আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, আমাদের দেশে যারা অ্যাথলেট আছে, তাদের যদি উসাইন বোল্টের মতো ২০ ঘন্টা করে ট্রেইনিং করানো হয়, তারা কী উসাইন বোল্ট হবে? নাকি মারা যাবে? কাজেই অতিরিক্ত সংস্কার, যেটা আমরা নিতে পারি না। সেটা করে, আমরা রাষ্ট্র কাঠামোকে দুর্বল করে ফেলি কিনা। সেটাও আপনাদের চিন্তা করতে হবে।
সোমবার সকালে মহানগর দায়রা জজ আদালত ভবনে জগন্নাথ-সোহেল স্মৃতি মিলনায়তনে ঢাকায় ই-পারিবারিক আদালতের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন তিনি।
আসিফ নজরুল আরো বলেন, অনেকে সংস্কারের ব্যাপারে বলেন, কই সংস্কার? কোন কিছুই দৃশ্যমান হচ্ছে না। প্রতিদিন আইসিটিতে বিচার দেখায়। এরপরও বলে, বিচার দৃশ্যমান হচ্ছে না৷ আমাদের এখানে যে বিচার, সংস্কার হচ্ছে না, সেটা নিয়ে হাহাকার, আকাঙ্ক্ষা থাকবে। কিন্তু যেগুলো হচ্ছে, সেটাকে তো এপ্রিসিয়েট (উৎসাহিত) করতে হবে। আপনাকে মামলা দায়ের করতে হবে না। আমরা আইন করে দিয়েছি, পারিবারিক আদালতে আপনার প্রথমে যাওয়ার প্রয়োজন নাই। বিনা খরচে, বিনা সমস্যায় লিগ্যাল এইডে গিয়ে আপনি সেই সুবিধা পাবেন। পারিবারিক সমস্যার ক্ষেত্রে লিগ্যাল এইডকে আমরা মেন্ডেটরি (আবশ্যকীয়) করে দিয়েছি। একজনের পরিবর্তে তিনজন বিচারক দিয়েছি। লিগ্যাল এইডে সন্তুষ্ট না হলে পারিবারিক আদালতে যেতে পারবেন৷ আমরা এখন ২০ জেলায় এটা শুরু করতে পেরেছি। যাওয়ার আগে, ৬৪টি জেলায় লিগ্যাল এইড করে দিয়ে যাবো। যখন আমরা অধিদপ্তরে রূপান্তরিত করব, যখন এটা পুরোপুরি ফাংশনাল (কার্যকর) হবে। বাংলাদেশে যত মামলা হয় তার ওয়ান থার্ড (তিনভাগের একভাগ) কমে যাবে। পাঁচ বছরের মধ্যে মামলার জট পঞ্চাশ শতাংশ কমে যাবে।
আইন উপদেষ্ঠা বলেন, আমাদের চিন্তা হচ্ছে, সংস্কার মানে সংবিধান পরিবর্তন করা। বাংলাদেশে অর্থনৈতিক খাতে সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন হয়েছে, ভ্যাট চালু করে। ভ্যাট কী সংবিধান পরিবর্তন করে হয়েছে? এটাতো আইনের মাধ্যমে হয়েছে। বাংলাদেশে পরিবেশগত যতটুকু পরিবর্তন হয়েছে, সেটা আইনের মাধ্যমে হয়েছে। আমাদের এখানে এসিড সন্ত্রাস একসময় ভয়াবহ ব্যাপার ছিলো। এটা এখন নাই বললেই চলে। পরিবর্তন টা আইনের মাধ্যমে হয়েছে। আমাদের চিন্তা হচ্ছে, সংবিধানই তো পরিবর্তন হয়নি, তাহলে মনে হয় সংস্কার হয়নি। সংস্কার নিয়ে আমাদের কোন ভুল ত্রুটি আছে কিনা। সেটা নিয়ে আলোচনা করতে হবে। সংস্কার নিয়ে বিভ্রান্তি হচ্ছে, এটা ওভার নাইট করার বিষয়। কিন্তু সংস্কার নিয়ে সবার আগে আমরা যার নাম নেই, তিনি হচ্ছেন সিঙ্গাপুরের লি কোয়ান হু। ওঁনার সংস্কার করতে ১০ বছর লেগেছে।
