নিম্নচাপের প্রভাবে মৎস্য-কৃষিতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি

সরদার আনিছ
প্রকাশ : ০৩ জুন ২০২৫, ২১: ৩৫

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট গভীর নিম্নচাপের প্রভাবে টানা কয়েকদিনের বৃষ্টি, ঝোড়ো হাওয়া ও জোয়ারে উপকূলীয় জেলাসহ সারাদেশের কৃষিক্ষেত্রে ও মাছচাষিদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। উপকূলীয় অঞ্চলের বিভিন্ন নিচু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। নদ-নদীতে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি উচ্চতায় জোয়ারের পানি প্রবাহিত হওয়ায় উপকূলের অনেক বাঁধ ভেঙে মানুষের ঘরবাড়ি ডুবে গেছে। ভেসে গেছে অসংখ্য মাছের ঘের ও পুকুর। ডুবে গেছে ধান, শাকসবজি ও অন্যান্য ফসল।

বিজ্ঞাপন

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক (মনিটরিং ও বাস্তবায়ন) ড. মো. জামাল উদ্দীন বলেন, ‘উপকূলীয় অঞ্চলসহ সারাদেশের ৭০ হাজার হেক্টর ফসলি জমি আক্রান্ত হয়েছে। তবে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা নিরুপণে জেলাগুলো থেকে তথ্য আসছে। বুধবার (আজ) নাগাদ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা যাবে।’ তিনি বলেন, এবারের নিম্নচাপে পাট, আউশ ধান ও শাকসবজি ক্ষেতের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে।

মৎস্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (মৎস্য চাষ শাখা) হাবিব ফরহাদ আলম বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে আমরা যে তথ্য পেয়েছি, তাতে ৫০ কোটি টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে। দেশের বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় সব উপজেলায় কমবেশি মৎস্যচাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তবে বরিশাল অঞ্চলের চাষিরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।’

ক্ষতিগ্রস্ত মাছচাষিদের কোনো ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘গত আগস্টের বন্যায় আমরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের মাছের পোনা ও খাদ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছিলাম। এবারও ক্ষতিগ্রস্তদের সহযোগিতা দেওয়া হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।’

বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পটুয়াখালীতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেশি। জেলার কোথাও কোথাও ভারী বর্ষণ ও জলোচ্ছ্বাস হয়েছে। বসতবাড়ি, পুকুর, মাছের ঘের, ফসলি জমি ডুবে গেছে। জোয়ারের পানিতে ভেঙে গেছে বেড়িবাঁধ। এতে কৃষি ক্ষেতের ও মৎস্যচাষিদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

গলাচিপা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধ দ্রুত সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’ উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা জাফর রানা বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে এবং তাদের মধ্যে দ্রুত সহায়তা পৌঁছে দেওয়া হবে।’

বাউফল উপজেলার নিচু এলাকাগুলো প্লাবিত হয়েছে। জোয়ারের পানির চাপে ধুলিয়া, কালাইয়া, চন্দ্রদ্বীপ, নাজিরপুর ইউনিয়নের প্রায় ২০ কিলোমিটার কাঁচা ও পাকা সড়ক ভেঙে গেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে এসব এলাকায় মানুষ। ৫৮৫ কৃষকের প্রায় ২ হাজার ১৮৩ হেক্টর জমির শাকসবজি, আমন ধানের বীজতলা ও রবিশস্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

বাউফলের ইউএনও আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণের কাজ চলমান। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে সহায়তা ও রাস্তাঘাট সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হবে।’

ঝালকাঠির সুগন্ধা, বিশখালী, গাবখান, হলতা, ধানসিঁড়ি নদীর পানি স্বাভাবিকের চেয়ে পাঁচ ফুট বৃদ্ধি পেয়ে মৌসুমি কৃষি ও ফসলের বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে।

ভোলার চরফ্যাশনে নিম্নচাপের প্রভাবে মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৯০ কোটি টাকা। গত বৃহস্পতিবার ও শুক্রবারের প্রবল জলোচ্ছ্বাস ও নদীভাঙনে ঢালচর, চরনিজাম, কুকরী-মুকরী, চরপাতিলা ও মুজিব নগরসহ অন্তত চারটি ইউনিয়নের প্রায় ৩০ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

কৃষি খাতে চার কোটি টাকার ক্ষতির হিসাব দিয়েছে উপজেলা কৃষি অফিস। এর মধ্যে ৩৪ হেক্টর বীজতলা, ১০৫ হেক্টর সদ্য রোপিত আউশ ধান ও ১৪৪ হেক্টর শাকসবজির জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন প্রায় তিন হাজার কৃষক।

উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা জয়ন্ত কুমার অপু বলেন, ‘মৎস্য খাতে চার কোটি ২৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। ১২০টি মাছের ঘের ও এক হাজার ২০০ পুকুর-দীঘি প্লাবিত হয়ে ১৮ লাখ পোনা ও ১৫৩ টন মাছ ভেসে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩২টি মৎস্য নৌযানও।’

নিম্নচাপের প্রভাবে বাতাসের তোড় ও প্রবল বর্ষণে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত চট্টগ্রামের উপকূলীয় এলাকা। নিম্নচাপটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ না নিলেও বাতাসের গতিবেগ ছিল অনেকটা সাইক্লোনের মতোই। ফলে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়, ডুবে যায় অনেক নিচু এলাকা। বাতাসের তোড়ে তীরে এসে আছড়ে পড়ে চারটি জাহাজ।

নোয়াখালীর হাতিয়ায় নিম্নচাপের প্রভাবে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে ঘর ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এতে পানিতে তলিয়ে ব্যাপক ফসল বিনষ্ট হয়েছে।

আগের রেকর্ড ভেঙে সিলেটে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের নতুন রেকর্ড হয়েছে। ৩১ মে থেকে ১ জুন ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৪০৪ দশমিক ৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয় সেখানে। বৃষ্টিপাতের ফলে সিলেটের নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে সিলেট অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হয়। এতে সিলেট, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ জেলায় অনেক উপজেলায় আউশ ধানের ক্ষেত ও অন্যান্য শস্য ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

টানা বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট ও নীলফামারীর জেলার জমির ফসল। এতে ফসলের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে কৃষি অফিসের দাবি, পানি দ্রুত নেমে গেলে আক্রান্ত জমির ফসলের ক্ষতি কমে আসবে।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত