৮ই ডিসেম্বর পাবনা, নওগাঁ, সৈয়দপুর এবং রাজবাড়ী মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আসে।
এছাড়া ১৯শে ডিসেম্বর ভৈরব ও পাবনার ঈশ্বরদী, ২১শে ডিসেম্বর নাটোর এবং ২৩শে ডিসেম্বর কুমিল্লার হোমনা উপজেলা পাকিস্তানি বাহিনীর কাছ থেকে পুরোপুরিভাবে মুক্ত হয়।
প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা
পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করার মধ্য দিয়ে এই ভূ-খণ্ডে তাদের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে ভেঙে পড়ে। ফলে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের সবক্ষেত্রে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করাটা জরুরি হয়ে পড়ে।
কীভাবে সেটি করা হবে, সেটা অবশ্য দেশ স্বাধীন হওয়ার আগই পরিকল্পনা করে রেখেছিল তৎকালীন মুজিবনগর সরকার।
ওই সরকারের মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন হোসেন তৌফিক ইমাম, যিনি এইচ টি ইমাম নামেও পরিচিত।
এইচ টি ইমাম তার লেখা 'বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১' গ্রন্থে লিখেছেন যে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশের রাজধানী দ্রুত ঢাকায় স্থানাস্তরের পরিকল্পনা করা হয়।
"শত্রু আত্মসমর্পণ করলে আমরা কত দ্রুত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধান কার্যালয় স্থানান্তর করব ঢাকায়? এই স্থানান্তরের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম প্রশ্ন: নেতৃবৃন্দের নিরাপত্তা। সেটি নিশ্চিত না করা পর্যন্ত আমরা কোন ঝুঁকি নিতে পারি না। অতএব, সমরনায়কদের পরে প্রথম ব্যাচে যাবেন সচিববৃন্দ। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রিবর্গ ঢাকা থেকে সিগন্যাল পাওয়ার পরে যাবেন," নিজের বইতে লিখেছেন এইচ টি ইমাম।
এইচ টি ইমাম তার গ্রন্থে আরও লিখেছেন, "১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের পর সারাদেশে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে এবং বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠিত করতে আরও কয়েকদিন প্রয়োজন ছিল। আমাদের প্রধানতম কাজ ছিল রাজধানী ঢাকা, বন্দর নগরী চট্টগ্রাম, বিভাগীয় শহরগুলি এবং গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও বেসামরিক স্থাপনাগুলি কাল বিলম্ব না করে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেওয়া। একই সাথে সচিবালয় ও সারাদেশে বিভিন্ন দপ্তরে বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করে স্বাধীন, সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সরকারের নিয়ন্ত্রণ সুদৃঢ় করা।"
প্রবাসী সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রতিটি জেলায় ডেপুটি কমিশনার এবং পুলিশ সুপার নিয়োগ করে তাদের কর্মস্থলে যোগ দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদের জন্যও কর্মকর্তাদের বাছাই করা হয়, যাতে তারা কয়েক ঘণ্টার নোটিশে কাজে যোগ দিতে পারেন।
"নবনিযুক্ত ডেপুটি কমিশনার ও এসপিদের স্বাধীন বাংলা বেতার এবং টেলিগ্রাম মারফত সরাসরি নির্দেশ দিতে আরম্ভ করি। টাইপ করার সময় না থাকায় এই সময় সরাসরি হাতে লিখে নির্দেশ দিতে থাকি," এইচ টি ইমাম উল্লেখ করেছেন তার 'বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১' গ্রন্থে।
মুজিবনগর সরকারের ঢাকায় প্রত্যাবর্তন
ঢাকা বিমানবন্দর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তারা ঢাকায় ফিরতে শুরু করেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার প্রায় সপ্তাহখানেকের মাথায় ২২শে ডিসেম্বর ঢাকায় ফেরেন তৎকালীন সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, অর্থ-বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ এম কামরুজ্জামান এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ।
ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরে নামার পর বিপুল সংখ্যক মানুষ তাদের ফুলের মালা পরিয়ে বরণ করে নেয় বলে তখনকার পত্রপত্রিকার খবরে উল্লেখ করা হয়েছে।
গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির আদর্শে স্বাধীন বাংলাদেশে একটি শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে বলে বিমানবন্দরে নামার পর দেওয়া প্রথম ভাষণে বলেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম।
শোষণমুক্ত সমাজের পথে কাউকে বাধা সৃষ্টি করতে দেওয়া হবে না বলে জানান প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ।
শেখ মুজিবকে কারাগার থেকে দ্রুত মুক্তি দেওয়ার পাশাপাশি স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য পাকিস্তানের সামরিক সরকারের প্রতি আহ্বান জানান মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রীরা।
প্রবাসী সরকারের এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্যে দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী মুজিবনগর থেকে ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়।
মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে যত সিদ্ধান্ত
মন্ত্রীদের দেশে ফেরার পরদিন, অর্থাৎ ২৩শে ডিসেম্বর ঢাকায় স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারের মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
বঙ্গভবনে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে বেশ কিছু বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
সেগুলোর মধ্যে একটি হলো–– 'বাংলা ভাষা'কে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ও সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া।
সেইসঙ্গে, সরকারি যে সব প্রতিষ্ঠানের নামে পাকিস্তান বা পূর্ব-পাকিস্তান ছিল, সেগুলো পরিবর্তন করে বাংলাদেশ লেখার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়।
পাকিস্তান স্টেট ব্যাংকের নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম দেওয়া হয় 'বাংলাদেশ ব্যাংক'।
মুক্তিযুদ্ধে যারা প্রাণ হারিয়েছেন, তাদের স্মরণে ঢাকায় একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নেয় মন্ত্রিসভা। এছাড়া যুদ্ধের সময় ক্ষতিগ্রস্ত ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার পুনর্নিমাণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হয়।
মুক্তিযুদ্ধে নিহতদের পরিবারকে সহায়তা করার জন্য একটি 'মেমোরিয়াল ট্রাস্ট ফান্ড' গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বিলুপ্ত করা হয় পাকিস্তান প্রেস কাউন্সিল এবং অ্যাকাডেমি ফর পাকিস্তান অ্যাফেয়ার্স।
এছাড়া ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের পরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যত পরীক্ষা গ্রহণ করেছে, সেগুলো সব বাতিল করে নতুন করে পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় মন্ত্রিসভা।
মুক্তিবাহিনীর জনসভা
বিজয় অর্জনের একদিন পর ১৮ই ডিসেম্বর ঢাকার পল্টন ময়দানে মুক্তিবাহিনীর আয়োজনে প্রথমবার জনসভা অনুষ্ঠিত হয়।
সেই জনসভা থেকে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য ৩১শে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দেন বক্তারা।
নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেওয়া না হলে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানে আক্রমণ করবে বলে হুঁশিয়ারি দেন বাহিনীর অন্যতম কমান্ডার আব্দুল কাদের সিদ্দিকী।
"তিনি জানান, অন্যথায় বাংলাদেশের অর্থে পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠিত প্রকল্পসমূহ নিশ্চিহ্ন করিয়া দিবেন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাহারা মুক্ত করিয়া আনিবেন," ১৯শে ডিসেম্বর প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার খবরে উল্লেখ করা হয়েছে।
ওই জনসভায় পাকিস্তানি বাহিনীকে সহায়তাকারী রাজাকার-আলবদর বাহিনীর সদস্যদের 'উপযুক্ত শাস্তি' দেওয়ার ঘোষণা দেন মুক্তিযোদ্ধারা।
সরকারি অফিস চালু
দেশ স্বাধীন হওয়ার দুইদিন পর ১৯শে ডিসেম্বর সচিবালয়সহ সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের কার্যক্রম পুনরায় শুরু করে তৎকালীন অস্থায়ী সরকার।
এ লক্ষ্যে ১৮ই ডিসেম্বর সরকারের তরফ থেকে একটি নির্দেশ জারি করা হয়।
সেখানে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত রোববারের সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও যথারীতি সকাল নয়টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত অফিস খোলা থাকবে বলে জানানো হয়।
"গতকাল (শনিবার, ১৮ই ডিসেম্বর) ঢাকার সেক্রেটারিয়েট ভবনে বাংলাদেশ সরকারের সেক্রেটারী জেনারেল জনাব রুহুল কুদ্দুসের সভাপতিত্বে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন দফতরের উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারীদের এক বৈঠকে এইসব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে," ১৯শে ডিসেম্বর প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথমপাতার একটি খবরে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রথম কর্মদিবস হওয়ায় ১৯শে ডিসেম্বর নির্ধারিত সময়ের দেড় ঘণ্টা আগে, অর্থাৎ সকাল সাড়ে সাতটায় কাজে যোগ দেওয়ার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে তখনকার পত্রিকার খবরে উল্লেখ করা হয়েছে।
ভারতীয় সেনাদের ফেরানোর ঘোষণা
পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর আত্মসমপর্ণের পর ৪৮ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও ভারতীয় সৈন্যরা নিজ দেশে ফিরে না যাওয়ায় জনমনে নানান প্রশ্ন ও সংশয় দেখা দিয়েছিল।
এমন পরিস্থিতিতে তৎকালীন মিত্র বাহিনীর অধিনায়ক ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা বাংলাদেশের মানুষকে আশ্বস্ত করে ঘোষণা করেন যে, শিগগিরই তারা তাদের সৈন্যদের ভারতে ফিরিয়ে নেবেন।
১৯শে ডিসেম্বর ঢাকায় সচিবালয়ে বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের উদ্দেশে ভাষণ দেন মি. অরোরা। ২০শে ডিসেম্বর দৈনিক ইত্তেফাকের খবরে সেই ভাষণের গুরুত্বপূর্ণ অংশ তুলে ধরা হয়।
"আইনশৃঙ্খলা ও যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, পণ্যদ্রব্যের সরবরাহ ব্যবস্থা পুনঃরায় চালু করা এবং নিজ নিজ বাড়িঘরে শরণার্থীদের পুনর্বাসনে সাহায্য করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধেই ভারতীয় সৈন্যরা এখানে রয়েছেন," ভাষণে মি. অরোরা বলেন বলে খবরে উল্লেখ করেছে দৈনিক ইত্তেফাক।
"নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালনের জন্য ঠিক যতটুক সময়ের প্রয়োজন, তার চাইতে এক ঘণ্টা বেশি সময়ও ভারতীয় বাহিনী এখানে থাকিবেন না," বলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা।
মানেকশ'র ঢাকা আগমন
মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তারা ফেরার পাঁচদিনের মাথায় ২৪ ঘণ্টার সফরে ঢাকায় আসেন ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর তৎকালীন প্রধান সেনাপতি জেনারেল শ্যাম মানেকশ।
২৭শে ডিসেম্বর জেনারেল মানকশকে বহনকারী বিমানটি তৎকালীন ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করে।
সেসময় তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের রাজনৈতিক উপদেষ্টা আব্দুস সামাদ আজাদ তাকে ফুল দিয়ে স্বাগত জানান বলে তখনকার পত্রপত্রিকার খবরে উল্লেখ করা হয়েছে।
এছাড়া ভারতীয় বাহিনীর রাজপুত রেজিমেন্টের একটি ব্যাটালিয়ন বিমানবন্দরে জেনারেল মানকশকে গার্ড অব অনার দেয়।
সফরের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে চাইলে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান সেনাপতি সাংবাদিকদের বলেন, পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে ভারতীয় যেসব সেনারা বাংলাদেশে এসেছে, তাদের সঙ্গে দেখা করাই তার সফরের প্রধান উদ্দেশ্য।
সফরকালে জেনারেল মানকশ বাংলাদেশের তৎকালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন।
মি. আহমদের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় সেখানে মুক্তিবাহনীর সর্বাধিনায়ক এম এ জি ওসমানীও উপস্থিত ছিলেন বলে পত্রিকার খবর থেকে জানা যাচ্ছে।
মন্ত্রিসভার আকার বৃদ্ধি
ডিসেম্বরের শেষের দিকে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার আকার আরও বড় করা হয়।
নতুন করে আরও পাঁচ জনকে মন্ত্রী করা হয়, যাদের শপথ বাক্য পাঠ করান অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম।
এর মধ্যে শেখ আব্দুল আজিজকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়, ফণিভূষণ মজুমদারকে কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয়, আব্দুস সামাদ আজাদকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জহুর আহমদ চৌধুরীকে স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং অধ্যাপক ইউনূস আলীকে শিক্ষা ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
এছাড়া খন্দকার মোশতাক আহমেদকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে ভূমি ও আইন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
এ ঘটনার পর ৩১শে ডিসেম্বর পত্রিকায় খবর বের হয় যে, মি. খন্দকার মোশতাক আহমেদ মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করে দলীয় কাজে মনোনিবেশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
আইনশৃঙ্খলার অবনতি
সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের শুরুর দিকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি একদমই সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিল না। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে পুলিশ বাহিনী তখনও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। রয়েছে খাদ্য, বস্ত্রের তীব্র সংকট।
এমন পরিস্থিতি বিভিন্ন এলাকায় চুরি-ছিনতাই, ডাকাতি ও লুটপাটের ঘটনা বেড়ে যায়।
ফলে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখতে মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের দায়িত্ব নেওয়ার আহ্বান জানায় বাংলাদেশের তৎকালীন অস্থায়ী সরকার।
ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের গেরিলাদের নির্দেশ দেওয়া হয়, তারা যেন নিজ নিজ এলাকায় ফিরে গিয়ে সেখানকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভারিক রাখতে জনগণকে নিয়ে কাজ করেন।
সেইসঙ্গে "অপ্রয়োজনীয়ভাবে গুলিবর্ষণ" না করারও আহ্বান জানান ঢাকা অঞ্চলের মুক্তিবাহিনী তৎকালীন সেক্টর কমান্ডার মেজর এটিএম হায়দার।
২০শে ডিসেম্বর প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেফাকের একটি খবরে বলা হয়েছে, ঢাকার গুলশানের একটি বাড়িতে দিনে-দুপুরে লুটপাট করার সময় ২৫ জন ব্যক্তিকে মুক্তিযোদ্ধারা "হাতেনাতে" গ্রেফতার করে।
অন্যদিকে, পাকিস্তানি বাহিনীকে সহায়তা ও বাংলাদেশিদের হত্যায় অংশ নেওয়ায় সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় রাজাকার, আলবদর বাহিনীর সদস্যদের ধরে গণপিটুনি দিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটছিলো।
এ অবস্থায় আইন হাতে তুলে না নিয়ে তাদেরকে ধরার পর মুক্তিবাহিনী বা স্থানীয় থানার কাছে হস্তান্তর করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে আহ্বান জানানো হয়।
জাতীয় মিলিশিয়া গঠনের ঘোষণা
দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নে পুলিশ বাহিনীর পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের অংশগ্রহণে জাতীয় মিলিশিয়া বা আধা সামরিক বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় মন্ত্রিসভা।
তবে আধা-সামরিক বাহিনীতে যোগদানের পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদেরকে স্বাধীন বাংলাদেশের সেনা, নৌ এবং বিমানবাহিনীতে যোগদানের ব্যাপারেও সরকারের বিবৃতিতে আহ্বান জানানো হয়।
"গণতন্ত্র, আইনের শাসন, ধর্ম নিরপেক্ষতা ও সমাজবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের এখনই কাজ শুরু করিতে হইবে। ইহা একটি বিরাট কাজ এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে আমরা সকলে, বিশেষ করিয়া আমাদের মুক্তিযোদ্ধাগণ যে দেশপ্রেম, আন্তরিকতা, নিষ্ঠা, কঠোর পরিশ্রম ও ত্যাগের মনোভাব প্রদর্শন করিয়াছেন, কেবলমাত্র তার দ্বারাই এই কাজ সাফল্যমণ্ডিত হইতে পারে," তৎকালীন সরকারের বিবৃতি তুলে ধরে দৈনিক ইত্তেফাকের খবরে বলা হয়েছে।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