এটাতো ওভার নাইট করার বিষয় না। আমার সুযোগ আসলো, সব কিছু আইনের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে সাথে সাথে সংস্কার হয়ে গেলো, অন্ধকার ঘর আলো হয়ে গেলো। এটা ম্যাজিকের মতো কোন ব্যাপার না। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, আমাদের দেশে যারা অ্যাথলেট আছে, তাদের যদি উসাইন বোল্টের মতো ২০ ঘন্টা করে ট্রেইনিং করান, তারা কী উসাইন বোল্ট হবে? না মারা যাবে? কাজেই অতিরিক্ত সংস্কার, যেটা আমরা নিতে পারি না। সেটা করে, আমরা রাষ্ট্র কাঠামোকে দুর্বল করে ফেলি কিনা। সেটাও আপনাদের চিন্তা করতে হবে। নেপালের নিম্ন কক্ষ করেছে। এখন তাদের মাসে মাসে নতুন সরকার গঠিত হয়৷ সংস্কার একটা ক্রমান্বয়ে প্রক্রিয়া। আস্তে আস্তে সেটাকে আনতে হবে। বাস্তবোচিতভাবে সেটা আনতে হবে। সবশেষে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কার, বিশেষ করে বিচার অঙ্গনের সংস্কারগুলো ধরে রাখার জন্য পরবর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
তিনি আরো বলেন, মামলা দায়ের, নথি ব্যবস্থাপনা, শুনানি, রায় সবকিছুই অনলাইনে পাওয়া যাবে। এটাকে আমরা একটা পেপারলেস কোর্ট বলতে পারি। এটা ভোগান্তি কমাবে, সময় বাঁচাবে, দুর্নীতি কমবে, খরচ কমাবে। এটা নিয়ে আমাদের কারো কোন সন্দেহ নাই। আপনারা ল'ইয়াররা (আইনজীবীরা) এটার গার্ডিয়ান হন। এনসিওর (নিশ্চয়তা দেন) করেন, এটাকে যাতে কেউ পলিউট (কলুষিত) করতে পারে। এটাকে কেউ যেন ডিস্টেবিলাইজ (স্থিতিশীলতা নষ্ট করা) করতে না পারে। যাত্রা শুরু হয়ে যেন থেমে না থাকে। দেখেন, ডিজিটালাইজেশন সুবিধাটা কি? আমরা সবাই বিকাশ ইউজ (ব্যবহার) করি। এটা আমাদের আমাদের জীবন কতো সহজ করে দিয়েছে।
আসিফ নজরুল বলেন, প্রধান উপদেষ্টার দুইটা বড় অফিস আছে। সবচেয়ে বড় অফিস হচ্ছে হোয়াটসঅ্যাপ। আমি উনাকে বক্তৃতা লিখে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়েছিলাম। আধা ঘন্টার মধ্যে সে বক্তৃতা এডিট করে আমাকে পাঠিয়েছেন। আমরা কেন সবাই পারি না? হোয়াটসঅ্যাপই তো আপনার অফিস হতে পারে। এরপর ডিজিটালাইজেশনের সুবিধা বোঝাতে মোবাইল ফোনের উদাহরণও ব্যবহার করেন। যেসব দেশ ডিজিটালাইজেশন হয়েছে, পেপারলেস হয়েছে, সেখানে বেকার বেশি? নাকি যে সমস্ত দেশ ম্যানুয়াল পর্যায়ে আছে, সেখানে বেকার বেশি? আমাদের অহেতুক ভীতি কাজ করে, ডিজিটালাইজেশন হলে হয়তো আমার ইনকাম কমে যাবে। কাজ কমে যাবে। কখনোই কমবে না। যখন দেখবেন, ভিজিটালাইজেশন হয়ে গেছে। মামলার প্রতিকার পাওয়া সম্ভাবণা বাড়লে, আরো অনেকে মামলা করবে। অনেক বেশি লোক মামলা করলে, কোনভাবেই আপনি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না।
তিনি আরও বলেন, আমাদের উদ্যােগ টা একটা বেবির মতো। কিন্তু আপনারা যদি উদ্যোগ না নেন, আপনারা যদি এটার অভিভাবকের ভূমিকায় না থাকেন। তাহলে এটা টিকবে না। আমাদের অনুরোধ, এগুলোকে আপনাদের সন্তানের মত লালন করবেন। এটা ছাড়া আর কোন প্রত্যাশা নাই। কোন ধন্যবাদ ধন্যবাদ দেওয়ার দরকার নাই। আমরা উপদেষ্টারা, উই জাস্ট ওয়ান্ট টু পজেটিভ ডিপ্রেন্স ( আমরা একটা ইতিবাচক পরিবর্তন চাই)। আমরা অনলাইনে সাক্ষ্য আছে দেয়ার ব্যবস্থা করেছি। সাক্ষ্যর অভাবে দিনের পর দিন মামলা ঝুলে থাকে। এর ফলে আমাদের অনেক সময় বাঁচবে। আমরা আইন মন্ত্রণালয় থেকে ২১টা রিফর্মের কাজ করেছি। এসব টিকবে না, যদি আমরা এগুলো কন্টিনিউ করতে না চান। সেজন্য আইনজীবীদের শক্ত ভূমিকা রাখা আহ্বান জানান।
আমরা অনলাইনে সাক্ষ্য আছে দেয়ার ব্যবস্থা করেছি। সাক্ষ্যর অভাবে দিনের পর দিন মামলা ঝুলে থাকে। এর ফলে আমাদের অনেক সময় বাঁচবে। আমরা আইন মন্ত্রণালয় থেকে ২১টা রিফর্মের কাজ করেছি। এসব টিকবে না, যদি আমরা এগুলো কন্টিনিউ করতে না চান। সেজন্য আইনজীবীদের শক্ত ভূমিকা রাখা আহ্বান জানান। ই রেজিস্ট্রেশন, ই জুডিশিয়ারি আমরা শুরু করে দিয়ে যাবো। পরবর্তী রাজনৈতিক সরকারকে এটার ধারাবাহিকতা বজায় রাখার আহ্বান করেন।
বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, আদালত প্রাঙ্গণে আসাটা আমাদের জন্য এক্সসাইটিং, কিন্তু বিচারপ্রার্থীদের জন্য এটা একটি আজাবের মতো। এখানকার যাবতীয় ব্যবস্থাপনা কখনোই মক্কেল ফ্রেন্ডলি ছিল না। যদি সার্ভার ডাউনের মতো কু-চক্রের মধ্যে না পড়ি তাহলে সত্যিকার অর্থেই ই-পারিবারিক আদালত মানুষের উপকারে আসবে। উকিলদের ব্যাপারে মক্কেলদের মধ্যেও বিরূপ মনোভাব রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আসলে আমাদের সমাজে বলি পরিবর্তন, কিন্তু একটা ন্যস্ত স্বার্থগোষ্ঠী তারা কোন পরিবর্তন চাই না। বৈরি একটা সমাজ যদি পরিবর্তন করতে চাইও সমাজকে যারা চালাই তারা তো আসলে তত সহজে পরিবর্তন চাচ্ছেন না। পদেপদে বাঁধা সৃষ্টি হচ্ছে। পরিবর্তন কেবল সিস্টেমের নয়, মনস্তত্ত্বেও তো হতে হবে।
ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, আজকে ঢাকা এবং চট্টগ্রামে ই-পারিবারিক আদালতের কার্যক্রম চালু হলো। এর ফলে সময়, শ্রম ও মামলার জট নিবরাস ঘটবে।
উদ্বোধন অনুষ্ঠান শেষে উপদেষ্টারা সশরীরে ঢাকার ই-পারিবারিক আদালতগুলো ঘুরে দেখেন।
অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন, ঢাকা মহানগর দায়রা জজ মো. সাব্বির ফয়েজ, ঢাকার চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমানে, ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওমর ফারুক ফারুকী, ঢাকা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এডভোকেট মো. খোরশেদ মিয়া আলম, সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল হাবিবুর রহমান সিদ্দিকী, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) প্রসিকিউশন বিভাগের ডিসি মিয়া মোহাম্মদ আশিস বিন হাছানসহ বিভিন্ন অংশিজনরা।

